রাশিয়ানরা ঈশ্বরদীকে যেভাবে বদলে দিচ্ছে
২৭ নভেম্বর, সন্ধ্যা। পাবনার ঈশ্বরদীর নতুন হাট এলাকায় গ্রিন সিটি ভবনের সামনে রাস্তার পাশে অস্থায়ী সবজি দোকান নিয়ে বসে আছেন ৩২ বছর বয়সী লিটন হোসেন।
খানিক বাদেই শর্টস আর টি-শার্ট পরা দুজন রাশিয়ান এসে হাজির তার দোকানে। ক্রেতাদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন লিটন। তাদের উদ্দেশে বললেন, 'প্রিভেত'। উত্তরে রাশিয়ান দুজনও বললেন, 'প্রিভেত'। 'হাই', 'হ্যালো'র অনানুষ্ঠানিক রাশিয়ান রূপ হলো প্রিভেত।
শুধু প্রিভেত নয়, বিদেশিদের সঙ্গে সহজে আলাপ করার জন্য গত তিন বছরে লিটন আরও অনেকগুলো রুশ শব্দ শিখেছেন। শিখেছেন সবজির রাশান নাম, রুশ সংখ্যাও বলতে শিখেছেন।
ব্যবসার খাতিরেই নতুন ভাষা শিক্ষা:
নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা লিটন জানালেন, শুরুতে ক্যালকুলেটরে টাইপ করে দাম দেখাতে হতো রাশিয়ানদের। ছাত্রজীবনে ইংরেজিতেও খুব একটা ভালো ছিলেন না বলে শুরুতে বেশ সমস্যায় পড়েছেন লিটন। তবে এখন অনুশীলনের জোরে রুশ ভাষায় শাকসবজির নাম ও দাম বলতে পারেন।
ঈশ্বরদীতে লিটনের মতো এরকম আরও শতাধিক দোকানদার ও বিক্রেতা আছেন। রাশিয়ান ক্রেতাদের মুখ থেকে শুনে শুনে তারা কাজ চালানোর মতো রুশ ভাষা শিখে নিয়েছেন।
দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের নির্মাণকাজের সঙ্গে কমবেশি পাঁচ হাজারে রাশিয়ান নির্মাণ শ্রমিক ও প্রকৌশলী যুক্ত। এই রাশিয়ানদের সুবাদে স্থানীয় লোকজনের সামনে রুশ ভাষা ও জীবনধারার এক নতুন জানালা খুলে গেছে। সেইসঙ্গে ছোট শহর ঈশ্বরদীতে ব্যবসার বিকাশ ঘটছে।
আর এ কারণে ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কাজ চালানোর মতো রুশ শব্দ শিখে নিয়েছেন লিটন।
লিটন বলেন, 'আমি কখনও কল্পনাও করিনি যে একদিন এখানে রাশিয়ার লোক দেখব, তাদের ভাষা শিখব।'
লিটন জানালেন, রুশ ভাষা শেখার বড় সুবিধা হলো, গ্রাহকরা যা চান, তা সহজেই দিতে পারেন।
তিনি বলেন, 'আমি আমার ফোনে ইউটিউবে ভিডিও দেখেও ভাষাটা শিখেছি। এখন পর্যন্ত আমি রুশ ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত গুনতে পারি।'
শুধু লিটনই নন, তার ৮ বছরের ছেলে লাবিবও বেশ অনেকগুলো রুশ শব্দ শিখে ফেলেছে। সে টপাটপ বলে দিল 'লুক' মানে পেঁয়াজ, 'সেকলা' মানে বিট।
নতুন হাটের পোশাকের দোকানের বিক্রয়কর্মী মেহেদী হাসান জানালেন, তিনি রাশিয়ানদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভাষাটি শিখে ফেলেছেন। রাশিয়ানদের বলার ধরন দেখে দেখে তিনি ভাষাটি শিখে নেন। মেহেদী মাত্র তিন মাসে রুশ ভাষা আয়ত্ত করে নিয়েছেন।
মেহেদী বলেন, 'আমরা এখনও এতটা সাবলীল নই, কিন্তু ক্রেতাদের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মতো যথেষ্ট ভাষা আমরা জানি।
যেমন, কোনো পণ্য পছন্দ হলে ওরা বলে, "স্কোলকো?" এর অর্থ "কত?" আমরা তখন ওদের ভাষায় দাম বলি। যেমন "দ্ভেস্তি" মানে "দুইশ", "ত্রিস্তা" মানে "তিনশ"।'
মেহেদী আরও জানালেন, রাশিয়ানরা প্রথমে পণ্য পছন্দ করে, তারপর লেবেল পরখ করে দেখে। ইতালিয়ান ও ভিয়েতনামী পণ্য তাদের বেশি পছন্দ বলে জানালেন হাসান।
'তবে রাশিয়ানরা বাংলাদেশি পণ্যও খুব পছন্দ করে, যদিও চীনা পণ্য খুব একটা পছন্দ করে না। ওদের আমি জিজ্ঞেস করেছি, কেন। কিন্তু ওরা কখনও কারণটা বলে না,' যোগ করেন মেহেদী।
রুশ ভাষা শেখার ও বলার প্রবণতা কেবল তরুণ প্রজন্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এলাকার প্রবীণরাও ব্যবসার সুবিধার জন্য ভাষাটি শিখে নিয়েছেন।
ঈশ্বরদী বাজারে 'জেনসিম' নামে একটি সুপারস্টোর চালান ষাট বছর বয়সি ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম। পোশাক ও জুতা বিক্রি হয় তার দোকানে। ষাট বছর বয়সি নজরুলও রাশিয়ানদের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধার্থে রুশ ভাষা শিখেছেন।
নজরুল বলেন, 'আমি আমার সেলসম্যানদের কাছ থেকে ভাষা শিখেছি। রাশিয়ানদের সঙ্গে ব্যবসা করতে চাইলে তাদের ভাষা শিখতে হবে। এতে রাশিয়ানরা তাদের পছন্দের পণ্য নিয়ে সহজে কথা বলতে পারে।'
রাশিয়ান ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ঈশ্বরদীর অনে রেস্তোরাঁ, ক্যাফেসহ অনেক দোকানে রুশ ভাষায় সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়েছে। তবে রাশিয়ানরা জানিয়েছে, সাইনবোর্ডের লেখাগুলো গুগল ট্রান্সলেটের সাহায্যে অনুবাদ করা হয়েছে। এ কারণে কিছু শব্দের অনুবাদ ঠিক হয়নি।
'বাংলাদেশকে ভালোবেসে ফেলেছি':
গ্রিন সিটির সামনে দেখা হলো অ্যালেক্স নামের লম্বা রাশিয়ান যুবকের সঙ্গে। একটি ফ্যাশন আউটলেটের সামনে হাঁটাহাঁটি করছিলেন তিনি। অ্যালেক্সের জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাশিয়ার রাজধানী মস্কো থেকে প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার দূরের এক সাইবেরিয়ান শহরে। একদিন বাংলাদেশে আসবেন, তা কখনও কল্পনাও করেননি অ্যালেক্স। ছয় মাস আগে বাংলাদেশে এসেছেন এই যুবক। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের প্রেমে পড়ে গেছেন তিনি।
ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে অ্যালেক্স জানালেন, 'দেশটিকে, বিশেষ করে এই দেশের মানুষকে আমি ভালোবাসি। তারা খুব ভালো।'
বাংলাদেশি আম অ্যালেক্সের সবচেয়ে পছন্দ। ঈশ্বরদীতে তার সবচেয়ে অপছন্দের জিনিস হলো রাস্তার ময়লা-আবর্জনা ও জরাজীর্ণ রাস্তা। স্ত্রীর কথাও খুব মনে পড়ে তার।
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে আমি আমার স্ত্রীকে সবচেয়ে বেশি মিস করি, যদিও প্রতিদিন ওর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ আর মেসেঞ্জারে যোগাযোগ হয়। আমি এখানে এসেছি টাকা কামাতে।'
মোটা দাগে রাশিয়ান বলা হলেও, পূর্ব ইউরোপ এবং ইউক্রেন ও বেলারুশসহ মধ্য-এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে আসা লোকজনও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে কাজ করছে। ২০১৫ সাল থেকে এখানে বসবাস শুরু করেছে তারা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে রাশিয়ান ও ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের লোকজনের সংখ্যা।
রাশিয়ানদের আবাসনের জন্য ১৯তলা ১৪টি ভবন নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ সরকার। নির্মাণ কাজ চলছে আরও পাঁচটি ভবনের। ঈশ্বরদী বাজার এলাকায় একটু ঘুরলেই চোখে পড়বে কেনাকাটায় ব্যস্ত রুশ নাগরিকদের। তারা ভিড় করছেন রেস্তোরাঁয়, নাহয় মুদি পণ্যের দোকানে।
গ্রিন সিটির এলাকাতেও রয়েছে নিত্যপণ্যের কিছু দোকান। কিন্তু, সেখানে দাম বেশ চড়া। তাই মুদিপণ্য হোক বা খাদ্য ও কাপড়; গ্রিন সিটি কম্পাউন্ডের বাইরেই কেনাকাটায় স্বাচ্ছন্দ্য রুশদের।
তাছাড়া, ঈশ্বরদীর বাজারগুলোয় পণ্যের দাম যেমন তুলনামূলক কম, তেমনি পণ্য সমাহারও বেশি। গ্রিন সিটির আবাসিক এলাকা থেকে ১৫ মিনিট দূরেই নিকটবর্তী শহরটি।
আবার কিছু ব্যবসায়ী এ হাউজিং কমপ্লেক্সের গেইটের কাছাকাছি দোকান খুলেছেন।
নতুন কিছু কোম্পানি গ্রিন সিটির এলাকায় দোকান খোলা শুরু করেছে। গত আগস্টে দেশীয় রিটেইল চেইনশপ 'স্বপ্ন' নতুন হাট এলাকায় তাদের একটি আউটলেট চালু করে।
রুশ নাগরিকদের জীবনযাত্রাও এলাকাবাসীর কৌতূহলের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাদের দেখতে আশেপাশের এলাকা থেকে অনেকেই আসছেন। আর গ্রিন সিটির বাইরেও রুশ নাগরিকদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতই।
গত ২৮ নভেম্বর বিকেলে বেলারুশের নাগরিক এলিজাবেথ, তার স্বামী ও এক নারী সহকর্মীর সাথে আলাপের সুযোগ হয় এ প্রতিবেদকের।
গ্রিন সিটির স্যামনেই এক রেস্তোরাঁয় বসেছিলেন তারা। গল্প আর হাসিঠাট্টায় মশগুল, নেপথ্যে বাজছিল জনপ্রিয় রুশ গায়ক ইসলাম ইতলাসেভের গান।
দীর্ঘদিন এখানে কাজ করলেও এলিজাবেথ বেলারুশে ফেলে আসা সন্তানকে খুব 'মিস' করছেন বলে জানালেন।
নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ প্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ শৌকত আকবর জানান, '২০২৫ সালে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের হাতে আসার পরও পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অনেক রাশিয়ান এখানেই থাকবেন।'
ঈশ্বরদীতে চাঙ্গা ব্যবসা-বাণিজ্য:
ছোট্ট শহর ঈশ্বরদী। রাশিয়ানরা আসায় এ অঞ্চলে ব্যবসা এখন চাঙ্গা। স্থানীয় উদ্যোক্তারা খুলছেন নিত্যনতুন ক্যাফে ও রেস্তোরাঁ। খাবার মেন্যুতে বিদেশিদের পছন্দই প্রাধান্য পাচ্ছে। গ্রিন সিটির আশেপাশের ক্যাফেটেরিয়াগুলো সম্পূর্ণভাবেই রাশিয়ানদের খাদ্যরুচি মাথায় রেখে গড়ে উঠেছে।
গ্রিন সিটির পাশে এমন পাঁচটি দামি রেস্তোরাঁ ও ক্যাফেতে স্যুপ, সালাদ ছাড়াও গ্রিল, নান ও বিরিয়ানির মতো খাবারের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ পান রুশ ভোক্তারা। উপজেলা সদরেও তাদের লক্ষ্য করে গড়ে উঠেছে আধুনিক রেস্তোরাঁ।
পোশাকের চাহিদা পূরণে চালু হয়েছে বেশকিছু দামি কাপড়ের দোকান। গ্রিন সিটি এলাকা ছাড়াও ঈশ্বরদী বাজারে খুলেছে বেশকিছু সুপারস্টোর।
গ্রিন সিটি এলাকায় সবজি বিক্রেতাদের পণ্যেও এসেছে পরিবর্তন। সবজি বিক্রেতা লিটন জানান, রাশিয়ানরা লাউ পছন্দ না করায় তার কাছেও এই সবজি নেই। সে তুলনায় বেশি চাহিদা ড্রাগন ফ্রুটের। অথচ কয়েক বছর আগেই পদ্মাতীরের এ শহরে তেমন প্রচলন ছিল না বিদেশি এ ফলটির।
তবে স্থানীয়রা বলছেন, রাশিয়ানদের কারণে নিত্যপণ্য ও সেবার মূল্য মারাত্মক বেড়ে যাওয়ায় তারা সমস্যার মধ্যে পড়েছেন।
যেমন চুল কাটা বা ম্যাসাজের জন্য রুশ নাগরিকরা ২০০-৩০০ টাকা দেন। স্থানীয়দের আগে ৬০ টাকা দিলেই হতো।
নতুন হাট এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, 'মাছের বাজারে গেলেই দেখবেন তারা বেশি দাম দিয়ে হলেও বড় মাছ কিনছে। ফলে কিছু মাছ চলে গেছে স্থানীয়দের ধরাছোঁয়ার বাইরে।'
কম দামে বাজার সদাই করতে বাধ্য হয়েই আশেপাশের এলাকায় যেতে হচ্ছে স্থানীয়দের।
ঈশ্বরদী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের একটি পোশাক কারখানার কর্মী সুজন জানান, 'এক কেজি বেগুন কিনতে গেলে এখন ৫০ টাকা দিতে হয়। দাম ঢাকার প্রায় সমান! অথচ মানুষ এলাকায় বেগুন ফলায়, একারণে দাম ৩০ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।'
রাশিয়ানরা আসার আগে কেবল ফুটবল বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া দেশ হিসেবেই রাশিয়ার নাম টেলিভিশন মারফত জেনেছিলেন সবজি বিক্রেতা লিটন। এর চেয়ে বেশি কিছুই জানা ছিল না দেশটি সম্পর্কে।
তিনি বলেন, 'এখন আমি রাশিয়ান ক্রেতাদের সাথে দরদাম করতে পারি। মাঝেমধ্যে রুশ ভাষায় কথা বলা, বাংলার চেয়েও সহজ মনে হয়।'