শূন্য ও ১ শতাংশ শুল্কের পণ্যের আমদানিমূল্য হ্রাস, বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার কমার ইঙ্গিত
শূন্য থেকে ১ শতাংশ শুল্কের আওতাভুক্ত পণ্যের আমদানিমূল্য চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জুলাই–নভেম্বর সময়ে গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। মূলধন পাচার প্রতিরোধে অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর অবস্থান বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার কমার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা এবং বাণিজ্য বিশ্লেষকদের মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে শুল্কমুক্ত ও ১ শতাংশ শুল্কের আওতাভুক্ত পণ্যের গড় আমদানি ব্যয় এক বছর আগের তুলনায় ৯ শতাংশ কমেছে। তারা এর প্রধান কারণ হিসেবে বিশ্ববাজারে কিছু পণ্যের মূল্যহ্রাসকে চিহ্নিত করেছেন।
শুল্কমুক্ত (জিরো ডিউটি) ও ১ শতাংশ শুল্কের তালিকায় মূলত অর্থনৈতিক অঞ্চলের মূলধনী যন্ত্রপাতি, খাদ্যশস্য, সার, তুলা এবং অন্যান্য শিল্পের কাঁচামাল অন্তর্ভুক্ত।
২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই–নভেম্বর) শুল্কমুক্ত পণ্যের গড় আমদানি ব্যয় প্রতি মেট্রিক টন ৫৮ হাজার টাকার সামান্য বেশি ছিল, যা ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ছিল ৬৪ হাজার টাকা এবং ২০২২–২৩ অর্থবছরে ছিল ৮১ হাজার টাকা। এনবিআরের কাস্টমস বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ের মধ্যে এটি গত চার অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন গড় আমদানিব্যয়।
একইভাবে, ১ শতাংশ শুল্কের আওতাভুক্ত মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিমূল্যও হ্রাস পেয়েছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এর গড় মূল্য ছিল প্রতি মেট্রিক টন সাত লাখ ৮২ হাজার ৭৮০ টাকা, যা ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ছিল আট লাখ ৬৮ হাজার ২১৩ টাকা এবং ২০২২–২৩ অর্থবছরে ছিল সাত লাখ ৮৯ হাজার টাকা।
এনবিআর-এর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা মনে করি আমদানিমূল্য হ্রাসের একটি কারণ হলো এ শ্রেণির পণ্যে ওভার-ইনভয়েসিং কমে যাওয়া। রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে এটি বাণিজ্য-ভিত্তিক অর্থপাচার কমার ইঙ্গিত দেয়।'
তিনি আরও জানান, 'বিশ্ববাজারে কিছু পণ্যের দাম কমা আমদানিমূল্য হ্রাসের একটি কারণ হলেও তার ফলে এত উল্লেখযোগ্য হারে আমদানিমূল্য কমার কথা নয়।'
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৮০ শতাংশেরও বেশি অর্থপাচার হয় আমদানি-রপ্তানির আড়ালে, যা বাণিজ্য-ভিত্তিক অর্থপাচার নামে পরিচিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক পাচারকারী শূন্য বা কম শুল্কের পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেখান, যাতে কম কর পরিশোধ করে সহজে অর্থপাচার করা যায়।
উচ্চ শুল্কের পণ্যের ক্ষেত্রে ওভার-ইনভয়েসিংয়ের সুযোগ কম থাকে, কারণ ব্যবসায়ীরা সাধারণত কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য এসব পণ্যের মূল্য কমিয়ে দেখান। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই–নভেম্বর সময়ে উচ্চ শুল্কের পণ্যের (২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক) গড় মূল্য গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে।
ভুল চালানের কারণে বার্ষিক ৮.২৭ বিলিয়ন ডলার লোকসান
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই)-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাণিজ্যে ভুল তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৮.২৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করা হয়েছে। এ সময়ে মোট ৬২ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছে দেশ।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, 'স্থানীয় মুদ্রার ৪০ শতাংশ অবমূল্যায়ন সত্ত্বেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের গড় আমদানিমূল্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে, এসব পণ্য অর্থপাচারের উদ্দেশ্যেই হয়তো ব্যবহার করা হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'গত আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকার মূলধন পাচার ও অর্থপাচারের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।'
'এটাও বিশ্বাস করা হয় যে, বাণিজ্য-ভিত্তিক অর্থপাচারের বড় অংশটি পূর্ববর্তী শাসনামলের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও কর্মকর্তাদের সুবিধার্থে করা হতো। তাদের অনেকেই এখন পলাতক বা কারাগারে আছেন,' বলেন তিনি।
এনবিআর-এর শুল্ক নীতির সদস্য হোসাইন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের ফলে অর্থপাচারে জড়িত ছোট-বড় খেলোয়াড়রা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন, যা এ হ্রাসের সম্ভাব্য কারণ।'
তিনি আরও বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমদানিকৃত পণ্যের সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়েছে, ফলে অর্থপাচারের সুযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, 'আমরা অ্যাসাইকুডা সফ্টওয়্যারসহ [অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম] অন্যান্য উৎস থেকে ডেটা সংগ্রহ করে এআই-এর মাধ্যমে বিশ্লেষণ করছি, যার ফলে কমপ্লায়েন্স আগের তুলনায় বেড়েছে।'
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, 'অনেক সন্দেহভাজন ব্যক্তি বর্তমানে দেশে নেই; নিষ্ক্রিয় আছেন অথবা কারাগারে রয়েছেন। ফলে অর্থপাচারের পরিমাণ এখন কম হওয়া উচিত।'
'১৫ বছরে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার'
এ মাসের শুরুতে শ্বেতপত্র কমিটি জানিয়েছে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা) পাচার হয়েছে।
দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানির ওপর নির্ভরশীল। এ খাতের অনেক উদ্যোক্তা মনে করেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অর্থপাচারের পরিমাণ কমেছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, 'জুলাই থেকে অর্থপাচারে জড়িত বেশিরভাগ বড় খেলোয়াড় পলাতক বা কারাগারে রয়েছেন।'
তবে তিনি আরও বলেন, 'যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অতীতে ভুল চালান যাচাইয়ের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করত, তাহলে এত বিশাল পরিমাণ অর্থ পাচার হতো না।'
চূড়ান্ত নয়
তবে অনেকেই বলছেন, কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের গড় আমদানিমূল্য হ্রাস মানেই যে ওভার-ইনভয়েসিং কমেছে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
এনবিআরের শুল্ক নীতির সাবেক সদস্য মো. লুৎফর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'শুল্কমুক্ত এবং ১ শতাংশ শুল্কের আওতায় থাকা পণ্যের গড় মূল্য কমা মানেই যে ওভার-ইনভয়েসিং বা মানি লন্ডারিং কমেছে, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।'
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, 'শূন্য এবং ১ শতাংশ শুল্কের আওতায় বিভিন্ন ধরনের পণ্য অন্তর্ভুক্ত। সব পণ্যের মূল্য কি কমেছে? বিশ্ববাজারে দাম কমা কি এর কারণ, না-কি অন্য কোনো কারণ রয়েছে? একই সময়ে একই পণ্যের বাণিজ্যিক আমদানির মূল্য বিশ্লেষণ করলেই প্রকৃত কারণ জানা যাবে।'