বাজার চাহিদা থাকলেও ঘুরেফিরে চিংড়ি, শুঁটকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ দেশের মাছ প্রক্রিয়াকরণ শিল্প
সুপারশপগুলোতে আমদানি করা 'ফরচুন টুনা' নামের একটি ক্যান বিক্রি হচ্ছে। টুনা মাছ প্রক্রিয়াজাত করে ক্যানটি তৈরি করেছে সিঙ্গাপুরের হসেন গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। মাত্র ১৩০ গ্রাম ওজনের প্রক্রিয়াজাত টুনা এদেশে আসার পর বিক্রি হচ্ছে ২৭৭ টাকায়।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা থাকার পরেও দেশে কোনো প্রতিষ্ঠানই সেভাবে মাছ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত খাবার তৈরি করছে না। চাহিদার তুলনায় মাছের উৎপাদন বেশি হলেও কেবল চিংড়িই প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে; তাও শুধু রপ্তানির জন্য।
প্যারাগন, কাজী ফার্মের মত ফ্রোজেন ফুড বা হিমায়িত খাবার উৎপাদনকারী মুষ্টিমেয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ফিশ ফিঙ্গার, ফিশ বল, ক্রিস্পি শ্রিম্প, শ্রিম্প স্প্রিং রোলের মতো যে চার-পাঁচ ধরনের পণ্য তৈরি করছে, তার উৎপাদনও খুবই কম। আর এর বাইরে প্রক্রিয়াজাত খাবার উৎপাদনের তালিকায় রয়েছে শুঁটকি মাছ।
অথচ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাছের উৎপাদন বেশি হওয়ায় স্থানীয় কৃষকরা ঠিকঠাকভাবে দাম পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় লোকসান গুনে অনেকেই মাছ চাষ ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
অন্যদিকে গবেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণে গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই। বিভিন্ন ধরনের মাছ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা বাড়ানোর বিশাল সুযোগ রয়েছে।
প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ)-এর তথ্য বলছে, চিংড়ি ও সামুদ্রিক মাছ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৭৭.৩৭ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৭ হাজার মেট্রিক টন। অন্যদিকে, এই সময়ে শুঁটকি মাছের উৎপাদন ছিল ৬২ হাজার ৫৬১ মেট্রিক টন। সবমিলিয়ে ১ লাখ ৩৯ হাজার মেট্রিক টন প্রক্রিয়াজাত মাছ উৎপাদিত হয়েছে, যেখানে দেশে মাছের উৎপাদন ছাড়িয়েছে ৪৫ লাখ টন।
বিএফএফইএ বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুমতিপ্রাপ্ত রপ্তানি নির্ভর ফিশ প্রসেসিং প্ল্যান্টের সংখ্যা ৭৭টি। প্রতিষ্ঠানগুলো হিমায়িত চিংড়ি ও সামুদ্রিক কিছু মাছ প্রক্রিয়াজাত করে- তার পুরোটাই রপ্তানি করে। তাদের পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে হিমায়িত চিংড়ি, হিমায়িত মাছ, হিমায়িত ফিললেট (কাঁটা ছাড়া মাছ), মাছের স্টেক, হাঙ্গরের খোলস ও পাখনা এবং শুঁটকি মাছ ইত্যাদি।
মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, দেশে মুরগির নানান ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাবার রয়েছে, কারণ এটি সহজে প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব। কিন্তু মাছ দিয়ে এ ধরনের পণ্য তৈরি করা অনেক ঝামেলাপূর্ণ; সেইসঙ্গে খরচও অনেক বেশি। এজন্য প্রক্রিয়াজাত করে দেশের বাজারে মাছের বাড়তি মূল্য সংযোজনে উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসছেন না।
হিমায়িত খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি প্যারাগন অ্যাগ্রো ফুড লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মশিউর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ফ্রোজেন আইটেমগুলোর মধ্যে অধিকাংশই চিকেন বেইজড। মাছের দুই, তিনটি আইটেম আমরা করছি, তবে এগুলো ব্যয়বহুল। যে কারণে চাইলেই অনেক পণ্য তৈরি করা সম্ভব হয়না।"
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণে বোনলেস মিট (কাঁটা/হাড়মুক্ত মাংস) দরকার হয়। ২০০ টাকা দামের এক কেজি পাঙ্গাস মাছ প্রক্রিয়াজাত করলে সেখান থেকে মাত্র ৩৫ শতাংশ বোনলেস, স্কিনলেস অংশ পাওয়া যায়; বাকি ৬৫ শতাংশই ফেলে দিতে হয়। এছাড়া অন্যান্য দেশের মত মাছের মাথা ও লেজসহ বিভিন্ন অংশ প্রক্রিয়া করার জন্য কোনো শিল্প বা প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে নেই। এরসঙ্গে পণ্যের খরচ, প্যাকেজিংসহ বিভিন্ন বিষয় হিসাব করলে দাম অনেক বেশি পড়ে। সেখানে মানুষ ২০০ টাকা দিয়ে পুরো মাছটাই কিনতে পারছে।
অন্যদিকে, মাছ প্রক্রিয়াকরণের প্রযুক্তিও আলাদা। প্রসেসিং প্ল্যান্ট তৈরি করতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ দরকার হবে। কিন্তু ব্রয়লার মুরগি প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে এত সমস্যা পোহাতে হয়না। প্রক্রিয়াকরণের পর মুরগির বেশিরভাগ অংশই বিক্রি করা যায় বলে সবাই এতেই বেশি আগ্রহ। পাশাপাশি প্রসেস চিকেন বা প্রক্রিয়াজাত মুরগির বাজারের সঙ্গেও মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
বিষয়টি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানান ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. একেএম নওশাদ আলম। তিনি বলেন, "বিভিন্ন দেশে ফিশ প্রসেস করে ক্যানের মধ্যে রেডি টু ইট বা রেডি টু কুক অবস্থায় বিক্রি করছে, যেগুলো স্কিনলেস ও বোনলেস। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হচ্ছে না, তার কিছু কারণ আছে।"
ক্যান বা কৌটার ভিতরে যে তেল বা সস দেয়া হয় তার সঙ্গে স্থানীয় মানুষগুলো পরিচিত নন, তারা তাজা মাছ খেয়ে অভ্যস্ত। তবে আবার বিদেশে যায় বা বিদেশ থেকে আসে এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণীর কিছু পরিবারের কাছে এটি আবার বেশ জনপ্রিয় বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, "এই ক্যানের মধ্যে বোনলেস মাছ দিতে হয়, এর উৎপাদন খরচও অনেক বেশি। যে কারণে ফুড প্রসেসর ইন্ডাস্ট্রিগুলো এতে আগ্রহ দেখায় না।"
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স ও ফিশারিজ অনুষদের অধ্যাপক ড. হোসেন জামাল বলেন, "আমাদের দেশে যারা ফুড প্রসেসিং করছে তারা টেকনোলজি এবং প্ল্যান্টে ভালো উন্নতি করেছে। তবে সেখানে শুধু চিংড়ি ও সামুদ্রিক কিছু মাছ প্রসেস করা হয়; সেগুলোও আবার সম্পূর্ণ রপ্তানির উদ্দেশ্যে। স্থানীয় বাজারের জন্য পণ্য তৈরি করতে হলেও গবেষণায় গুরুত্ব দিতে হবে। কীভাবে খরচ কমিয়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করা যায় সেটি খুঁজে বের করতে হবে।"
প্রসেসড ফিশ ফুড উৎপাদনের চেষ্টা, ইলিশের নুডুলস আনছে বসুন্ধরা:
অধ্যাপক ড. একেএম নওশাদ আলম সম্প্রতি উদ্ভাবন করেছেন ইলিশের স্যুপ ও নুডলস তৈরির প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তিটি হস্তান্তর করা হয়েছিল ময়মনসিংহের মাছ প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান ভারগো ফিশ এন্ড অ্যাগ্রো প্রসেস লিমিটেডের কাছে।
তবে প্রতিষ্ঠানটি পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করে নতুন পণ্য তৈরি করতে না পেরে পরীক্ষামূলক উৎপাদনের পর আর এগোতে পারেনি।
এ বিষয়ে এখন আগ্রহ দেখিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি নুডলস উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। জানা গেছে, দ্রুতই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে ইলিশের নুডলস ও স্যুপ তৈরিতে কাজ শুরু করবে প্রতিষ্ঠানটি।
অধ্যাপক নওশাদ আলম বলেন, "বসুন্ধরার সঙ্গে আলোচনা শেষ পর্যায়ে। এখন আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তির কাজটি বাকি আছে। এরপরই তারা পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের কাজ শুরু করবে।"
এর বাইরে সরকারিভাবেও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এখন থেকে ফিশারিজ বিভাগ যত উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করবে, সেখানে মাছ প্রক্রিয়াকরণ ও নানা ধরনের পণ্য উৎপাদনে কাজ করা হবে। সেখানে মাছ উৎপাদনকারী থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করা হবে। এর মাধ্যমে মাছ থেকে তৈরি নানাধরনের খাদ্যপণ্য তৈরিতে গতি আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস অধিদপ্তরের উপপরিচালক (অর্থ ও পরিকল্পনা) মো. আতাউর রহামান খান টিবিএসকে বলেন, "আমরা একাধিক প্রকল্প তৈরির কাজ করছি। এগুলোর কোনটিরই এখনও পর্যন্ত চূড়ান্ত ডিপিপি তৈরি হয়নি। তবে সব প্রকল্পেই ফিশের প্রডাক্ট ডাইভারসিফিকেশন নিয়ে কাজ করা হবে।"
গবেষকরা জানান, পাঙ্গাসের আচার ও পাউডার তৈরি করা হয়েছে, যেটিকে সংরক্ষিত করে আরও অন্যান্য পণ্য বানানো করা যায়। এগুলো দুধের মধ্যে মেশানো যায়। চিপস, বিস্কুট কিংবা নুডুলসের মধ্যে দিয়ে বাচ্চাদের খাওয়ানো যায়। এর মাধ্যমে শিশুদের দেহে আমিষের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। তবে, এগুলো বাজারজাতকরণ এখনও বাকি।
এছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ বড় শহরগুলোতে টোনা, কোরাল, তেলাপিয়া সহ বিভিন্ন মাছের বারবিকিউ বেশ জনপ্রিয়। এর মাধ্যমে অর্থনীতিতে মাছের অবদান যেমন বাড়ছে, তেমনি তরকারির বাইরে গিয়ে মাছ খাওয়ারও একটি অভ্যাস গড়ে উঠছে বলে জানান গবেষকরা।