বন্দরের বাইরের আমদানির জন্য কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স চায় ইইউ
বাংলাদেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি সহজ করতে আমদানিকৃত সব ধরনের বক্সসহ কার্গো সমুদ্রবন্দর এলাকার বাইরে থেকে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স দেওয়া, বন্দর থেকে অপ্রয়োজনীয় কন্টেইনার সরানো, কন্টেইনার রাউন্ড ইউজ সুবিধা চালু করার সুবিধা চেয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এক চিঠিতে ঢাকার রেল টার্মিনাল ও রিভার টার্মিনালের মধ্যে কন্টেইনার ইন্টারচেঞ্জের সুবিধাও চেয়েছে তারা।
১ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনকে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির পাঠানো চিঠি অনুসারে, বর্তমানে আমদানিকৃত মাত্র ৩৭ ধরনের পণ্য বন্দর এলাকার বাইরে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছে। বাকি সব পণ্যের কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স বন্দরের ভেতরে হচ্ছে, যা মোট আমদানির ৭৫ শতাংশ।
ইইউ বলছে, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে কয়েক হাজার খালি কন্টেইনার বছরের পর বছর ধরে অলস পরে আছে, যা বন্দরে জট সৃষ্টি করছে। আইনের কঠোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে এসব কন্টেইনার সরানোর প্রস্তাব করেছে তারা।
বর্তমানে লজিস্টিক খাতে বিদেশিরা সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশ মালিকানা পান। বিনিয়োগ বাড়াতে এ খাতে শতভাগ মালিকানা চেয়েছে ইইউ।
চার্লস হোয়াইটলি চিঠিতে বলেন, ভারত ও ভিয়েতনামসহ প্রায় সব দেশেই অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপো বা অফ-ডকে শতভাগ বিদেশি মালিকানা অনুমোদিত।
খাতটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য শতভাগ উন্মুক্ত করা যায় কি-না, সে বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) ও এনবিআর একটি সমীক্ষা করবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা।
এছাড়া, বাংলাদেশের শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিক সেক্টরে শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগ উন্মুক্ত করা, লাইসেন্সের মেয়াদ ৪ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর করা, এজেন্সি কমিশন কমানো, ইলেক্ট্রনিক ডেলিভার অর্ডার নিশ্চিত করা এবং পেপারলেস বিল অব ল্যাডিং (ব্লক চেইন) সুবিধা চালুর প্রস্তাব দিয়েছে দেশের সবচেয়ে বেশি রপ্তানি পণ্যের গন্তব্যস্থল ইউরোপের ২৭ দেশের জোট।
শিপিং এবং লজিস্টিকসে বিশ্বব্যাপী নির্ধারিত খরচ ও মডেল মেনে চলার জন্য এজেন্সি কমিশনের সংশোধন প্রস্তান করেছে ইইউ। চিঠিতে বলা হয়েছে, "যদি কোনো এজেন্ট বুক করে, তাহলে সেই এজেন্ট নেট ফ্রেইটের ৫ শতাংশ পায়। যদি কোনো প্রিন্সিপাল বুক করে, তাহলে এজেন্ট নেট ফ্রেইটের ২.৫ শতাংশ পায়। নেট ফ্রেইটের এই ওঠানামা এজেন্সি কমিশনকে প্রভাবিত করে।"
লজিস্টিক সম্পর্কিত পরিষেবাগুলোকে সুবিন্যস্ত করার আহ্বান জানিয়ে ইইউ বলে, শিপিং এবং লজিস্টিকসে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই খাতে একাধিক মন্ত্রণালয় এবং সংস্থার জড়িত থাকা। নীতি, নিয়ম, পরিকল্পনা, পরিকাঠামো পরিচালনা এবং পরিষেবা প্রদানে ভূমিকা পালন করে এসব মন্ত্রণালয়।
এর ফলে লজিস্টিক সেক্টরের এজেন্সি এবং মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় সমস্যা এবং এই সেক্টরের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়, বলা হয় চিঠিতে।
লজিস্টিক এবং পোর্ট অপারেশনের ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে সহজে ব্যবসা করার সুযোগ তোইরির জন্য ইলেকট্রিক ডেলিভারি অর্ডার, পেপারলেস বিল অফ লেডিং (ব্লকচেইন) এবং হলেজ ইকোসিস্টেম নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে ইইউ।
ভারত ইতোমধ্যে পেপারলেস কার্গো ডেলিভারি সিস্টেম শুরু করেছে। অন্যদিকে ভিয়েতনাম ইলেকট্রনিক বিল অফ লেডিং অফার করে, উল্লেখ করেছে ইইউ।
কম ডকুমেন্টের ভিত্তিতে সহজে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সিস্টেম চালু করা এবং ২ হাজার টাকার কম ইনভয়েসের পণ্য শুল্কমুক্তভাবে খালাস করার প্রস্তাবও করেছে ইইউ।
চিঠিতে চার্লস হোয়াইটলি বলেন, "ইইউ প্রতিনিধিদল ঢাকায় ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কূটনৈতিক মিশনের সাথে ২০১৬ সাল থেকে একটি ব্যবসায়িক জলবায়ু সংলাপ পরিচালনা করেছে। বাণিজ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে করা এই আলোচনার লক্ষ্য ছিল আমাদের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক উন্নত করা। ব্যবসা করার ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় তার সমাধান করা; সংক্ষেপে বাংলাদেশকে বাণিজ্যের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করাই ছিল এর লক্ষ্য।"
ইইউ মূলত তিনটি ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে: শিপিং ও লজিস্টিকস, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স এবং ট্যাক্স নীতি।
এ কে আব্দুল মোমেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগ করতে এলে বিরক্ত বোধ করেন কারণ এদেশে ব্যবসা করার জন্য তাদের ৪৩টি অনুমতি নিতে হয়।"
তিনি আরও বলেন, "এনবিআর বিনিয়োগকারীদের অনেক হয়রানি করে। সরকার একটি বললে, এনবিআর অন্যটি করে। ইইউ বাংলাদেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী, সে কারণেই আমাদের সমস্যা সমাধানের জন্য অনুরোধ করেছে।"
"বাংলাদেশের ভেতরে ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে অনেক কিছুই করণীয় আছে। সরকার ১০০টি ইকোনমিক জোন করছে, সেখানে অনেক বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু বিদেশিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে এসে দুঃখ পেয়ে ফিরে যাচ্ছে। বাংলাদেশে মোট যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রস্তাব আছে, তার ১০ শতাংশেরও কম বিনিয়োগ হয়, যুক্তরাষ্ট্রে এটি শতভাগ," যোগ করেন তিনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, "আমাদের আরবিট্রেশন অনেক স্লো। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হলো আরবিট্রেটর নিয়োগ দেওয়া, কিন্তু সেখানকার অফিসাররা এতো স্লো কাজ করেন যে বিদেশি বিনিয়োগকারীর জান চলে যাওয়ার অবস্থা হয়। ব্যবসা করতে গেলে সমস্যা আসবে, কিন্তু তা সমাধানের সহজ পথ থাকতে হবে, যা আমাদের দেশে নেই।"
"আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যোগাযোগ করে বিদেশ থেকে ভালো ভালো বিনিয়োগকারীকে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে পারি। সেসব বিনিয়োগকারীর জন্য স্বস্তির ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর। তাদের সে দায়িত্ব পালন করতে হবে," যোগ করেন তিনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, "২০১৬ সাল থেকে ইইউ-বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাইমেট ডায়ালগের মাধ্যমে একটা সুফল পাওয়া গেছে। ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও ২০২৯ সাল পর্যন্ত এভরিথিং বাট আর্মস সুবিধা এবং ২০৩৩ সাল পর্যন্ত টেকনোলজি সাপোর্ট দেওয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছে ইইউ।"
"আমরা ২০৩৮ সাল পর্যন্ত ইবিএ সুবিধা চেয়েছি, তাতে রাজী না হলে জিএসপি প্লাস সুবিধা দিতে বলেছি ইইউকে," বলেন তিনি। বিষয়টি এখনও মীমাংসিত নয় বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এ বিষয়ে এক্সপিডিটরস (বাংলাদেশ) লিমিটেডের কান্ট্রি ম্যানেজার এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এরশাদ আহমেদ টিবিএসকে বলেন, সরকার যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করছে, যেখানে অনেক শিল্প থাকবে। ফলে ভবিষ্যতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমও বাড়বে।
তিনি বলেন, "আমরা শিপিং ও লজিস্টিক খাতে মনোযোগ না দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এবং রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে পারি না।"
"সরকার অনেক অবকাঠামো নির্মাণ করছে, কিন্তু এর ব্যবস্থাপনা খুব একটা ভালো নয়। গ্লোবাল লজিস্টিক ইনডেক্সে ৫০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৫তম, যা খুবই খারাপ। অন্যদিকে ভারত, পাকিস্তান এবং ভিয়েতনাম অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে," তিনি উল্লেখ করেন।
এরশাদ বলেন, "এই খাতের উন্নয়নের জন্য প্রথমে আমাদের একটি জাতীয় লজিস্টিক নীতি প্রণয়ন করতে হবে।"
বর্তমানে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের জন্য মাত্র ১৯টি অফ-ডক রয়েছে, এর সংখ্যা বাড়াতে হবে। ঢাকা বিমানবন্দরেও অফ-ডক সুবিধা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
"বিশ্বব্যাপী লজিস্টিক কোম্পানিগুলো এখন আইটি-ভিত্তিক, কিন্তু আমাদের দেশের কোম্পানিগুলো এখনও ম্যানুয়ালি কাজ করছে। যদি শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়, আমাদের কোম্পানিগুলোকেও নতুন বিনিয়োগ বাড়াতে হবে," তিনি বলেন।
প্রধান কিছু ইউরোপীয় ব্র্যান্ড, যেমন মাদার কেয়ার এবং এইচএন্ডএম, ঘোষণা করেছে যে তারা ২০৫০ সালের পর গ্রিন লজিস্টিকস ছাড়া পণ্য আমদানি করবে না। "এই প্রেক্ষাপটে আমাদের অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপো স্থাপনের কাজ দ্রুত করতে হবে," তিনি যোগ করেন।
এরশাদ বলেন, "ইইউ বাংলাদেশে ব্যবসা বাড়াতে চায়। এ কারণে তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে সরকারের সঙ্গে কয়েক বছর ধরে আলোচনা করে আসছে। আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সও লজিস্টিক খাতের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঁচটি সুপারিশ করেছে।"
বাংলাদেশের শুল্ক আইন বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রায় অচল। তাই, এর সংশোধন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বলেন তিনি।
করের ক্ষেত্রে ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত আচরণ নিশ্চিত করার জন্য মানসম্মত নির্দেশিকা তৈরি এবং সেসব নির্দেশিকা মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে ইইউ।
কর বিধান অপসারণের প্রস্তাব করেছে ইইউ। কোনো কোম্পানির টার্নওভারের ০.৫ শতাংশের বেশি প্রচারমূলক ব্যয় করতে কোম্পানিগুলোকে বাধা দেয় এই নিয়ম।
ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, প্রচারমূলক ব্যয়ে ব্যয় করা থেকে কোম্পানির উপর বর্তমান এই নিষেধাজ্ঞা ব্যবসার বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিশ্বব্যাপী, আদর্শ প্রচারমূলক ব্যয় ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে।