ন্যূনতম কর যেভাবে কোম্পানিগুলোর মূলধন কমিয়ে দিচ্ছে
দেশে কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আদায় করা বিদ্যমান ন্যূনতম কর (মিনিমাম ট্যাক্স) এখন নতুন করে চাপ তৈরি করেছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে একদিকে উৎপাদনের খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক গতি মন্থরতার কারণে ব্যবসায়ীরা কঠিন সময় পার করছেন। এরমধ্যে কোম্পানিগুলোর লাভজনকতাও আরো কমেছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্যে, এ অবস্থায় আগের হারেই মিনিমাম ট্যাক্স আদায়কে তাঁরা 'মরার উপর খাঁড়ার ঘা' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
আয়কর আইনের আওতায়, কোম্পানির টার্নওভারের ওপর কর্তিত মিনিমাম ট্যাক্স এবং বেশকিছু ক্ষেত্রে উৎসে কর কর্তন (টিডিএস) ফেরত দেওয়া বা সমন্বয় করার সুযোগ নেই। যার ফলে অগ্রিম কর্তিত করের তুলনায় কম মুনাফা করলে প্রকৃত করহার বেড়ে যায়। আর লোকসান করলেও ওই কর সমন্বয় করার সুযোগ নেই, যার ফলে কমে যায় কোম্পানির মূলধন।
ব্যবসার ধরনের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে কোম্পানিগুলোকে তাদের বার্ষিক টার্নওভারের ওপর শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত ন্যূনতম কর দিতে হয়। এছাড়া, রপ্তানিমুখী কোম্পানিগুলোকে তাঁদের রপ্তানিমূল্যের ১ শতাংশ উৎস কর দিতে হয়।
এ ব্যবস্থা বৈশ্বিক কর মানদণ্ডের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত নয় বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, দেশে স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগে প্রত্যাশিত গতি না আসার পেছনে এটি অন্যতম কারণ।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) বা ফিকি'র সভাপতি জাভেদ আখতার টিবিএসকে বলেন, 'গত জুলাই থেকে সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থা হওয়াসহ অন্যান্য কারণে কোম্পানিগুলোর প্রফিটেবিলিটি (লাভজনকতা) কমেছে। এই পরিস্থিতিতে, মিনিম্যাম ট্যাক্স আদায় প্রকৃত করহার আরো বাড়িয়ে দিয়েছে'।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য (আয়কর নীতি) ড. সৈয়দ মো. আমিনুল করিম বলেন, 'বিধান থাকা উচিত আয় করলে কর দেবে। কিন্তু আয় না করলেও কর দেওয়া, কিংবা মুনাফা কম করা স্বত্বেও মিনিমাম ট্যাক্স রেট এর কারণে প্রকৃত করহার বেশি হওয়া দেশে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে ভুল বার্তা পাঠায়'।
উচ্চ করভারে চাপের মুখে কোম্পানিগুলো
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদনে ক্রাইন সিমেন্ট জানিয়েছে, সিমেন্ট ব্যবসায় বর্তমানে প্রকৃত করহার বেড়ে ৮৩.৬১ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও ছিল ২৮.১৩ শতাংশ।
সিমেন্ট উৎপাদনকারী আরেকটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কর প্রদানের পূর্বে ৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা মুনাফা করার তথ্য জানিয়েছে। তবে কোম্পানিটি ৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা কর্পোরেট করের হিসাব করেছে, যা তাঁদের মুনাফার ১৭৪ শতাংশ। কিন্তু, কোম্পানিটির জন্য করের হার ২২.৫০ শতাংশ। ফলে ওই প্রান্তিকে লোকসান গুনতে হয়েছে কোম্পানিটিকে।
মেট্রোসিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, 'সিমেন্টের উৎপাদনের মূল কাঁচামাল যেমন চুনাপাথর, জিপসাম, ফ্লাই অ্যাশ, ক্লিঙ্কার এর ওপর আমদানি পর্যায়ে ২ থেকে ৩ শতাংশ অগ্রিম আয়কর রয়েছে। গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বিক্রি কমেছে ৩০ শতাংশ। সে তুলনায় ওভারহেড কস্ট কমেনি। এর ফলে অগ্রিম কর্তিত কর ফাইনাল সেটেলমেন্ট হওয়ায়, এবং তা সমন্বয়ের কোনো সুযোগ না থাকায় – আমাদের ব্যালেন্স শিট নেগেটিভ হয়ে গেছে'।
রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি তিতাস গ্যাস জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ৫৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা লোকসানের তথ্য জানিয়েছে। তবে ন্যূনতম কর কার্যকর থাকায়– তাদেরকে ১৩২ কোটি টাকা কর্পোরেট কর দিতে হয়েছে। এতে মোট লোকসান বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৮ কোটি টাকা।
বর্তমানে দেশে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর মোট সেবার উপর ২ শতাংশ হারে কর কেটে রাখা হয়। বিদ্যমান আয়কর আইন, ২০২৩ অনুযায়ী, কোম্পানির মুনাফা না হলেও এই কর দিতে হবে। এই হারে কর্তিত করের তুলনায় বেশি মুনাফা করলে – বাকী কর পরিশোধ করতে হবে; কিন্তু কম মুনাফা করলে বা লোকসান করলে – ফেরত দেওয়া হবে না।
রবি-আজিয়াটার রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের প্রধান শাহেদ আলম টিবিএসকে বলেন, 'বর্তমানে আমাদের কোম্পানির ওপর কর্পোরেট ট্যাক্স রেট ৪০ শতাংশ। কিন্তু আমাদের কাছ থেকে যে পরিমাণ ট্যাক্স কর্তন করা হয়েছে, তাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রকৃত করহার হয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ছিলো ৭৬ শতাংশ'।
চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে কোম্পানিটির কর পরিশোধের পূর্বে মুনাফা হয়েছে ৯৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। করপোরেট করহার ৪০ শতাংশ হিসাবে কোম্পানিটির করদায় আসে ৩৭৯ কোটি টাকা। কিন্তু ন্যূনতম করের কারণে কোম্পানিটিকে ৫৪৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা কর্পোরেট ট্যাক্স দিতে হয়েছে।
আবার কিছু কোম্পানি আছে, যাদের লোকসান করেও কর দিতে হচ্ছে। যেমন বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশন্স লিমিটেডকে লোকসান করা সত্ত্বেও একই হারে কর দিতে হচ্ছে, যা তাদের মূলধন কমিয়ে দিচ্ছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, কিছু ক্ষেত্রে ট্যাক্স রিফান্ড পাওয়ার জন্য যে পরিমাণ নথিপত্র জমা দিতে হয়, তাতে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ওই টাকা নিতে সমর্থ হয় না। কিংবা নিতে পারলেও – কর কর্মকর্তাদের বড় অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত উৎপাদক, বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড (বিএসআরএম) এর শত কোটি টাকার উপরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে পাওনা রয়েছে। কিন্তু ওই টাকা এনবিআরের কাছ থেকে কোম্পানিটি পাচ্ছে না বলে টিবিএসকে জানিয়েছেন কোম্পানিটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত।
ফিকির নির্বাহী পরিচালক টি আই এম নুরুল কবির বলেন, 'আমরা এসব বিষয় ইতোমধ্যে রাজস্ব বোর্ডকে জানিয়েছি। কিন্তু এটি নিয়ে এপর্যন্ত ইতিবাচক উদ্যোগ দেখা যায়নি'।
কর বিশেষজ্ঞ ও স্নেহাশীষ মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের পার্টনার স্নেহাশীষ বড়ুয়া টিবিএসকে বলেন, 'পৃথিবীর কিছু দেশে মিনিমাম ট্যাক্স আদায় করা হলেও, তা এডজাস্টেবল (সমন্বয়যোগ্য)। আমার জানামতে, এমন কোন দেশ নেই যেখানে কর সমন্বয় করার সুযোগ রাখা হয়নি। কেবল বাংলাদেশেই এ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে'।
সূত্রগুলোর মতে, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ফ্রান্স ও জার্মানির মত দেশে ন্যূনতম কর থাকলেও – সেখানে সেখানে পরবর্তীতে তা সমন্বয় করার সুযোগ রয়েছে। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-ভুক্ত কিছু দেশেও ন্যূনতম কর ফেরতযোগ্য নয়, তবে সমন্বয়যোগ্য।
বিপদ বেড়েছে রপ্তানিকারকদেরও
পোশাক রপ্তানিকারকদের মতে, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবংবিশ্ববাজারে সেই অনুযায়ী পোশাকের দর না বাড়ায়— বর্তমানে প্রায় অর্ধেক কারখানা মুনাফা করতে পারছে না। এই অবস্থায়, রপ্তানির মূল্যের ওপর ১ শতাংশ হিসেবে বর্তমানে উৎসে কর আদায় তাদের বিপদ আরও বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানির ৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানা গত বছর সোর্স ট্যাক্স (উৎস কর) হিসেবে সরকারকে ৪০ লাখ টাকা দিয়েছে। কিন্তু, বছর শেষে কারখানা কর্তৃপক্ষ হিসাব করে দেখলেন, তাদের ট্যাক্স আসে ৩ লাখ টাকা। সেই হিসেবে তার ৩৭ লাখ টাকা রিফান্ড বা সমন্বয় হওয়ার কথা। কিন্তু যেহেতু আইনে রিফান্ড বন্ধ করে রাখা হয়েছে, ফলে এটি কারখানার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল কমিয়ে দিয়েছে।
বর্তমানে পোশাক রপ্তানির আয়ের উপর কর্পোরেট করহার ১২ শতাংশ। কিন্তু ১ শতাংশ উৎসে কর কর্তন করা হয় রপ্তানি মূল্যের ওপর, আয়ের ওপর নয়। ফলে ১২ শতাংশ কর্পোরেট ট্যাক্স হিসাবে, কোম্পানিকে প্রতি ১০০ টাকায় ৮ টাকা ৫০ পয়সা হারে মুনাফা করতে হবে।
পোশাক রপ্তানিকারকরা বলছেন, বর্তমানে এই হারে খুব অল্প কারখানাই মুনাফা করতে পারছে। এর অর্থ হলো সরকারের হিসাবের তুলনায় বেশি কর রপ্তানিকারকদের পরিশোধ করতে হচ্ছে।
কর ফাঁকি রোধ করতে না পেরে সবার ওপর শাস্তি
এনবিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূলত কর ফাঁকি ঠেকাতে এ ব্যবস্থা (ন্যূনতম করনীতি) নেওয়া হয়েছে। অনেক কোম্পানি মুনাফা হওয়া সত্ত্বেও তা কম দেখানো বা লোকসান দেখানোর মাধ্যমে কর ফাঁকি দিচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে এনবিআর ন্যূনতম কর আরোপ করে এবং ধীরে ধীরে এই হার বাড়াতে থাকে।
এনবিআরের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, কোম্পানির টার্নওভারের উপর অগ্রিম আয়কর চালু করা হয় ১৯৮০'র দশকে। তখন আমদানি ও ঠিকাদারদের কর ফাঁকি ঠেকাতে এই ব্যবস্থা চালু করা হয়। এতে সফলতা পাওয়ার পর অন্যান্য খাতেও চালু হতে থাকে। তবে কোম্পানির টার্নওভারের ওপর ফাইনাল সেটেলমেন্ট নামে চালু হয় ২০১১ সাল থেকে। এর পর ২০১৬ সালের দিকে এসে মিনিমাম ট্যাক্স ((ন্যূনতম কর) নাম দেওয়া হয়।
ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)-র ভাইস প্রেসিডেন্ট লুৎফুল হাদী টিবিএসকে বলেন, 'এনবিআরের উচিত হলো কেউ কর ফাঁকি দিলে– ওই ফাঁকি ধরা অডিট বা অন্য কোন উপায়ে পর্যালোচনার মাধ্যমে। কিন্তু, সেই সক্ষমতা না থাকায় এর শাস্তি কমপ্ল্যায়েন্ট প্রতিষ্ঠানের ওপরও দেওয়া হচ্ছে। এটি কাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি নয়'।
রবি আজিয়াটার কর্মকর্তা শাহেদ আলম বলেন, 'মুনাফার ওপর কর্পোরেট ট্যাক্স দিতে হবে – এটি একটি প্রতিষ্ঠিত আইনি নীতি। মোট রাজস্বের উপর সংগৃহীত কর্পোরেট কর, যা ন্যূনতম টার্নওভার ট্যাক্স নামে পরিচিত, এই আইনি কর নীতির পরিপন্থী'।
তিনি বলেন, আমরা যখন বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ট্যাক্স এই আইন নিয়ে কথা বলি, তারা অবাক হয়। এই ব্যবস্থাটি ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত নিরাশাজনক এবং ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের সম্ভাবনাকেও নিরুৎসাহিত করে। আমরা আশা করি, সরকার হয় এটি পুরোপুরি প্রত্যাহার করবে নয়তো অদূর ভবিষ্যতে মিনিমাম টার্নওভার ট্যাক্স রিফান্ড করার ব্যবস্থা নেবে'।