এডিপির অব্যয়িত অর্থে বকেয়া ভর্তুকি পরিশোধ করবে সরকার
গত কয়েক বছর ধরে সার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে জমে থাকা সকল বকেয়া ভর্তুকি চলতি অর্থবছরেই পরিশোধের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সরকার মনে করছে চলতি অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি(এডিপি) বাস্তবায়ন বাবদ রাখা বরাদ্দের বড় অংশই ব্যয় হবে না। ফলে এডিপির অব্যয়িত অর্থ থেকে ভর্তুকির বকেয়া পরিশোধ করা হবে। অর্থবিভাগ সুত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানা গেছে, গত নভেম্বর শেষে সার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে মোট বকেয়া ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। আর অর্থবছরের বাকি সময়ে আরও ২০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রয়োজন হবে।
কর্মকর্তারা আরও জানান, চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ৩৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। অর্থাৎ, সরকারকে পুরো ভর্তুকি পরিশোধ করতে হলে— বাজেটে বরাদ্দের বাইরে অতিরিক্ত ৪০ হাজার কোটি টাকা দিতে হবে। জানা গেছে, এই ৪০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে বন্ড ইস্যু করে। আর বাকি ৩৫ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে এডিপির অব্যয়িত অর্থ থেকে।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে এডিপির বরাদ্দের মাত্র ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা।
সুষ্ঠু আর্থিক ব্যবস্থাপনার সহায়ক হবে
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, ভবিষ্যতে দেশের ওপর বোঝা কমাতে দেশকে বকেয়া মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। কারণ বিগত আওয়ামীলীগ সরকার উন্নয়নের কথা বলে যেভাবে প্রচুর প্রকল্প নিয়েছে, নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারও অনেক উন্নয়ন প্রকল্প নিতে পারে। এসব প্রকল্পের বরাদ্দ দিতে তখন সরকার আর্থিক চাপে পড়বে।
তাছাড়া, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের ঋণের শর্তে বলেছে, 2026-27 অর্থবছরের মধ্যে সার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বকেয়া ভর্তুকি পরিশোধ করতে হবে। সুষ্ঠুভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ভর্তুকি বকেয়া না রাখার শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি।
সরকারের এই পরিকল্পনাকে ইতিবাচক বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা, তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা ও সরবরাহকারীদের মধ্যে আস্থা বাড়াতে বকেয়া পরিশোধ করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'সার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগটি ইতিবাচক। বকেয়া একটা ঋণের মত। ঋণ ও বকেয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক বিচারে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ফলে ঋণ খেলাপি হওয়া আর বিল বকেয়া হয়ে পড়া, দুটোই একই ধরনের বদনাম। সরকারের প্রতি ঋণ দাতাদের বা সরবরাহকারীদের আস্থার জন্য বকেয়া পরিশোধ করতে হবে। তবে সেটা বাজেটের ভেতর থেকে করা যেতে পারে। কোনোভাবেই বাজেট ঘাটতি বাড়িয়ে নয়।'
অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, ভর্তুকির পুরোটাই পরিশোধ করা হলেও – বাজেট ঘাটতি পাঁচ শতাংশের বেশ খানিকটা নিচে থাকবে বলেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক হিসেবে উঠে এসেছে।
গবেষণা সংস্থা – সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, চলতি অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়ন বাবদ ব্যয় যেহেতু কম হবে, ফলে ওই অর্থ বকেয়া পরিশোধে ব্যয় করা যেতেই পারে।
অর্থ বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরই যতদুর সম্ভব ভর্তৃকি পরিশোধের জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), পেট্টোবাংলা, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করে তাদের কত ভর্তুকি বকেয়া, চলতি অর্থবছরে কত প্রয়োজন হবে— সব তথ্য নেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, ভর্তুকি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে যথাসময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে বিল দাখিল করে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ভর্তুকির বিষয়ে আইএমএফের শর্ত
অর্থ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে জানান, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের ঋণের শর্তে বলেছে, ২০২৬-২৭ অর্থবছরের মধ্যে সার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বকেয়া ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। সুষ্ঠুভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনার স্বার্থে আগামী অর্থবছরের মধ্যেই বকেয়া পরিশোধ করতে বলেছে বৈশ্বিক ঋণদাতাটি।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, তবে একটি অর্থবছরে যাতে বাড়তি চাপ না পড়ে – সেজন্য সংস্থাটি প্রতিবছর নিদির্ষ্ট হারে দিয়ে ভর্তুকির বকেয়া পরিশোধের মাধ্যমে আগামী ২০২৬-২৭ অর্থবছরে পুরোপুরি পরিশোধ করে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরামর্শ দিয়েছে। এজন্য আইএমএফ ভর্তুকির কোন অংশ বকেয়া – সেটি হিসাবের একটি পদ্ধতিও বাৎলে দিয়েছে।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, 'বকেয়া ভর্তুকি পরিশোধের পরিকল্পনাটি এই মুহূর্তে বাস্তবায়ন করতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে অন্তর্বর্তী সরকার। কারণ এডিপিতে যা বরাদ্দ থাকে – সংশোধিত বাজেটে সাধারণত তার একটি অংশ বাদ দেওয়া হয়। মূল বাজেট একটি অংক মাত্র। সংশোধিত বাজেটই আসল, যেটা সরকার বাস্তবায়ন করে।'
তিনি বলেন, এখন দেখার বিষয় এডিপির যতটা বাস্তবায়নের সক্ষমতা আছে, কিন্তু সরকার বাস্তবায়ন করবে না, বা বাস্তবায়ন না করে সেই অর্থ অন্য খাতে ব্যয় করবে এমন প্রকল্প কতগুলো। তিনি মনে করেন, 'এ ধরনের প্রকল্পের সংখ্যা খুব বেশি হবে না। ফলে ভর্তুকির বকেয়া বাবদ যে বিপুল অর্থ দরকার – সেটা শুধু এডিপি বাস্তবায়ন কমিয়ে পূরণ করা কঠিন।'
সিপিডির ফাহমিদা খাতুন কিছু ক্ষেত্রে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার পরামর্শ দেন, বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। 'তবে কৃষিখাতে সারসহ অন্যান্য যেসব ভর্তুকি লাগে, সেগুলো একবারে তুলে না দিয়ে – ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে,' বলে তিনি মনে করছেন।
এডিপি বাস্তবায়নের হার কম হলেও বেড়েছে সরকারের ব্যয়
চলতি অর্থবছরের শুরুতে কোটাসংস্কার আন্দোলন, সেখান থেকে গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামীলীগ সরকারের পতন ও নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কারণে এডিপি বাস্তবায়ন বিশেষ হয়নি। এদিকে সরকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এসব কারণে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এডিপির আকার মুল বাজেটের তুলনায় প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা কমতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
তবে এডিপির আকার কমলেও মোট বাজেটের আকার এতটা কমবে না। কারণ ভর্তূকি বাবদ যেমন বেশি অর্থ পরিশোধ করা হবে, তেমনি সুদ পরিশোধ বাবদ সরকারকে বাজেট বরাদ্দের বাইরে বাড়তি ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে বলে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় বেড়েছে। আবার বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় – বৈদেশিক ঋণের সুদ বাবদ বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে।
এদিকে আন্দোলনে আহত-নিহতদের চিকিৎসা, ক্ষতিপূরণ, বিভিন্ন খাতে পদোন্নতির ফলে বাড়তি বেতন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাবদ বাড়তি ব্যয় করছে সরকার।
ভবিষ্যতে দেনার বোঝা কমাতে চায় সরকার
অর্থ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর উন্নয়ন ব্যয় অনেকতা বাড়বে বলে মনে করছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাছাড়া, চলতি অর্থবছরে এডিপি ব্যয় কম হওয়ার অর্থ আগামীতে উন্নয়ন চাহিদা বাড়বে। তখন নতুন সরকারের পক্ষে চাইলেও বকেয়া পরিশোধ করা সহজ হবে না। নেবে। এতে করে প্রকল্পের অর্থ দিতেই নির্বাচিত সরকার আর্থিক চাপে পড়বে। তাই এমন পরিস্থিতি এড়াতে এপর্যন্ত হওয়া বেশিরভাগ বকেয়া ভর্তুকি চলতি অর্থবছরেই পরিশোধ করার লক্ষ্য রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রটি বলছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘ সময় ব্যয় করেও ১৯৯৭ সালের একটি আন্তর্জাতিক সালিশি দাবি নিষ্পত্তিতে ব্যর্থ হয়। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ আইনি জটিলতায় পড়ে।
এই ঘটনার জেরে গত অক্টোবরে ওয়াশিংটনে সরকারি সফরকালে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বিরুদ্ধে হঠাৎ করেই মার্কিন আদালতের বিচারিক আদেশ আসে। অন্তর্বর্তী সরকারের তৎপরতায় পরবর্তীতে মার্কিন আদালতে ব্যাখ্যা দিতে যাওয়ার আদেশটি তুলে নেওয়া হয়। তবে আগামীতে যেন সরকারকে অর্থ পরিশোধ সংক্রান্ত এ ধরনের কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে না হয় – এটিও এ উদ্যোগের অন্যতম কারণ।