মূল্যস্ফীতির তথ্যে কারসাজি: প্রথমে পরিকল্পনামন্ত্রী কমান হার, পরে 'উন্নয়ন' দেখাতে হাসিনা-ও
দীর্ঘদিনের সন্দেহকে সত্যি প্রমাণিত করে, অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের কারসাজির প্রমাণ খুঁজে পেয়েছে। জনগণের সামনে অসাধারণ অর্থনৈতিক পারফরম্যান্স তুলে ধরে সরকারের ভাবমূর্তি বাড়াতেই যা করা হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এই ধরনের কারসাজির কারণে মনগড়া তথ্য প্রকাশ করতো বলে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির দুজন সদস্য তাদের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে টিবিএসকে জানিয়েছেন।
তারা বলেন, শেখ হাসিনার আমলে বিবিএস প্রথমে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রস্তুত করে পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে জমা দিত, পরিকল্পনামন্ত্রী নিজের ইচ্ছামতো কমিয়ে নিয়ে আসার নির্দেশ দিতেন। তাঁর পছন্দমতো তথ্য সাজিয়ে পাঠালে তা অনুমোদন করতেন মন্ত্রী। পরে তা অনুমোদনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হতো। তিনি আরেক দফায় তা কমিয়ে অনুমোদন করতেন। আর হাসিনা যে তথ্য অনুমোদন দিতেন, বিবিএস সেটিই প্রকাশ করতে বাধ্য হতো।
মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) এর প্রবৃদ্ধির তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে ঘটতো ঠিক তার উল্টোটা। যেমন ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৩%, যা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রকাশ করেছিল বিবিএস। বর্তমান সরকারের মেয়াদে গত ৩১ আগস্ট প্রকাশিত চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ৫.৭৮% দেখিয়েছে সংস্থাটি।
মূল্যস্ফীতির হার ১০% এর কাছাকাছি হলে বা বেশি হলে পরিকল্পনামন্ত্রীরা তা কোনমতেই অনুমোদন করতেন না, বরং অনেকটাই কমিয়ে দিতেন তাঁরা - জানান জাতীয় শ্বেতপত্র কমিটির একজন সদস্য।
শেখ হাসিনা সরকার গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করার আগে জুন মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে গেছে। তাতে ওই মাসের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.৭২%। জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি প্রকাশ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় ১১.৬৬%। আগস্টে এটি কমে দাঁড়ায় ১০.৪৯%।
কমিটির একজন সদস্য বলেন, জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির হারে হেরফের হলেও – মাথাপিছু জাতীয় আয়ের হিসাবে খুব বেশি পরিবর্তন হবে না। প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার যেহেতু বাড়বে, তাই নমিনাল জিডিপিও বাড়বে। আর নমিনাল জিডিপি না কমলে মাথাপিছু আয় কমবে না।
কমিটির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তথ্যউপাত্তে কারসাজির ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার সময়ে। ৫ আগস্টে হাসিনা সরকারের পতনের আগে থেকেই বিদেশে অবস্থান করছেন কামাল। অন্যদিকে তথ্য কারসাজির অভিযোগগুলো পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, যিনি ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
মান্নান টিবিএসকে বলেন, আমি পরিকল্পনামন্ত্রী থাকাকালে মূল্যস্ফীতি হার, জিডিপির প্রবৃদ্ধিসহ কোন তথ্য কখনও 'টেম্পারিং' করিনি, এবং তখনকার সরকারপ্রধান আমাকে কখনও এ ধরণের কোন নির্দেশনা দেননি।
তিনি বলেন, বিবিএসকে আমি সবসময়ই সঠিক তথ্য প্রকাশ করার পরামর্শ দিয়েছি। 'বাংলাদেশের পরিসংখ্যান নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করে। সরকারি তথ্য মানুষ বিশ্বাস করে না। তাই আপনারা সব সময় প্রকৃত তথ্য তুলে ধরবেন'- তাদের আমি এ ধরণের অনুরোধ বহুবার করেছি।
বিবিএসের পরিসংখ্যান ঘিরে সংশয়
বিবিএসের প্রকাশিত মূল্যস্ফীতি হার ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্যের বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরেই জোর সন্দেহ ছিল দেশের অর্থনীতিবিদদের মাঝে। কারণ সরকারের অর্থনৈতিক পূর্বাভাসের সাথে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দেওয়া পূর্বাভাসের পার্থক্যও ছিল সুস্পষ্ট।
সরকার প্রকাশিত মূল্যস্ফীতির হার যে বাস্তবতার সঙ্গে মিলে না, তা গত দুই বছর ধরে তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরে বলে আসছিল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও সানেমসহ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের হিসাবে, প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার সরকার প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি।
তবে সেসময়ের আওয়ামীলীগ সরকার, এবং বিশেষত অর্থমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রীরা বরাবরাই তথ্যে কারচুপির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
যদিও অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সরকারের অর্থনৈতিক অর্জন ফুলিয়ে- ফাঁপিয়ে দেখাতে গুরুত্বপূর্ণ এসব তথ্যের কারসাজি করা হয়েছে, যার আড়ালে ঢাকার চেষ্টা হয়েছে সরকারের যত দুর্নীতি ও অদক্ষতা।
সিপিডি'র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন টিবিএসকে বলেন, মূল্যস্ফীতির হার, জিডিপির প্রবৃদ্ধির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বহুবছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে সন্দেহ হচ্ছিল। 'নিজেরা সার্ভে না করলেও— একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে সাদাচোখেই তথ্যের ব্যাপক গড়মিল দেখা যেত।
বেসরকারিখাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না, অথচ জিডিপিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখানো হচ্ছিল। অথচ জিডিপির প্রবৃদ্ধির জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ।'
তিনি বলেন, একই চিত্র দারিদ্রের হারের ক্ষেত্রেও। 'আগের সরকার দারিদ্রের হার কমিয়ে— ব্যাপক সফলতা প্রচার করেছে। কিন্তু, দারিদ্রের হার কমলে বৈষম্য কমার কথা, তা কিন্তু কমেনি।'
সঠিক তথ্য জানাবে কমিটি
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা নিরুপণে গত ২৮ আগস্ট জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এই কমিটি আগামী ৩১ অক্টোবর থেকে প্রতি সপ্তাহে দু'টি করে অধ্যায় ভ্যালিডেশন রিপোর্ট প্রকাশ শুরু করবে।
১২ সদস্যের জাতীয় শেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গতকাল শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, কীভাবে বিভিন্ন ধরনের তথ্যের কারসাজি করা হয়েছে– তা নিয়ে শ্বেতপত্রের প্রথম অধ্যায় সাজানো হচ্ছে। এখানে মূল্যস্ফীতি, প্রবৃদ্ধির হার, জাতীয় আয়, খানা জরিপ, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের হিসাবে কীভাবে সুনিপুণভাবে হেরফের করা হয়েছে সেগুলো উঠে আসবে।
তিনি বলেন, 'আমরা যখন এ বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চেয়েছি, তখন তারা আমাদেরকে তাদের অসহায়ত্বের করুণ কাহিনী শুনিয়েছেন, এবং বলেছেন কীভাবে তাদেরকে বাধ্য করা হয়েছে।'
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ঢাকা চেম্বারের সভাপটি সবুর খান বিগত সরকারের পরিসংখ্যানের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, আমাদের মূল উদ্বেগ হলো তথ্যের নির্ভুলতা নিয়ে। কারণ বিশ্বাসযোগ্য তথ্য না থাকলে কোনোকিছুই ঠিকভাবে চলতে পারে না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর মূল্যস্ফীতির হারে কারচুপি হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য। তিনি বলেন, বর্তমান পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বিবিএসকে বলে দিয়েছেন, মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশের আগে তাঁর অনুমোদন নেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।