‘এগিয়ে আসছে রুশ বাহিনী’: এক শহর থেকে অন্য শহরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ইউক্রেনের যে পুলিশ সদস্য
শার্পনেলে ক্ষত-বিক্ষত তাঁর গাড়ি, তবু সেটিই বিশ্বস্ত সঙ্গী। আর একমাত্র বাহন। গাড়িতে রাখা ছোট্ট এক ব্যাগে কিছু সোয়েটার ও প্যান্ট, প্লাস্টিকের দুটি ব্যাগভর্তি কিছু খাবার ও দরকারি ওষুধ। এসব নিয়েই এক শহর ছেড়ে অন্য শহরে পালাচ্ছেন ইউক্রেনের পুলিশ কর্মকর্তা ভলোদিমির নিকুলিন।
নিকুলিনকে সম্মুখভাগের কাছাকাছি নিয়োগ দিয়েছিল ইউক্রেনের সরকার। কিন্তু অগ্রভাগের প্রতিরক্ষা অতিক্রম করে রুশ বাহিনী এগোনোর সাথে সাথে তাকেও আগের নিবাস ছেড়ে নতুন ঠিকানায় ছুটতে হচ্ছে যাযাবরের মতো।
সঙ্গে সহায়সম্বল এত কম রাখার কারণটাও তাই যৌক্তিক। কারণ ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের ডনবাস অঞ্চলে রুশ বাহিনী যে গতিতে এগিয়ে আসছে, তাতে যেকোনো মুহূর্তের নোটিশে মাথা গোঁজার ঠাই ছেড়ে নতুন গন্তব্যে যেতে হচ্ছে তাঁকে। ফলে সামান্য জিনিসপত্র দিয়েই জীবনধারণের অভ্যাস এরমধ্যেই রপ্ত করেছেন। কারণ এরমধ্যেই মুহূর্তের নোটিশে তাঁকে তিনটি শহর ছাড়তে হয়েছে।
বর্তমানে যেখানে তীব্র লড়াই চলছে, তার থেকে মাত্র ১৫ মাইল দূরের স্লোভিয়ানস্কে রয়েছেন নিকুলিন। এখানে তাঁর এক বন্ধুর ফ্ল্যাটও রয়েছে, কিন্তু সেখানে ওঠার ঝক্কিও নেননি, বরং ছোট্ট অফিসকেই করেছেন আপাত ঠিকানা। দূরের রুশ কামানের গর্জন প্রায়ই শোনা যায় ছোট্ট ঘরটি থেকে, যেকোনো মুহূর্তে আবারো যে এই ঠিকানাও ছাড়তে হতে পারে– তাই যেন মনে করিয়ে দেয় এই শব্দ।
সম্প্রতি এই স্লোভয়ানস্কেই নিকুলিনের সাথে কথা হয়েছিল মার্কিন পত্রিকা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিকের। তিনি বলেন, কে জানে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কোথায় আমি থাকব? রুশ বাহিনী যে এই জনপদের দিকেও অব্যাহতভাবে এগিয়ে আসছে তা-ও স্বীকার করলেন। শার্পনেলে কেটেছিড়ে যাওয়া গাড়িটির দিকে ইঙ্গিত করে মুচকি হেসে বললেন, 'এটা আমার লাকি কার। অন্তত এর ওপর তো নির্ভর করতেই পারি।'
'বিশ্বস্ত' গাড়িটি কীভাবে তাঁকে একাধিকবার রুশ হামলার মধ্যে পড়া থেকে বাঁচিয়েছে তারও বর্ণনা দেন ৫৩ বছরের এই পুলিশের লেফটেন্যান্ট।
কিন্তু, এর শুরুটা বেশ আগের। এমনকী ইউক্রেনে রাশিয়ার আনুষ্ঠানিক আগ্রাসনেরও আগে ২০১৪ সালে, যখন ডনবাসে রুশভাষী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিচ্ছিল রাশিয়া। সেবছর বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দনেয়স্ক দখলে নিলে প্রথমবারের মতো পালাতে হয়েছিল নিকুলিনকে। এরপর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালে মারিওপোল থেকে এবং চলতি ২০২৪ সালে মিরনোহার্দ থেকে পালান। এই সংঘাতে হাজার হাজার ইউক্রেনীয় বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, নিকুলিনের কাহিনি সেই বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছে।
অন্যদের মতো নিকুলিনকেও ছাড়তে হয়েছে নিজ শহর, চোখের সামনেই দেখেছেন তা ধ্বংস ও দখল হতে। প্রতিবেশীদের মৃত্যুতে শোকাহত হয়েছে অজস্রবার।
মারিওপোল থেকে কিছু সাংবাদিককে পালাতে সাহায্য করেছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা, যারা পরে অবরুদ্ধ নগরীটির করুণ চিত্র তুলে ধরেন বিশ্ববাসীর সামনে।
ফ্রন্টলাইনের কাছাকাছি একজন পুলিশ সদস্য হিসেবে তাঁর জীবনের ঝুঁকিও অনেক বেশি। কারণ রুশ বাহিনীর কাছে তাঁর মতো পুলিশ কর্মকর্তারা চিহ্নিত শত্রু। কোনোভাবে তাঁদের হাতে পড়লে আর রক্ষে নেই। তাছাড়া, রাশিয়ার ছোঁড়া ক্রমাগত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় প্রাণ হারানোর ঝুঁকি তো আছেই। নিকুলিন যে থানায় কাজ করতেন, সেটি বেশ কয়েকবার রুশ হামলার শিকার হয়, এতে নিহত হন তাঁর বেশ কয়েকজন সহকর্মীও।
এরমধ্যেই জীবনের মায়া ত্যাগ করে হামলায় বিধ্বস্ত ধবনের ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়াদের উদ্ধারে প্রায়ই ছুটে যান নিকুলিন।
সহকর্মীদের মৃত্যুর স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, 'রাশিয়ানদের কাছে আমরা (পুলিশ সদস্যরা) ছিলাম লক্ষ্যবস্তু।'
বর্তমানে রুশ বাহিনী ডনবাস অঞ্চলে যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে নিকুলিনের আশঙ্কা তাঁর এই পালিয়ে বেড়ানোর পালা অচিরেই শেষ হচ্ছে না। অন্তত যদি মৃত্যু না আসে। তবু আশা একটাই, কোনোদিন যুদ্ধ থামবে– আর তিনিও ফিরতে পারবেন নিজ শহরে। ইউক্রেনীয় সেনারা যুদ্ধের মোড় পরিবর্তন করতে পারবে– এমন বিশ্বাস তাঁর আজো।
স্বল্পভাষী নিকুলিন বেশ আত্মবিশ্বাসী এক পৌঢ়। ১৯৭০ এর দশকে দনেৎস্কে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা, যখন ইউক্রেন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। বাবা ছিলেন খনি শ্রমিক আর মা পোশাক কর্মী। নিকুলিন চেয়েছিলেন সৈনিকের জীবন, তাই পড়াশোনাও করেন দনেৎস্কের সামরিক একাডেমিতে। ১৯৯২ সালে তিনি একাডেমি থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন, এর এক বছর পরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ইউক্রেন। ফলে লালফৌজে আর নাম লেখানো হয়নি, স্বাধীন দেশের পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন নিকুলিন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে যে অর্থনৈতিক দুর্দশা নেমে আসে— তার ফলে বেড়ে যায় অপরাধী চক্রের তৎপরতা। পরস্পরের মধ্যে খুন-জখমে জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন গ্যাং। নবীন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে সেদিনের স্মৃতিচারণ করে নিকুলিন বলেন, চারদিকে তখন আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা দিয়ে মানুষ খুন করা হচ্ছিল। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এসব অপরাধীদের সহায়তায় রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সম্পদ দখল করছিল।
তবে ধীরে ধীরে সহিংসতা ও অপরাধ প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়, শহরের সমৃদ্ধিও আসতে থাকে। গড়ে ওঠে অনেক সুউচ্চ দালান ও দামি ক্যাফেটেরিয়া। এমনকী ২০১২ সালে দনেৎস্ক স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় ইউরোপিয়ান সকার চ্যাম্পিয়নশিপের কোয়ার্টার-ফাইনাল ম্যাচ।
তবে যুদ্ধের আগুনে সেই শহরের সমৃদ্ধি আজ অতীত। যাযাবর জীবনের মাঝেও আজ সেসব স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান নিকুলিন।