রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের জেরে অস্থির নিত্যপণ্যের দাম
রাশিয়া-ইউক্রেনের সংঘাতে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে বিশ্বের ভোগ্যপণ্যের বাজার। দেশ দুটির মধ্যে সংঘাত শুরু হওয়ার মাত্র তিন দিনে বাজারে প্রায় প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। মরিয়া হয়ে বিকল্প খুঁজছে দেশগুলো।
রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশের সঙ্গেই বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের। দেশ দুটি থেকে গম আমদানির ওপর বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এছাড়াও আরও বেশ কিছু পণ্য আমদানি করা হয় এ দুটি দেশ থেকে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশ বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম গম আমদানিকারক। এছাড়া বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল গম আমদানিকারকদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত অর্থবছরে ৫৩ দশমিক ৪২ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। মোট আমদানির ৩৭ দশমিক ১০ শতাংশ হয়েছে এই দুই দেশ থেকে।
সূর্যমুখী তেলের বাজারের ৫০ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ করে ইউক্রেন। ভারতের মোট সূর্যমুখীর ৯০ শতাংশও আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার এবং ইউক্রেন থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার সবজি পণ্য আমদানি করেছে।
কিন্তু এই মুহূর্তে পণ্যের দরবৃদ্ধি মানেই তা সরবরাহ উৎসে বিচ্ছিন্নতার কারণে হচ্ছে, এমনটা ভাবার কারণ নেই।
এসিআই এগ্রিবিজনেসের প্রেসিডেন্ট এফএইচ আনসারি বলেন, এই মুহূর্তে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল না।
তিনি বলেন, 'কিছু সময়ের জন্য বাজার স্বাভাবিক থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে আমরা দেখছি এরইমধ্যে বিশ্ববাজারের সঙ্গে স্থানীয় বাজারেও গম, ভুট্টা ও তেলের দাম বেড়েছে।'
আনসারি বলেন, তারা ইতিমধ্যে বিকল্প বাজার খুঁজতে শুরু করেছেন। 'আমরা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইতালি এবং ব্রাজিল থেকে আমদানি করতে পারি। ওই দেশগুলো দাম বাড়ালে আমাদের বেশি দামে আমদানি করতে হবে।'
ওই বাজারগুলো যেহেতু তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল হতে পারে, তাই বাংলাদেশ কাছাকাছি কোনো বিকল্পের দিকে নজর দিতে পারে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোসাম্মৎ নাজমানারা খানম বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেন আমাদের গমের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী। আমরা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার পরিবর্তে সেখান থেকে তুলনামূলক কম দামে গম পাই।
'এই রুটটি যেহেতু বন্ধ হয়ে গেছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই দাম বাড়বে। কিন্তু আমাদের জন্য নতুন বাজার হলো ভারত। দেশটি এখন বিপুল পরিমাণ গম উৎপাদন করে। আমরা ইতিমধ্যে ভারতের সঙ্গে কথা বলেছি। বুলগেরিয়ার সঙ্গেও আমাদের একটি চুক্তি আছে। সেখান থেকে তুলনামূলক কম দামে গম পাওয়া যেতে পারে।'
বাংলাদেশে যদিও এখনও সংঘাতের প্রভাব পড়েনি, তবে দেশের অন্যতম বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের বাজার কারওয়ান বাজারে গমের দাম ইতিমধ্যেই ৮-১০ শতাংশ বেড়েছে। এ দাম আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
মূল্যবৃদ্ধির বহর
দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকরা জানান, ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত শুরু হওয়ার পর রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে সিংহভাগ পণ্যের দাম।
উদাহরণস্বরূপ, দুই দেশের সংঘাত শুরুর আগে গত সপ্তাহের মাঝামাঝিতে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন গমের বুকিং দর ছিল ৭৫০ থেকে ৭৮০ ডলার। সংঘাত শুরু হওয়ার পর গত তিন দিনে পণ্যটির দাম বেড়ে বর্তমানে আন্তর্জাতি বাজারে প্রতিটন গম বিক্রি হচ্ছে ৮৫০ থেকে ৯০০ ডলারের মধ্যে।
একইভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে গত এক সপ্তহে ভোজ্যতেলের দামও টনে ৫০ থেকে ৮০ ডলার পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে যেকোনো পণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দাম বেড়ে যাচ্ছে দেশের বাজারেও।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত তিন দিনে খাতুনগঞ্জে প্রায় প্রতিটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ।
এ সময়ে দেশের বাজারে প্রতি মণে (৩৭.৩২ কেজি) দাম ১১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বর্তমানে গম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২১৫ টাকায়।
সয়াবিন ও পাম তেলের দামও প্রতি মণে (৪০.৯০ লিটার) ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
এই তিন দিনে ইউক্রেন থেকে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্য সরিষার দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। গত সপ্তাহে প্রতি মণ সরিষা ২ হাজার ৬৫০ টাকায় বিক্রি হলেও, দাম মণে ১ হাজার টাকা বেড়ে এখন সরিষা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৬৫০ টাকায়।
একই সময়ে মণে প্রায় ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত ভুট্টার দাম।
চলমান সংঘাতের সুযোগ নিয়ে অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়িয়ে দিয়েছেন আমদানিকারকরা।
গত সপ্তাহে প্রতিমণ ভুট্টা ১ হাজার ১২০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ টাকায়।
মাত্র তিন দিনে প্রতি মণে চিনির দাম বেড়েছে ৪০ টাকা পর্যন্ত। আর প্রতি মণ সাদা মটরের দাম বেড়েছে ১৫০ টাকা পর্যন্ত।
মূল্যবৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে মেসার্স হক ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী আজিজুল হক বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের খবরে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে।
এভাবে চলতে থাকলে আগামী রমজানে পণ্যের দাম আরো অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান এই ব্যবসায়ী।
ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স আরএম স্টোরের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ বলেন, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী উৎপাদন সংকটের কারণে পণ্যের দাম একদফা বেড়েছে।
এরপর জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে পণ্য পরিবহনে জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে অস্থিতিশীল থাকে ভোগ্যপণ্যের বাজার। এরমধ্যে ডলারের দামও বেড়ে গেছে।
এসবের সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট। একদিনেই আর্ন্তজাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের বুকিং দর বেড়ে গেছে। এসব কারণে ভোগ্যপণ্যের বাজারে বেশিরভাগ পণ্যের দাম আবারো অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে বলে জানান আলমগীর।
মূল্য আরও বাড়ার সম্ভাবনা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সরবরাহ চেইন ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে লেনদেন বিঘ্নিত হবে বলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর ফলে বাড়বে পণ্যের দাম।
সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, 'রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে আমরা হয়তো বিকল্প দেশ থেকে গম কিংবা অন্যান্য ভোগ্যপণ্য আমদানি করব। কিন্তু এতে পণ্যের বুকিং দর বৃদ্ধি এবং পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দামে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।'
আমদানিকারকরা জানান, রাশিয়া-ইউক্রেনসহ ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ থেকে সমুদ্রপথে পণ্য আসে কৃষ্ণসাগর রুট হয়ে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেনের সংঘাতের কারণে এই সমুদ্রপথ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর ফলে সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হতে পারে।
বিশ্বব্যাপী গম বাণিজ্যের এক-চতুর্থাংশ এবং ভুট্টা বাণিজ্যের এক-পঞ্চমাংশের করে থাকে ইউক্রেন ও রাশিয়া। এই গম-ভুট্টার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠানো হয় কৃষ্ণসাগর রুট দিয়ে।
সংঘাত শুরু হওয়ার পর ইউক্রেনের বন্দরগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে অন্তত কৃষ্ণসাগরে তিনটি বাণিজ্যিক জাহাজে আক্রমণ করা হয়েছে বলে বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে। বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন হয় কৃষ্ণ সাগরে চলাচল করা জাহাজগুলোকে বিমা কাভার করার প্রস্তাব দিচ্ছে না, অথবা কাভার করার জন্য বিশাল প্রিমিয়াম দাবি করছে বলে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ।
এদিকে ২৯ জন নাবিকসহ একটি বাংলাদেশি জাহাজ ইউক্রেনের একটি বন্দরে আটকা পড়ে রয়েছে।
সাবেক সিনিয়র বাণিজ্য সচিব শুভাশিষ বসু বলেন, রাশিয়ার ওপর ন্যাটোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দাম বাড়ার একটি বড় কারণ। তিনি আরও বলেন, তৃতীয় পক্ষেরও দাম বাড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সুইফট ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হলে লেনদেন আরও ব্যাহত হবে, যার ফলে দাম আরও বেড়ে যাবে।