ভ্যাট-জিডিপি ব্যবধান: আদায়ের বাইরে দেড় লাখ কোটি টাকা
ভ্যাট আদায়ের ব্যবস্থায় দুর্বলতার কারণে বার্ষিক মূল্য সংযোজন করযোগ্য পণ্য ও পরিষেবা থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি আদায় করা যাচ্ছে না। রাজস্ব বাড়াতে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগও দৃশ্যত ব্যর্থ প্রমাণিত হচ্ছে।
খোদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগের এক হিসাব বলছে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের ১১টি খাতের জিডিপিতে অবদান ১৬ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা, এই লেনদেনে খাতগুলির ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট জমা দেওয়ার কথা প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু, প্রকৃত আদায় হয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকার সামান্য বেশি, যা প্রক্ষেপিত অংকের মাত্র ৪০ শতাংশের মতো।
অর্থনীতিবিদরা আরও ভয়াবহ চিত্রের ইঙ্গিত দিয়ে জানিয়েছেন, বাস্তবে ব্যবধান আরও বেশি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসা এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, জিডিপি'র তুলনায় ভ্যাট আদায়ের ব্যবধান অন্তত আড়াই লাখ কোটি টাকা।
মূলত আদায় প্রক্রিয়াকে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশনের আওতায় আনতে না পারা, লেনদেনের বড় অংশই শনাক্তের বাইরে থাকা, নতুন ভ্যাট আইনের কিছু সীমাবদ্ধতা, ফাঁকির প্রবণতা, তুলনামূলক বেশি ভ্যাট হার, ইলেক্ট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইসকে জনপ্রিয় করতে না পারাসহ বেশকিছু কারণই এ জন্য দায়ী বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, "হয়রানির ভয়েও অনেক ব্যবসা ভ্যাট নিবন্ধন থেকে দূরে থাকছে।"
এসব কিছুর প্রেক্ষাপটে, কীভাবে ভ্যাট আদায় আরও বাড়ানো যায়- সেজন্য শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুর রউফকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এ বিষয়ে অবহিত সূত্রগুলির মতে, দেশের ভ্যাট ব্যবস্থাপনার অবকাঠামোগত সংস্কার এবং রাজস্ব আহরণে ভ্যাট হার কমানো-বাড়ানোর প্রভাবসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয় কমিটিকে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৫টি খাত জিডিপিতে প্রায় ৩০ লাখ কোটি টাকা অবদান রেখেছে। এর মধ্যে, ১১টি খাত ভিন্ন ভিন্ন হারে ভ্যাট দেওয়ার অধিকারী। বাদবাকী ৪টি খাত: কৃষি ও পশুসম্পদ, মৎস্য, জনপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষা এবং স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা ভ্যাট থেকে শতভাগ অব্যাহতিপ্রাপ্ত। ওই অর্থবছরে জিডিপিতে তাদের অবদান ছিল প্রায় ২০ শতাংশ।
এছাড়া, ১১টি খাতের মধ্যে ৯ খাত আনুমানিক ৫ শতাংশ থেকে ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা পায়।
এনবিআর প্রক্ষেপিত ভ্যাট আদায়ের ঘাটতির বিষয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "এ হিসাবটি শতভাগ নির্ভূল নয়, আমরা কেবল এ পরিস্থিতির ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করেছি। বাস্তবে জিডিপির তুলনায় ব্যবধান কম হবে না, বরং আরো বেশি হতে পারে।"
কেবল ভ্যাট নয়, সার্বিকভাবে জিডিপি'র তুলনায় বাংলাদেশে রাজস্ব আদায়ের চিত্রও হতাশাজনক।
পাঁচ বছর আগেও যেখানে দেশে জিডিপি'র তুলনায় রাজস্ব আদায় ১০ শতাংশ বা তারও বেশি ছিল; গত দুই বছর ধরে তা নেমে এসেছে ৯ শতাংশের ঘরে।
ভ্যাট কর্মকর্তারা রাজস্ব আদায় বাড়াতে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনার পরামর্শ দেন।
কমিশনারেট অব কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট (ঢাকা পশ্চিম) এর কমিশনার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, "স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে জিডিপি'র তুলনায় রাজস্ব আদায় ৯০ শতাংশ বা তারও বেশি। রাজস্ব প্রশাসনে কাঠামোগত সংস্কার করা গেলে বাংলাদেশেও ভ্যাট আদায় বাড়বে। পুরো প্রক্রিয়াকেও অটোমেশনের আওতায় আনতে হবে।"
১৯৯১ সালে দেশে প্রথম ভ্যাট আইন প্রবর্তন হয়। কিন্তু প্রত্যাশিত শৃ্ঙ্খলা না আসায় সরকার ২০১২ সালে উন্নত ভ্যাট ব্যবস্থাপনার অনুসরণে একটি আইন প্রবর্তন করে, যা ২০১৫ সাল থেকে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই আইনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যবসায়ীদের তীব্র আপত্তির মুখে কিছুটা পিছিয়ে দিয়ে মূল আইনে ব্যাপক কাটছাঁট করে বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৯ সাল থেকে।
যেসব কারণে প্রত্যাশিত আদায় হচ্ছে না:
বিবিএসের সাম্প্রতিকতম জরিপ অনুযায়ী, দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ।
কিন্তু নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হওয়ার পর তাদের মধ্যে মাত্র ৩ লাখ বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (বিআইএন) নিয়েছে এবং তাদের এক-তৃতীয়াংশ মাসিক রিটার্ন জমা দেয় না।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ মনে করেন, লেনদেনের প্রক্রিয়াকে অনলাইনের মধ্যে আনার ব্যর্থতা এর পেছনে অন্যতম কারণ।
এনবিআরের সাবেক সদস্য আলী আহমেদ বলেন, "হয়রানির ভয়ে অনেকে ভ্যাট পেমেন্টে আসতে চান না। অনেকক্ষেত্রে সঠিক ভ্যাট দিতে চাইলেও, কর্মকর্তাদের ঘুষ না দিলে হয়রানির আশঙ্কা থেকে যায়।"
আরেক সাবেক সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন তিনটি সুনির্দিষ্ট কারণকে এজন্য দায়ী করেছেন। এগুলো হলো- ২০১২ সালে প্রণীত ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন পর্যায়ে অনেক বিচ্যুতি হওয়া, ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়া এবং এনবিআরের অভ্যন্তরে ভ্যাট, কাস্টমস ও আয়কর বিভাগের মধ্যে সমন্বয় না থাকা।
সরকার বিপণীবিতানসহ ২৬ ধরনের ব্যবসায়ে লেনদেনের সঠিক হিসাব রাখতে বিক্রয়কালে ইলেক্ট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) চালু করেছে। গত তিন বছরে সারা দেশে এই ডিভাইস বসেছে মাত্র সাড়ে তিন হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। আবার যেখানে এ ডিভাইস বসেছে, সেখানেও সব লেনদেন এর মাধ্যমে করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় করতে পারলে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হবে।