আগামী অর্থবছর থেকে অধিকাংশ পণ্য, সেবায় একক হারে ভ্যাট
আগামী অর্থবছর থেকেই প্রায় সব পণ্য ও সেবার ওপর একক ১৫ হারে ভ্যাট কার্যকর করতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ২০১২ সালে আইএমএফকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে পাশ করা একটি আইনের সাথে সামঞ্জস্য রাখতেও তা করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
শুরুতে চলতি অর্থবছরের বাকি ছয় মাসে এটি কার্যকর করা হবে, যার ফলে চলতি মাসেই হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট প্রদানের সুবিধা হারাবে ২০টি পণ্য ও সেবা।
এসব পণ্য ও সেবায় বর্তমানে ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) রয়েছে, যা ১৫ শতাংশ ভ্যাটের আওতায় আসবে। ওই আইন অনুযায়ী, যা হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ট রেট।
রাজস্ব বোর্ডের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো জানায়, একইসঙ্গে যেসব শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে, তার বেশিরভাগই বাতিল হয়ে যেতে পারে। বাড়তে পারে সম্পূরক শুল্কও।
কর্মকর্তারা জানান, তবে গ্যাস ও বিদ্যুতের মতো কিছু সেবার ক্ষেত্রে হ্রাসকৃত হারের সুবিধা রাখা হতে পারে। যাতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে ভোক্তাদের ওপর এসব খরচের চাপ আরও না বাড়ে।
এনবিআর এর ভ্যাট নীতির একজন সিনিয়র কর্মকর্তা গতকাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'চলতি মাস থেকেই বড় আমরা ১৫ শতাংশ ইউনিফায়েড রেটের পরিকল্পনা করছি।'
সূত্রগুলো বলছে, এনবিআর সংস্কারের জন্য গঠন করা উপদেষ্টা কমিটি একক ভ্যাট হারের পক্ষে। তবে এই হার ১৫ শতাংশ থেকে কমানোর পক্ষে তারা।
এদিকে একক ভ্যাট হার কার্যকর নিয়ে সতর্ক করেছেন ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের শঙ্কা, এতে ভ্যাট আদায় বাড়লেও – এর চাপ সাধারণ ভোক্তার ওপর পড়তে পারে – যা মূল্যস্ফীতিকে আরো উস্কে দেবে।
গুঁড়া দুধ, বিভিন্ন মশলা, খাদ্যপণ্য, এলপিজি, ইন্টারনেট পরিষেবা, রাইড শেয়ারিং থেকে শুরু করে বর্তমানে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভ্যাটের হার রয়েছে – এমন পন্য ও সেবার সংখ্যা প্রায় ১২০টি। শিগগিরই এগুলোর বেশিরভাগকে একক হারের আওতায় আনা হতে পারে।
এনবিআর এর ভ্যাট উইংয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন," আইএমএফ এর শর্ত অনুযায়ী আগামী চলতি মাসের মধ্যেই একটি বড় সংখ্যক পণ্যের ভ্যাট সিঙ্গেল বা স্ট্যান্ডার্ড রেট এ চলে আসবে বলে আশা করছি।"
"এরপর আগামী জুনের বাজেটে প্রায় সবই ইউনিফায়েড রেটে চলে আসবে। হয়তো সামান্য কিছু বাকি থাকতে পারে। এছাড়া বেশিরভাগ অব্যাহতি উঠিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে আগামী জুনের বাজেটে" –বলেন তিনি।
এবিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান।
তবে সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন যে, আইএমএফের শর্তপূরণে কর অব্যাহতি ব্যাপকভাবে কমানোর জন্য চাপের মধ্যে আছে রাজস্ব কর্তৃপক্ষটি।
এক দশক আগে প্রথম পরিকল্পনা করা হয় একক ভ্যাট হারের
বাংলাদেশ ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৯৯ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার আগে একক ভ্যাট হার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর অংশ হিসেবে সালে সব পন্য ও সেবায় একক হার রেখে নতুন 'মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২' পাশ করে সংসদে, যা ২০১৫ সাল থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু, পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকে এর বিরুদ্ধে মাঠে নামেন ব্যবসায়ীরা। যদিও ২০১১-১২ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৬৯ ও ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ।
এরপর ২০১৭ সালে উদ্যোগ নেওয়ার পরও ব্যবসায়ীদের তীব্র বিরোধিতার মুখে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। ব্যবসায়ীদের বেশকিছু দাবি মেনে পরবর্তীতে ২০১৯ সালে বাস্তবায়ন শুরু করলেও বেশকিছু পণ্য ও সেবাকে হ্রাসকৃত হারের (১৫ শতাংশের নিচে) সুবিধা দেওয়া হয়।
তবে ২০২৩ সালের শুরুতে বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় ছোটবড় ৩০টির বেশি শর্ত দেয় আইএমএফ। যার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল জিডিপিতে রাজস্বের অবদান বাড়ানো।
আন্তর্জাতিক ঋণদাতাটির শর্ত পূরণে তাই এক দশকের বেশি সময় পরে এসে একক ভ্যাট হার বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ
বর্তমানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছাড়াও— ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট রয়েছে – এমন পণ্য ও সেবার সংখ্যা প্রায় ১২০টি। এর বাইরে কিছু পণ্যের পরিমাণের ওপর নির্দিষ্ট অংকের ভ্যাট দিতে হয়, যা স্পেসিফিক ট্যাক্স নামে পরিচিত। আবার বছরে নির্দিষ্ট পরিমাণ টার্নওভার বা বিক্রির ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট রয়েছে।
এর বাইরে বিদ্যমান আইনে কাভার করেনা, এমন কিছু ভ্যাটও বর্তমানে কার্যকর রয়েছে। যেমন পুরান ঢাকায় প্রতি টন ইস্পাত পণ্য বিক্রি হয় প্রায় দেড় লাখ টাকায়। প্রতি টন বিক্রিতে ১,০০০ টাকা মূল্য সংযোজন ধরে ১৫ শতাংশ হারে প্রতি টনে ১৫০ টাকা আদায় করা হয়। অর্থাৎ প্রায় দেড় লাখ টাকায় এই ভ্যাট হয়।
২০১২ সালে একক ভ্যাট হারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ওই সময় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী নেতারা।
বাংলাদেশ স্টিল ইমপোর্টার্স অ্যান্ড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী নেতা আমির হোসেন নূরানী টিবিএসকে বলেন, "সোনারগাঁও হোটেলের খাবার আবার একটি সাধারণ মানের দোকানের সার্ভিসের উপর একই হারে ভ্যাট দেওয়া অযৌক্তিক। যে প্রতিষ্ঠানের ভ্যালু এডিশন ১ শতাংশ, সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেওয়া হলে— ওই ভ্যাট আদায় হবে না।"
কিন্তু ব্যবসায়ীদের তো ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট নেওয়ার সুযোগ রয়েছে – এমন প্রশ্নে এই আমদানিকারক বলেন, "আমার নিজের প্রতিষ্ঠানেরই আমদানির বিপরীতে ৫৮ লাখ টাকা রিবেট এনবিআরের কাছে পাওনা। এনবিআর তো ওই টাকা সমন্বয় করতে দিচ্ছে না। তাহলে আইনের কি বাস্তবায়ন আছে?"
তিনি বলেন, "বিশ্বের বহু দেশেই ভ্যাটের মাল্টিপল রেট আছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশেই জিএসটি'র আওতায় ১ শতাংশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রেটে ট্যাক্স আছে।"
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আশরাফ আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "সব ক্ষেত্রে একক বা ১৫ শতাংশ ভ্যাট রেট হলে সেটি ভয়াবহ ব্যাপার হবে। বাংলাদেশ যেহেতু আমদানি নির্ভর দেশ, ফুড প্রোডাক্ট থেকে অনেক পন্যের দাম শুধু এ কারণে ১০ থেকে ১২ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে।"
তিনি বলেন, "এখানে ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট নেওয়ার সুযোগ আইনে থাকলেও— বিভিন্ন জটিলতার কারণে তা বেশ কঠিন। ফলে ভ্যাটের বাড়তি চাপ ভোক্তার ওপর গিয়ে পড়বে।"
অপর একজন ব্যবসায়ী নেতা বলেন, "রিবেট নিতে হলে সাপ্লাই চেইনের সব পর্যায়ে যথাযথ প্রক্রিয়ায় হিসাব রাখতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বাস্তবতায় এটি সব ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। বিশেষত উৎপাদনকারীদের জন্য কঠিন হবে।"
বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, একক হার বাস্তবায়ন করলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য লুৎফর রহমান বলেন, "ইউনিফায়েড হিসেবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট হলে বেশকিছু পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে, যা মূল্যস্ফীতি আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।"
অবশ্য বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো একক হার রাখার পক্ষে।
উপদেষ্টা কমিটি একক হারের বাস্তবায়ন চায়, তবে কম রেখে
এনবিআর সংস্কারে সম্প্রতি গঠন করা উপদেষ্টা কমিটি একক হার বাস্তবায়নকে সমর্থন করে। তবে তা ১৫ শতাংশের চেয়ে কম রাখার পক্ষে তারা।
এই কমিটির একজন সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "আমরা মনে করি, একটি স্টান্ডার্ড ভ্যাট রেট থাকা উচিত। আইএমএফ স্টান্ডার্ড ভ্যাট রেট বা সিঙ্গেল ভ্যাট রেট চাচ্ছে সেজন্য কমিশন এ প্রস্তাব করবে তা নয়। কমিশন মনে করে ভ্যাটের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলার স্বার্থেই সিঙ্গেল রেট থাকা উচিত।"
"তবে তা বিদ্যমান রেট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে নির্ধারণ করা যেতে পারে। কারণ এটা অনেকের কাছেই বেশি মনে হয়, যেকারণে তারা ফাঁকি দিতে চায় বা ভ্যাট দিতে উৎসাহিত হয় না" – বলেন তিনি।
ডিসিসিআই সভাপতিও মনে করেন, একক হার হলেও তা ৫ থেকে ৬ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।
যেসব পণ্য ও সেবা প্রভাবিত হবে
বর্তমানে ৫ শতাংশ ভ্যাটের তালিকায় উল্লেখযোগ্য পণ্যের মধ্যে আছে – তরল দুধ থেকে গুঁড়া দুধ উৎপাদন; গুঁড়া মরিচ, ধনিয়া, আদা, হলুদ বা এসব মশলার মিশ্রণ; বিভিন্ন ধরনের খাবার আইটেম, এলপি গ্যাস, বাল্ক ইমপোর্টেড পেট্রোলিয়াম বিটুমিন, বিভিনন ধরনের কাগজ, তুলার সুতার বর্জ্য, কৃত্রিম তন্তুতে তৈরি ফ্যাব্রিক, সি আর কয়েল শিট, ডিজেল ইঞ্জিন, ট্রান্সফরমার, যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক ও পণ্যবাহী যান্ত্রিক নৌযান।
১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হলে– এসব পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়বে।
সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাটের আওতায় থাকা উল্লেখযোগ্য পণ্য ও সেবার মধ্যে আছে – ইন্টারনেট পরিষেবা, ফার্নিচার উৎপাদন, পরিবহন ঠিকাদার, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, বিদ্যুৎ বিতরণকারী, রাইড শেয়ারিং, আইটিইএস, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, ফেসিয়াল বা পকেট টিস্যু, নন-এসি হোটেল রেস্টুরেন্ট, মিষ্টান্ন ভান্ডার ও নিজস্ব ব্র্যান্ডের পোশাক বিপণনকারী।
১০ শতাংশের তালিকায় থাকা উল্লেখযোগ্য পণ্য ও সেবা হলো – মোটরগাড়ির গ্যারেজ, ডকইয়ার্ড, ছাপাখানা, মেরামত ও সার্ভিসিং, এসি নৌযান সার্ভিস, স্বয়ংক্রিয় করাতকল, ক্রীড়ানুষ্ঠান আয়োজক ও পরিবহন ঠিকাদার ইত্যাদি।
এর বাইরে স্পেসিফিক ট্যাক্স রয়েছে এমন পণ্যে হলো নিউজপ্রিন্ট কাগজ, কটন ইয়ার্ন, কৃত্রিম তন্তু (ম্যান মেইড ফাইবার), ইট, ব্রিক চিপস, স্ক্র্যাপ শিট, এমএস প্রোডাক্ট, বিলে্ট ও ইনগট।
এছাড়া সংবিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রক আদেশ বা এসআরও এর মাধ্যমে কিছু পণ্য ও সেবায় হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট সুবিধা রয়েছে। এনবিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ২০টি পণ্য ও সেবায় এ সুবিধা আছে। এসব পণ্য ও সেবার বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই একক হার কার্যকর হতে পারে।