বাংলাদেশ থেকে সোর্সিং ৩০ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা রুশ ফ্যাশন ব্র্যান্ডের
বাংলাদেশ থেকে সোর্সিং (পণ্য সংগ্রহ) বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে রাশিয়ার বৃহত্তম ফ্যাশন ব্র্যান্ড গ্লোরিয়া জিন্স। ২০২৫ সালের মধ্যে অর্ডার ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে বার্ষিক টার্নওভার ৭০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য ঠিক করেছে তারা।
রাশিয়ায় স্থানীয় পোশাক উৎপাদন কমিয়ে নতুন সোর্সিং গন্তব্য খুঁজছে কোম্পানিটি। সেই কৌশলের অংশ হিসেবেই বাংলাদেশ থেকে সোর্সিং বাড়ানোর পরিকল্পনা তাদের।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গ্লোরিয়া জিন্সের বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের আঞ্চলিক জেনারেল ম্যানেজার মইন আহমেদ বলেন, 'গত বছর বাংলাদেশ থেকে আমাদের সোর্সিং অনেকটা বেড়েছে। ২০২৫ সালে আমাদের ব্যবসা বিদায়ী বছরের চেয়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।'
তিনি জানান, এক বছর আগে গ্লোরিয়া জিন্স উজবেকিস্তান থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি রাশিয়ায় ৬-৭টি উৎপাদন ইউনিট বন্ধ করার পরিকল্পনার ইঙ্গিতও দেন তিনি। এসব অর্ডারের একটি অংশ প্রধান সরবরাহকারী চীন ও ভিয়েতনামের পাশাপাশি বাংলাদেশেও স্থানান্তরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের স্থানীয় অফিস উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ডেনিম কাপড় উৎপাদন করেছে, যা এর প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা বাড়িয়েছে। তবে রাশিয়ায় পোশাক রপ্তানিতে উচ্চ শুল্ক এখনও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। এই চড়া শুল্ক ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশি পণ্যের দাম কম প্রতিযোগিতামূলক করে তুলেছে।
মঈন জানান, শুল্কজনিত বাধা সত্ত্বেও বাংলাদেশে গত তিন বছরে গ্লোরিয়া জিন্সের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমরা এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উদ্ভাবনী কৌশল প্রয়োগ করেছি, ইতিমধ্যেই যার কার্যকারিতার প্রমাণ মিলেছে। তবে আরও সম্ভাবনার দ্বার খুলতে চড়া শুল্ক কমানোর ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা জরুরি।'
সরকারি পর্যায়ে শুল্ক কমানোর আলোচনা শুরু করার প্রচেষ্টা এখন পর্যন্ত তেমন একটা অগ্রগতির মুখ দেখেনি।
'বাংলাদেশ যদি এসব শুল্ক বাতিলের আলোচনায় সফল হয়, তবে এদেশ রাশিয়ায় সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী হয়ে উঠতে পারে। এই বাজারে পোশাক রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে,' মঈন বলেন।
বাংলাদেশ থেকে সোর্সিংয়ের শক্তিশালী দিক
বাংলাদেশে গ্লোরিয়া জিন্সের সাফল্যের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে (আরএনডি) কৌশলগত পরিবর্তনের কৃতিত্ব দেন মঈন।
স্থানীয় মিলগুলো উৎপাদকরা উচ্চমানের ফ্যাব্রিক সরবরাহ করে এই প্রচেষ্টায় সহায়তা করেছে। এর ফলে গ্লোরিয়া জিন্স ডেনিম উৎপাদনের জন্য ৯০ শতাংশের বেশি স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা উপকরণ ব্যবহার করতে পেরেছে।
এর সুবাদে একসময় রাশিয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শার্ট ও চিনো রপ্তানি করা কোম্পানিটি বাংলাদেশে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
মঈন বলেন, '২০২৫ সালে আমাদের লক্ষ্য ব্যবসা ৭০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছানো। এ লক্ষ্য অর্জনে মূল ভূমিকা রাখবে ডেনিম। বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের বৈচিত্র্যময় ওয়াশ এবং উন্নয়নের সক্ষমতা রয়েছে, যা বাজারে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করেছে।'
বর্তমানে ছয়টি বাংলাদেশি সরবরাহকারী রাশিয়ার ডেনিম আমদানির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করে। এর মধ্যে শীর্ষ দুই রপ্তানিকারক হচ্ছে অ্যাবা গ্রুপ ও স্কয়ার গ্রুপ।
ডেনিম ছাড়াও গ্লোরিয়া জিন্স বাংলাদেশ থেকে জার্সি নিটওয়্যার ও সোয়েটার সংগ্রহ করে। এছাড়া টেক্সট টাউন গ্রুপের সঙ্গে আউটওয়্যারও উৎপাদন করছে কোম্পানিটি। আগামী মৌসুমে নতুন অর্ডার আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের ২৬টি পোশাক কারখানা গ্লোরিয়া জিন্সের জন্য পোশাক তৈরি করছে। মঈন ২০১৫ সালে কোম্পানিটিতে যোগ দেওয়ার সময় বাংলাদেশ থেকে বার্ষিক সোর্সিংয়ের পরিমাণ ছিল ৫ মিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালের মধ্যে এটি বেড়ে ৮০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।
২০২৩ সালে গ্লোরিয়া জিন্স বাংলাদেশ থেকে ১৩ মিলিয়ন পিস পোশাক সংগ্রহ করেছে। চলতি বছরে এই পরিমাণ ১৫ শতাংশ বাড়বে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। শুল্কছাড়ের সুবিধা পাওয়া গেলে এই পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
বাংলাদেশের রপ্তানিতে উচ্চ শুল্কের প্রভাব
মঈন আহমেদ বলেন, চীন ও ভিয়েতনামের পাশাপাশি বাংলাদেশেরও এই বিলিয়ন ডলারের কোম্পানির অন্যতম শীর্ষ সোর্সিং হাব হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, 'তবে রাশিয়ায় বাংলাদেশি রপ্তানির ওপর চড়া শুল্ক প্রবৃদ্ধির পথে বড় বাধা। শুল্ক নির্ধারণ করা হয় পোশাকপণ্যের ওজনের ভিত্তিতে। এতে পণ্য উৎপাদন, পরিবহন, শুল্ক-করসহ মোট অনেক খরচ বেড়ে যায়।
'২০১৮ সাল থেকে রাশিয়ায় বাংলাদেশের নিটওয়্যার রপ্তানিতে ১২-১৩ শতাংশ শুল্ক, ডেনিম পণ্যে ৩০ শতাংশ শুল্ক এবং জ্যাকেটে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। অন্যদিকে ভিয়েতনাম রাশিয়ায় শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করছে, যা দেশটিকে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রেখেছে।'
শুল্ক আরোপের আগে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি ভিয়েতনামকে ছাড়িয়ে গিয়ে বার্ষিক ৮০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। কিন্তু শুল্কারোপের পর বাংলাদেশের রপ্তানি কমে ৩০ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অন্যদিকে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে ভিয়েতনাম আরও এগিয়ে গেছে।
মঈন বলেন, 'প্রতিটি পণ্য ৩০ থেকে ৪০ সেন্ট কম দামে দেওয়ার পরও চড়া খরচের কারণে আমরা ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছি না।'
রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) বা শুল্কছাড়ের বিষয়ে আলোচনা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মঈন বলেন, 'বাংলাদেশ যদি এফটিএ স্বাক্ষর বা শুল্ক প্রত্যাহার করতে পারে, তাহলে অর্ডারের পরিমাণ অনেক বাড়বে।'
মইন আরও বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বা শ্রমিক অসন্তোষ পরিস্থিতির মতো স্থানীয় চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিচলিত নয় গ্লোরিয়া জিন্স। কারণ, বাংলাদেশের অভিযোজন ক্ষমতা এবং সময়মতো শিপমেন্ট সরবরাহের দক্ষতার আস্থা আছে কোম্পানিটির।
'বাংলাদেশি সরবরাহকারী এবং স্থানীয় অফিসের প্রতি আমাদের আত্মবিশ্বাস অটুট আছে,' বলেন তিনি।
রাশিয়াজুড়ে গ্লোরিয়া জিন্সের শক্তিশালী উপস্থিতি
রাশিয়ার বৃহত্তম ফ্যাশন রিটেইলার গ্লোরিয়া জিন্স ৩০০টিরও বেশি শহরে ৭০০-র বেশি স্টোর পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটি প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের জন্য পোশাক, জুতা ও অ্যাকসেসরিজ সরবরাহ করে।
কোম্পানিটির ডিজাইন ও উৎপাদন কেন্দ্রগুলো এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে অবস্থিত।
মধ্যপ্রাচ্যে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা চলমান থাকলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নে স্টোর খোলার পরিকল্পনা করোনা মহামারির কারণে স্থগিত হয়ে যায়।
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও জারা, গ্যাপ ও এইচঅ্যান্ডএম-এর মতো প্রতিযোগীরা বাজার ছাড়ার পর গ্লোরিয়া জিন্স সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। মূলত ফাস্ট ফ্যাশন পণ্য উৎপাদনকারী ব্র্যান্ডগুলোর খালি হওয়া স্টোর ও সাইনেজ অধিগ্রহণের মাধ্যমে গ্লোরিয়া জিন্স তাদের বাজার উপস্থিতি আরও শক্তিশালী করেছে।
বৈশ্বিক পোশাক সোর্সিংয়ে গ্লোরিয়া জিন্সের ফ্রি অন বোর্ড (এফওবি) মূল্য প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার, আর খুচরা মূল্য আরও বেশি।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে রাশিয়া ৭.৮৩ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩২২.২৪ মিলিয়ন ডলার।
রুশ সংবাদমাধ্যম কোমেরসান্ত-এর বরাত দিয়ে ইউক্রেনের সংবাদমাধ্যম উক্রাইন্সকা প্রাভদা বলেছে, গ্লোরিয়া জিন্স রাশিয়ার রোস্তভ অঞ্চলে তাদের উৎপাদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।
সালস্ক শহরের একটি সেলাই কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ কারখানার কর্মীদের অন্যান্য স্থানে কাজের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
গ্লোরিয়া জিন্স এখন রাশিয়ায় ১৮টি কারখানা পরিচালনা করছে এবং ভিয়েতনাম ও চীনে উৎপাদন বিকল্প খুঁজছে।