এনবিআরের কড়াকড়িতে বিপাকে সোয়েটার রপ্তানিকারকরা
বড় সমস্যায় ছোট সোয়েটার-রপ্তানিকারকরা
- ৬০টি নন-বন্ডেড সোয়েটার-প্রস্তুতকারীরা কাঁচামাল সংগ্রহের সমস্যার মুখোমুখি
- উপকরণের মধ্যে রয়েছে সুতা, প্যাকিং, শক্ত কাগজ, কাপড়ের হ্যাঙ্গার, আনুষাঙ্গিক
- দুটি কারখানা বন্ধ; ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করা অন্যান্য কারখানাও উদ্বিগ্ন
- এনবিআরের সহযোগিতা চেয়েছে বিজিএমইএ, গঠন করেছে যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি
মাত্র ২০০ জন শ্রমিক নিয়ে পশ্চিমা বাজারে সোয়েটার রপ্তানি করে আসছে নারায়ণগঞ্জের কাসপিয়ান সোয়েটার। নিজস্ব কোনো বন্ড লাইসেন্স না থাকায় তৃতীয় পক্ষ, অর্থাৎ যাদের সুতা এবং অন্যান্য কাঁচামাল আমদানি করার বন্ড আছে তাদের থেকে সেসব সংগ্রহ করতো কোম্পানিটি।
কিন্তু রপ্তানিকারক সোয়েটার প্রস্তুতকারকদের কাছে আমদানি করা পণ্য বিক্রি করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বাঁধা দেওয়ায় গত আট মাস ধরে সোয়েটার উৎপাদনে সমস্যায় পড়েছে কাসপিয়ান সোয়েটার।
কাসপিয়ানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম কামরুজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা গত কয়েক মাসে কোনোভাবে উৎপাদন ইউনিটগুলো পরিচালনা করেছি। রাজস্ব বোর্ডের নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকলে কারখানা বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।"
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস বিভাগ সম্প্রতি অনুমোদন বন্ধ করে দেওয়ায় বন্ড লাইসেন্স না থাকা রপ্তানিমুখী সোয়েটার কারখানার কাছে বন্ড লাইসেন্সধারী প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারকরা কাঁচামাল হিসেবে ইয়ার্ন ও অন্যান্য এক্সেসরিজ বিক্রি করতে পারছে না। এর ফলে বন্ড লাইসেন্স না থাকা অন্তত ৬০টি সোয়েটার কারখানার পন্য উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এভাবে চলতে থাকলে ধীরে ধীরে কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। বর্তমানে এসব কারখানায় প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করে ।
এই সমস্যায় পড়ে নারায়নগঞ্জের দুটি সোয়েটার কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন মালিকপক্ষ।
বিষয়টি নিয়ে উদ্যোক্তারা অনেক আলোচনা করলেও এতে কোন সমাধান আসেনি। বৃহস্পতিবার এনবিআর চেয়ারম্যান আমু হেনা মোঃ রহমাতুল মুনীম এর সঙ্গে এক সভায় বিষয়টি তুলে এর সমাধান চেয়েছেন বিজিএমইএ এর প্রধান ফারুক হক।
এছাড়া সভায় বিজিএমইএর পক্ষ থেকে আরো সাতটি দাবি তুলে ধরে তা দ্রুত সমাধানে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে অনুরোধ জানানো হয়।
এসব সমস্যা সমাধানে উভয় পক্ষের সমন্বয়ে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বৈঠক সূত্র জানায়।
এনবিআর ও পোশাক খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান কাস্টমস আইনে নন বন্ড কারখানার কাছে বন্ডেড প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আমদানিকৃত সুতা ও অন্যান্য এক্সেসরিজ বিক্রির সুযোগ নেই।
তবে এত বছর ধরে এ প্রক্রিয়ায় কাঁচামাল ক্রয়ের মাধ্যমে কারখানা চালু ও পন্য রপ্তানি করে আসছিলেন এসব কারখানার মালিকরা। প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারকরা বিদেশ থেকে গ্রে ইয়ার্ন এনে দেশে প্রসেস করে (ডায়িংসহ অন্যান্য প্রসেস) তা সরাসরি রপ্তানিকারকদের কাছে বিক্রি করতেন।
কিন্তু গত প্রায় আট মাস ধরে এনবিআরের কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা নন বন্ডেড প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্ড লাইসেন্সধারী প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইয়ার্ন ও অন্যান্য এক্সেসরিজ বিক্রি করলে তা অনুমোদন (ইউটিলিটি পারমিশন বা ইউপি) করছে না। ফলে ওইসব প্রতিষ্ঠান নন বন্ডেড সোয়েটার কারখানার কাছে ইয়ার্নসহ অন্যান্য কাচামাল বিক্রি করতে পারছে না।
এস এম কামরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "অতীতে আমরা এ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরণের ইয়ার্ন ও অন্যান্য এক্সেসরিজ কিনে পন্য রপ্তানি করলেও কোন সমস্যা হয়নি। গত সাত আট মাস আগে থেকে এখন আমাদের কাছ আর ব্যাক টু ব্যাক এলসিতে তা বিক্রি করছে না ইয়ার্ন আমদানিকারক ও প্রসেক করা প্রতিষ্ঠানগুলো।"
সূত্র জানায়, নারায়নগঞ্জ এলাকার এরকম অন্তত ১০টি কারখানা তাদের সমস্যার কথা ইতিমধ্যে তাদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)কে জানিয়েছে।
সুতা না কিনতে পেরে ওই এলাকার অ্যালিউর নিটওয়্যার এবং গ্রিন স্টোন সোয়েটার নামে দুটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।
এছাড়া গার্নিশ সোয়েটার লিমিটেড, নিবিড় সোয়েটার, রেফান সোয়েটার লিমিটেড, মাদার সোয়েটার, এক্সপ্লোর নিটওয়্যারের বন্ড লাইসেন্স না থাকায় তারা ব্যাক টু ব্যাক এলসিতে ইয়ার্ন কিনতে পারছে না বলে জানা গেছে।
যোগাযোগ করা হলে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশারেটের কমিশনার কাজী মোস্তাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "এই প্রক্রিয়ায় কাঁচামাল বিক্রি বিদ্যমান আইনে সমর্থন করে না। ফলে আইনগতভাবে তাদেরকে এ সুবিধা দেওয়া যায় না। তবে কারখানাগুলো যদি বন্ড লাইসেন্স নিয়ে কিনতে চায়, সেক্ষেত্রে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।"
এদিকে কারখানা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যমান কঠিন শর্ত মেনে অপেক্ষাকৃত ছোট কারখানার পক্ষে বন্ড লাইসেন্স নেওয়া সম্ভব হয় না।
এস এম কামরুজ্জামান বলেন, "বর্তমানে বন্ড লাইসেন্স নেওয়ার ক্ষেত্রে যেসব শর্ত রয়েছে, তাতে বহু কারখানা তা নিতে পারে না। এজন্য লাখ লাখ টাকা 'খরচ' করতে হয়।"
একটি কারখানা মালিকের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ওই উদ্যোক্তা গত এক বছর ধরে বন্ড লাইসেন্স নেওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন। ২০ লাখ টাকার উপরে ঘুষ দিয়েও তা পান নি তিনি।
বিকেএমইএ'র এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, "বন্ড লাইসেন্সধারী হোক না না হোক, তারা তো রপ্তানিই করছে। তাহলে কেন এসব আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে ফেলে রপ্তানিকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে?"
দেশের রপ্তানির ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে, যার পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলারের উপরে।
দেশে বর্তমানে রপ্তানিমুখী সচল পোশাক কারখানার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার, যার মধ্যে সোয়েটার কারখানা ৩ শতাধিক। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ সোয়েটার রপ্তানি করে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছে।