রেমিট্যান্স বেড়েছে ২২ শতাংশ, ২০২৪ সালে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার আসবে
২০২৪ সালে সালে ডলারের অফিসিয়াল রেট ৯ শতাংশ বেড়ে যাওয়া এবং বছরের শেষ পাঁচ মাসে অর্থ পাচার কমে যাওয়ায় প্রায় চলতি বছর বাংলাদেশ প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে বৈধ বা আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে ২৬.৬৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের পুরো বছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২১.৯২ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে গত বছরের চেয়ে ২০২৪ সালে রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ৪.৭ বিলিয়ন ডলার।
২০২৪ সালের রেমিট্যান্স প্রবাহ কেমন ছিল, তা বুঝতে শুধু একটি তথ্যের দিকে চোখ রাখলেই চলে। গত বছর যেখানে মাত্র দুই মাস মাসিক রেমিট্যান্স প্রবাহ ২ বিলিয়ন ডলার পার করেছিল, সেখানে চলতি বছর জুলাই মাস বাদে বাকি ১১ মাসই ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পেয়েছে বাংলাদেশ। জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেরে ইন্টারনেট ও ব্যাংক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এবং প্রবাসীরা আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গিয়েছিল।
সর্বশেষ চলতি মাসে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ২.৪২ বিলিয়ন ডলার, যা এরইমধ্যে ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পাওয়া মাসের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ২.৫৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল করোনা মহামারিকালে ২০২০ সালের জুলাইয়ে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, আইএমএফ-এর বিপিএম৬ ফর্মুলা অনুসারে গতকাল (২৯ ডিসেম্বর) দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২১.৩৩ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গত কয়েকমাসে টাকা পাচারের পরিমাণ কমায় হুন্ডির চাহিদাও কমে এসেছে। ফলে যেসব রেমিট্যান্স হুন্ডি চ্যানেলে আসত, তার একটা বড় অংশ ফরমাল চ্যানেলে আসছে।
এছাড়া ডলারের অফিশিয়াল রেট বেড়ে যাওয়া এবং চাহিদা কমায় আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে ডলারের রেটের পার্থক্য ১ টাকার কাছাকাছি চলে এসেছে।
হুসনে আরা শিখা বলেন, 'সবমিলিয়ে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধিকে আমরা ভালো বলব। একইসঙ্গে আগামী বছর আরও ভালো ইনফ্লো আশা করছি।'
ডলার রেট ও হুন্ডির চাহিদায় পতন: রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির মূল কারিগর
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা টিবিএসকে বলেন, রেমিট্যান্সের বাজার সবসময়ই 'রেট সেন্সিটিভ'। যখন ডলারের দর বেড়ে যায়, তখন রেমিট্যান্সের প্রবাহও বাড়ে।
বিষয়টি বুঝতে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসটিকে আদর্শ হিসেবে ধরা যায়। ওই মাসে বেশি রেট দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ না করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে বেশি রেটে রেমিট্যান্সের ডলার কেনায় অন্তত ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানদের শাস্তি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর জের ধরে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স আসে মাত্র ১.৩৩ বিলিয়ন ডলার।
তবে ২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ডলারের রেট বাড়ানো হয়, ব্যাংকগুলোকে বেশি দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করায় তেমন চাপাচাপি করা হয়নি। যার ফল দেশ দেখতে পাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারির শুরুর দিকে ডলারের অফিসিয়াল রেট ছিল ১১০ টাকা। পরে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য করা মুদ্রানীতিতে একদিনের ব্যবধানে ইতিহাসে বাংলাদেশি মুদ্রার সবচেয়ে বড় অবমূল্যায়ন করে ডলারের বিপরীতে ৭ টাকা দাম কমায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তখন বিনিময় হারে ক্রলিং পেগ মিড রেট হিসেবে ১১৭ টাকাকে ভিত্তি রেখে ডলার কেনাবেচা করতে বলা হয়েছিল ব্যাংকগুলোকে। এর সঙ্গে সর্বোচ্চ ১ টাকা যোগ করে ডলারের রেট সর্বোচ্চ ১১৮ টাকা করার মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিনিময় হার বাড়িয়ে ১২০ টাকা করা হয়। অবশ্য ডিসেম্বরে ডলারের রেট বেড়ে ১২৮ টাকা পর্যন্ত চলে গেলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশনায় ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ ১২৩ টাকা রেটে লেনদেন করতে বলা হয়। অর্থাৎ ডলারের দর বেড়েছে অন্তত ১০ টাকা বা ৯ শতাংশ।
ডলারের রেটের এই ক্রমবর্ধমান ধারা রেমিট্যান্স বাড়াতে সহায়তা করেছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন টিবিএসকে বলেন, রেমিট্যান্স বাড়ার পেছনে ডলারের রেটই মূল ভূমিকা পালন করে। যে কারণে ডলারের দর বেড়ে গেলে রেমিট্যান্সের প্রবাহও বেড়ে যায়।
এর বাইরে আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর হুন্ডির চাহিদাও কিছুটা কমে এসেছে। তবে এটা সাময়িক। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত থাকায় দীর্ঘমেয়াদে হুন্ডির চাহিদা কমানো কঠিন বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।
রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বাড়াতে গেলে রেমিট্যান্স প্রেরকদের ডলারের ভালো রেট দেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'আমাদের রেমিটারদের অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব প্রবাসী ভাই-বোনেরা দেশে ফেরেন, তাদেরকে স্বল্প দূরত্বে বা বাস টার্মিনাল পর্যন্ত যাতায়াতের ব্যবস্থা করাসহ অনেক পদক্ষেপই নেওয়া যেতে পারে।
'এই স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা গেলে তারা ফরমাল চ্যানেলে আরও বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হবেন।'