নতুনভাবে বড় পরিসরে তৈরি হচ্ছে দেশের প্রথম মুদ্রণ শিল্প পার্ক
মুদ্রণ ব্যবসা শুরু করার সময়টি ছিল খারাপ, বলেন নুরুল ইসলাম।
মাসিক ৫০ হাজার টাকা এবং ৩০ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে ২০২০ সালের শুরুর দিকে ঢাকার ফকিরাপুলে একটি মুদ্রণের দোকান ভাড়া নেন তিনি। এরপর মহামারি শুরু হলে মুদ্রণ ব্যবসা আরও অবনতির দিকে যেতে থাকে।
তার ১২০০ বর্গফুটের প্রিন্টিং দোকান 'মাটি ও মানুষ' বর্তমানে কোনোমতে চলার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তবে নুরুল ইসলাম বিশ্বাস করেন, দোকানটি যে জায়গায় বসানো হয়েছে সে জায়গার জন্য টাকা দেওয়ার দরকার না পড়লে এই লড়াই তিনি যথাযথভাবে চালাতে পারতেন।
পুরনো মুদ্রণ উদ্যোক্তা এবং নুরুল ইসলামের মতো নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আশার আলো হিসেবে গড়ে উঠছে একটি প্রিন্টিং শিল্প পার্ক।
পাঁচ বছর ভূমি জটিলতায় আটকে থাকার পর এবার আরও বড় পরিসরে হচ্ছে দেশের প্রথম মুদ্রণ শিল্প পার্ক। ঢাকা-দোহার সড়কের পাশে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের খারসুর মৌজায় ১০০ একর পতিত জমিতে পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)।
সেখানে ২৯৯ টিরও বেশি কারখানা স্থাপন করা যাবে। এ লক্ষ্যে মুদ্রণ শিল্প পার্ক প্রকল্প সংশোধনেরও প্রস্তাব দিয়েছে বিসিক।
এর আগে সিরাজদিখানের বড় বর্ত্তা মৌজায় ঢাকা- মাওয়া সড়কের পাশে ৪২ একর জমিতে মুদ্রণ শিল্প নগরী স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল।
বিসিকের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা ও অন্যান্য স্থানের অপরিকল্পিত মুদ্রণ কারখানাগুলোকে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের বড় মৌজায় সরিয়ে নিতে ২০১৬ সালে এ প্রকল্পের পরিকল্পনা শুরু হয়। কিন্তু একই স্থানে প্লাস্টিক শিল্প নগরী তৈরি পরিকল্পনা থাকায় সেটির জন্য ৫০ একর জমি বরাদ্দ করা হয়।
সেসময় মুদ্রণ শিল্প নগরী স্থাপনের জন্য দেওয়া হয় ৪২ একর জমি । এরপর দুই বছর পার হয়ে যায়।
২০১৮ সালে মুদ্রণ শিল্প নগরীর জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে, সেই এলাকার অধিবাসীরা সরকারি কর্মকর্তাদের লাঞ্চিত করে। সেসময় খাস জমিতে বসবারকারীদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়।
এসব কারণেই পাঁচ বছরে জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি বলে জানান বিসিকের কর্মকর্তারা।
নতুন প্রস্তাবিত জমিতে ২৫ টি বাড়ি থাকলেও পতিত জমি হওয়ার কারণে তা অধিগ্রহণে সমস্যা হবে না বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবারকে যথাযথভাবে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিসিকের কর্মকর্তারা জানান, ভূমির এ জটিলতায় বার বার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়েও কোনো অগ্রগতি হয়নি। পরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সিরাজদিখানের খারসুর মৌজায় ১০০ একর জমিতে মুদ্রণ শিল্প পার্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। আর এ কারণে প্রকল্পটি সংশোধন করা হচ্ছে।
বিসিক মুদ্রণ শিল্প পার্ক স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, "মুদ্রণ শিল্প পার্কের জন্য নতুন করে ভূমি নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন আগের চেয়ে অনেক কম মূল্যে ভূমি পাওয়া যাচ্ছে। বেশিরভাগ পাতিত জমি হওয়ার কারণে সেখানে তেমন ঘর বাড়িও নেই। এ কারণে ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা থাকবে না।"
সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে মোট ব্যয় ১৩৮.৭০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭৫.৫০ কোটি টাকার করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। দুই বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার নতুন প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
নিজাম উদ্দিন আরও বলেন, "এখন ভূমির পরিমান বেড়ে হওয়ায় প্লটের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হবে এবং প্লটের আকারও বাড়বে। তবে প্লটের প্রকৃত হিসাব জানা যাবে ভূমির মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হওয়ার পর। প্রাথমিক হিসেবে প্লটের সংখ্যা ২৯৯ টির বেশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।"
এদিকে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিসিকের কর্মকর্তারা। তারা জানান, সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদন পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ কাজ শুরু করা যাবে। এই শিল্প পার্কে দুই বছরের মধ্যে বেসরকারি মুদ্রণ শিল্পের উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করতে পারবে।
সংশোধিত প্রস্তাবে ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণে মোট ব্যয় বাড়লেও একর প্রতি ব্যয় কমেছে । প্রকল্পের মূল প্রস্তাবে প্রতি একর ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ কোটি টাকার বেশি। সংশোধিত প্রকল্পে তা এক কোটি টাকায় নেমে এসেছে। তবে জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভূমি উন্নয়ন ব্যয় সংশোধিত প্রস্তাবে ৪২ কোটি টাকা বেড়েছে।
পার্ক নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা বাড়াবে, আশা করছেন প্রিন্টাররা
প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান জনাব শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, "শুধু প্রকল্প নিলেই হবে না, দ্রুত কাজ শেষ করা জরুরি। ঢাকায় ১০০ ফিট জায়গা ভাড়া নিলে অগ্রীম দিতে হয় ৪০ লাখ টাকা। আর মাসিক ভাড়া দিতে হয় ৫০ হাজার টাকা।"
এত টাকা ভাড়া দিয়ে অনেকে ব্যবসা করতে পারছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, মুদ্রণ শিল্প পার্ক স্থাপনের কাজ দ্রুত শেষ করা দরকার।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির কর্মকর্তারা বলেন, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জায়গায় মুদ্রণ শিল্পের আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠছে।
শহীদ সেরনিয়াবাত আরও জানান, মুদ্রণ শিল্পের বর্তমান মার্কেট সাইজ ১২০০০ কোটি টাকা। শুধু ঢাকায় মুদ্রণ শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে সাড়ে ৪০০ হাজারের বেশি।
এ শিল্পে চার লাখ কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। শিল্প পার্ক হলে আরো দুই লাখ লোকের কর্মসংখ্যান বাড়বে। তৈরি পোশাক, ঔষধসহ রপ্তানিমুখী বিভিন্ন শিল্পের মুদ্রণ উপকরণ দেশিয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো যোগান দিয়ে থাকে।
"আরও বড় পরিসরে মুদ্রণ শিল্প পার্ক হচ্ছে এটা দেশের মুদ্রণ শিল্পের জন্য সুখবর। এখন আরও বেশি কারখানা স্থাপন করা যাবে। প্লটের আকারও বাড়বে। ফলে এ শিল্পে বিনিয়োগও বাড়বে," বলেন শহীদ সেরনিয়াবাত।