প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে বিজিএমইএ এখন কারেন্সি ডিভ্যালুয়েশন চায়
দেশে করোনা সংক্রমণের পর গত প্রায় দুই বছরে বিনাসুদে শ্রমিকদের বেতন-ভাতার অর্থ দেওয়াসহ তৈরি পোশাকখাতের অন্তত ১৭টি দাবি পূরণ করেছে সরকার, মুলতবি রয়েছে আরও প্রায় ডজনখানেক দাবি। এ অবস্থার মধ্যেই নতুন নতুন আরও দাবি নিয়ে সরকারের কাছে হাজির হচ্ছেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নেতারা।
সর্বশেষ ১৩ জানুয়ারি প্রতিযোগি দেশগুলোর কারেন্সি ডিভ্যালুয়েশনের তথ্য তুলে ধরে বাংলাদেশি টাকার মান আরও কমিয়ে তৈরি পোশাক খাতের 'ব্রেথিং স্পেস' বাড়ানোর অনুরোধ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান। যদিও প্রতিযোগি চীন ও ভিয়েতনামের মুদ্রার মানের তুলনায় ডলারের বিপরীতে টাকার মান অনেক বেশি কমেছে।
এ বছরের জানুয়ারী পর্যন্ত বিগত চার বছরে বাংলাদেশি টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩.৮৪%, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে যার অর্থ, ডলারপ্রতি বিনিময় হার ৮২.৪২ টাকা থেকে বেড়ে ৮৬.০০ টাকা হয়েছে।
চিঠিতে দেওয়া বিজিএমইএ'র তথ্য অনুযায়ী, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের মুদ্রার মানের তুলনায় গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশি মুদ্রার মান বেশ কমেছে। আর ডলারের বিপরীতে চীনের মুদ্রার মান বেড়েছে। তবে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও তুরস্কের মুদ্রার মান বেশি অবনমন হয়েছে।
চিঠিতে বিজিএমইএ সভাপতি আরও উল্লেখ করেছেন, ২০২২ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত বিগত পাঁচ বছরে তুর্কি লিরার সর্বোচ্চ ২৬৫.৭৪% অবমূল্যায়ন হয়েছে, তারপরেই ৫৯.৬০% নিয়ে আছে পাকিস্তানি রুপি।
অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কান রুপি, ভারতীয় রুপি এবং ভিয়েতনামের ডং যথাক্রমে ৩২.২৪%, ১৬.১৮% এবং ০.২৮% অবমূল্যায়িত হয়েছে। অথচ এই সময়ের মধ্যে, চীনা ইউয়ান সামষ্টিকভাবে ডলারের বিপরীতে ০.৯৮% বৃদ্ধি নিয়ে স্থিতিশীলই ছিল।
বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের কারেন্সিকে অনেক ডিভ্যালু করেছে, কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই আমরা একই জায়গায় রয়ে গেছি। সম্প্রতি কিছুটা ডিভ্যালু করার পরও আমরা মাত্র ডলার প্রতি ৮৫ টাকা পাই, অথচ ওপেন মার্কেটে তা ৯০ থেকে ৯১ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এত গ্যাপ থাকা উচিত নয়।"
"এতে রপ্তানির পাশাপাশি ওয়েজ আর্নাররাও আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। যৌক্তিকহারে কারেন্সি ডিভ্যালু করা হলে রপ্তানির পাশাপাশি ওয়েজ আর্নাররা উপকৃত হবে এবং সরকারের রাজস্বেও (রপ্তানির বিপরীতের আয়কর) ইতিবাচক প্রভাব পড়বে", বলেন তিনি।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, "তৈরি পোশাকের দাম না বাড়লে কাঁচামাল আমদানি ও ফ্রেইট কস্ট বাড়ার কারণে রপ্তানি অনেক বাড়লেও কোন মুনাফা হচ্ছে না। অনেকেই লোকসানে পণ্য রপ্তানি করছে। ডলারের দাম অন্তত ৯০ টাকা নির্ধারণ করা হলে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে।"
অবশ্য বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের প্রায় এক বছর আগে, ২০১৯ সালের মে মাসে প্রতি ডলার রপ্তানি আয়ের উপর ৫ টাকা হারে ভর্তুকি দাবি করেছিলেন বস্ত্র ও তৈরি পোশাকখাতের মালিকরা। সেটাও কার্যকর হয়নি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা টাকার মান কমানোর পক্ষে নয়। তারা বলছেন, মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে আমদানি পণ্যের দাম বাড়বে এবং তা কস্ট অব পুশ ইনফ্লেশন তৈরি করবে। রুল অব থাম্ব অনুযায়ী, কোন মুদ্রার ১০% অবমূল্যায়ন হলে পণ্যের দামস্তর ২-৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত সপ্তাহেই সাংবাদিকদের বলেছেন, ডলারের বিপরীতে টাকার মানে এখনকার তুলনায় খুব বেশি হেরফের হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও টাকার মান না কমানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি বলেন, পোশাকখাত যে পরিমাণ রপ্তানি করে, তার একাংশই আমদানি করে। তাই টাকার মান কমালে রপ্তানি থেকে দেশের অর্থনীতি কতোটা লাভবান হবে, সেটি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ আমদানি নির্ভর, তাই টাকার মান কমালে নন-রপ্তানিমুখী শিল্পখাতগুলোর কাঁচামাল আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে; খাদ্যপণ্য, পাওয়ার, এনার্জি- সবকিছুর মূল্যেই প্রভাব পড়বে।
অবশ্য কারেন্সি ডিভ্যালুয়েশনের দাবির সঙ্গে দ্বিমতও রয়েছে কোন কোন উদ্যোক্তার। পোশাক খাতের একজন শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, মাস্টার এলসির বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক এলসির ঋণ পরিশোধ হয় ডলারে। যার ফলে রপ্তানি মূল্যের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ডলার ব্যয় হয় কাঁচামাল আমদানিতে। বাকি সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ রিটেনশন ভ্যালুর ক্ষেত্রে ডিভ্যালুর সুবিধা পাওয়া যাবে। কিন্তু বায়াররা অর্ডার নেগোশিয়েট করার সময় এক্সচেঞ্জ রেটকে হিসাবের মধ্যে ধরে, ওই পরিমাণ মূল্য কমিয়ে দেয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। অর্থাৎ কারেন্সি ডিভ্যালুয়েশনের সুবিধা ক্রেতাদের পকেটেই চলে যায়।
তিনি বলেন, টাকার মান কমানোর চেয়ে আমাদের প্রাপ্য ডলার বা রিটেনশন ভ্যালু বিক্রির ক্ষেত্রে বিদ্যমান শর্ত শিথিল করে বাজার দরে বিক্রির সুযোগ দিলে রপ্তানিকারকরা উপকৃত হবেন।
বর্তমানে রপ্তানি অর্ডারের অনেক বেশি চাপ থাকায় কারেন্সি ডিভ্যালুয়েশনের সুবিধা বিদেশি বায়াররা নিতে পারবে না বলে জানান ফারুক হাসান।
যেসব দাবি মুলতবি
২০২০ এর মার্চে দেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর বিজিএমইএর দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার আগে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ৩ মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য সুদমুক্ত ৫০০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেন। ২% সার্ভিস চার্জের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ওই তহবিল দুই বছর মেয়াদে ঋণ দেয় সরকার, যার প্রথম ৬ মাস গ্রেস পিরিয়ড। পরবর্তী ১৮ মাসে সমান কিস্তিতে এই ঋণ ফেরত দেওয়ার কথা ছিল।
তিন মাসের মাথায় বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর দাবির প্রেক্ষিতে এ তহবিলের আকার বাড়িয়ে ১০৫০০ কোটি টাকা করে সরকার। তিন মাসের বদলে শ্রমিকদের চার মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয় এই তহবিল থেকে। এরপরই ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়াতে আবেদন করে সংগঠন দুটি। তাদের আবেদনে একদফায় ৬ মাস মেয়াদ বাড়ায় অর্থ মন্ত্রণালয়। বিনাসুদের ওই ঋণ পরিশোধের জন্য এখন আরও ১৮ মাস বাড়তি সময় চাচ্ছেন রপ্তানিকারকরা।
অর্থ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গার্মেন্টস মালিকরা ঠিকমতোই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছিল। একদফা সময় বাড়ানোর পর থেকেই তাদের মধ্যে ঋণ পরিশোধের অনীহা দেখা দিয়েছে। বাড়তি সময় পাওয়ার জন্য গত সপ্তাহে অর্থ সচিবের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন পোশাকখাতের মালিকরা।
"গতবছরও সময় বাড়ানোর ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সম্মতি ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ৬ মাস বাড়ানো হয়েছিল। এবারও মন্ত্রণালয় সময় বাড়ানোর পক্ষে নয়। তাছাড়া, এসব প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের সঙ্গে ব্যাংকগুলোরও সম্পৃক্ততা রয়েছে। এখন রপ্তানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে"', যোগ করেন তিনি।
গত সেপ্টেম্বর মাসে অর্থবিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদারকে পাঠানো এক চিঠিতে বিজিএমইএ সভাপতি পোশাকখাতের মালিকদের নেওয়া বিভিন্ন ঋণের উপর আরোপিত-অনারোপিত সুদ ও কস্ট অব ফান্ডসহ সব ধরণের চার্জ মওকুফ করার দাবি জানান।
মওকুফের পরে যে ঋণ থাকবে, তা ২০২২ এর জানুয়ারি ভিত্তিক স্থিতির উপর ২% হারে ডাউনপেমেন্ট গ্রহণ করে দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছর মেয়াদে ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা চান, যা এখনও পেন্ডিং রয়েছে।
বর্তমানে রপ্তানির বিপরীতে সরকারের দেওয়া নগদ প্রণোদনা পেতে হলে স্থানীয়ভাবে ৩০% ভ্যালু এডিশনের শর্ত রয়েছে, গত অক্টোবরে এক চিঠিতে তা কমিয়ে ২০% করার দাবি করেছে বিজিএমইএ।
এছাড়া, অ্যামাজন, ইবে, আলিবাবার মতো ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস গড়ে তুলতে সরকারের কাছে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছিল বিজিএমইএ, যা এখনও পায়নি। পোশাকখাতের শ্রমিকদের হাউজিং, ট্রান্সপোর্ট ও তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য ২০০ কোটি টাকার তহবিল চেয়েও মেলেনি।
ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য ৫০০ কোটি টাকা ও পোশাকখাতের রিসার্চ এন্ড ডিজাইন ডেভেলপমেন্টের জন্য ১০০% ভর্তুকি, উৎস কর ০.৫০% থেকে কমিয়ে ০.২৫% নির্ধারণের দাবি করেও সফল হননি পোশাক রপ্তানিকারকরা।
যেসব সুবিধা পেয়েছেন পোশাকখাতে রপ্তানিকারকরা
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পোশাকখাতে অপচয় যেখানে কমার কথা, সেখানে বিজিএমইএ ও বিকেএমই'র দাবি মেনে সুতা থেকে কাপড় ও কাপড় থেকে পোশাক তৈরি পর্যন্ত অপচয় হার বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে।
১৯৯৮ সাল থেকে সুতা থেকে পোশাক তৈরি করা পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৬% অপচয় দেখানো যেত, যা এখন বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ২৮% নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অবশ্য এটি আরও বাড়িয়ে ৩৫% করতে পুনরায় আবেদন করেছে সংগঠন দুটি।
কোভিড মোকাবেলায় সরকার বৃহৎ শিল্প এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য যে ৬০ হাজার কোটি টাকার দুটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে তিনবছর মেয়াদে বাস্তবায়ন করছে, তার বড় সুবিধাভোগী তৈরি পোশাক শিল্প।
রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের আকার বাড়ানোর পাশাপাশি এ তহবিল থেকে নেওয়া ঋণের সুদহার ২% থেকে কমিয়ে ১.৭৫% করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট বা আপগ্রেডেশন ফান্ড নামে বাংলাদেশ ব্যাংক গঠিত ১০০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের বড় সুবিধাভোগীও তৈরি পোশাকখাত।
করোনার সময় চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি করা মালামালের বিপরীতে কন্টেইনার স্টোর রেন্ট শতভাগ মওকুফ; পিপিই, সুরক্ষা গাউন তৈরির কাঁচামাল আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা এবং প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট খাতে ৫০০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের সুবিধা পেয়েছে পোশাকখাত।