ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, বাড়ছে না দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ
"তেলের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে ব্যয় একই রাখতে ব্যবহার কত শতাংশ কমাতে হবে?" মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গণিত ক্লাসের পরিচিত এ সমস্যাটি কয়েকগুণ তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের ব্যবহারিক জীবনে।
গণিতের বইয়ে তেলের দাম ১০ শতাংশ বাড়লেও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাজারে এক বছরে তেলের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি।
আটা, ময়দা, ডাল, চিনি, ডিম, মাংস, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও অন্যান্য মাংসের দামও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। করোনার ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধারে পিছিয়ে থাকা দরিদ্র লোকজনের আয় না বাড়ায় ব্যয় অপরিবর্তিত রাখতে খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্য আগের চেয়ে কম কিনছেন অনেকে।
এ অবস্থায় দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর পরিধি সম্প্রসারণ এবং মাথাপিছু বরাদ্দ বৃদ্ধির তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে আয় ও ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতে অতিদরিদ্রদের জন্য মৌসুমি কর্মসংস্থানে বাড়তি গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। তবে আগামী বছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বাজেট প্রস্তাবে বিশেষজ্ঞদের এসব প্রস্তাবের কোনই প্রতিফলন নেই।
চলতি অর্থবছর কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর গম কিনতে ৩৩৬.৭১ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ৩৮% বাড়লেও এ খাতে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে একই পরিমাণ বরাদ্দ চেয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
নিকট ভবিষ্যতে দাম না বাড়লেও এ বরাদ্দে নতুন অর্থবছরে প্রায় ২৭% গম কিনতে হবে। এর ফলে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর সুবিধাভোগীর সংখ্যা বা মাথাপিছু বরাদ্দ কমাতে বাধ্য হবে মন্ত্রণালয়টি।
একই পরিমাণ গম কিনতে আগামী অর্থবছর বাজেটে বরাদ্দের প্রয়োজন ৪৬৫ কোটি টাকা। তবে নতুন বছরের বাজেট প্রস্তাবে বাড়তি ১২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ চয়নি মন্ত্রণালয়টি।
আগামী অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নে অর্থমন্ত্রণালয়ে ১০,৮৬৫ কোটি টাকার প্রস্তাব পাঠিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। চলতি অর্থবছরে ৯৯৫০.৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দের চাইতে ৯.১৯% বাড়তি চেয়েছে মন্ত্রণালয়টি।
তবে ৯১৪.৩০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দের অধিকাংশই যাবে বেতন-ভাতা পরিশোধে, এখনও অনুমোদন পায়নি এমন প্রকল্পের জন্য থোক বরাদ্দ আর রোহিঙ্গাদের জন্য চলমান প্রকল্প বাস্তবায়নে।
কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে নগদ অর্থ সহায়তা হস্তান্তর, অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচী ও খাদ্য সহায়তা কর্মসূচী বাস্তবায়নে কোন বরাদ্দই বাড়ছে না। কিছু খাতে বরাদ্দ সামান্য বাড়লেও মূল্যস্ফীতির তুলনায় এর হার একেবারেই নগণ্য।
অর্থমন্ত্রণালয়ের দলিল পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রতি বছর তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে জিআর সহায়তা বাবদ ১.২৫ লাখ টন ও ভিজিএফ কার্যক্রম বাবদ ২.১০ লাখ টন খাদ্যশস্য কেনা হয়ে থাকে।
দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান, টিআর, কাবিখা, কাবিটা, ও অন্যান্য কর্মসূচীর মাধ্যমে প্রতি বছর ৬৫ থেকে ৭০ লাখ দরিদ্র উপকারভোগীর মাঝে সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে মন্ত্রণালয়।
এর পাশাপাশি দুর্যোগের অভিঘাত মোকাবেলায় তাৎক্ষণিক সাহায্য হিসেবে ভিজিএফ কর্মসূচীর মাধ্যমে সহায়তা দেয়া হয় ২৫ লাখ দরিদ্র মানুষকে। সব মিলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতি বছর সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় সহায়তা পাচ্ছে প্রায় ৯৫ লাখ মানুষ।
২০১৫ সাল থেকে বাস্তবায়নাধীন জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল-এ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতিবছর সামাজিক নিরাপত্তায় মাথাপিছু বরাদ্দ বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছিল। একই সাথে এ সব কর্মসূচীর সুবিধাভোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছিল।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যারা এই বাজেট প্রস্তাব তৈরি করেছেন, তাদের হয়তো বাজারে খাদ্যপণ্যের বিষয়ে ধারণা নেই, অথবা তারা এ বিষয়টি আমলে নেননি।
তিনি আরও বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয়ের বিবেচনায় সার্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের দ্বারপ্রান্তে চলে গেলেও অসম পুনরুদ্ধারের কারণে দরিদ্র লোকজন করোনার আগের অবস্থায় আসতে পারেননি। দারিদ্র্য হার বৃদ্ধির কারণে পিছিয়ে থাকা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এখন দরকার আরও বাড়তি সহায়তা। এ অবস্থায় দুর্যোগ ও ত্রাণ খাতের বরাদ্দে সঙ্কোচন দরিদ্র মানুষের জন্য হতাশার।
"মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাড়তি বরাদ্দ চাইলে অর্থমন্ত্রণালয় অনেক সময় কিছুটা কাটছাঁট করে বরাদ্দ দেয়। এখন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেই যদি কম চাওয়া হয়, অর্থমন্ত্রণালয় কীভাবে বরাদ্দ বাড়াবে?" প্রশ্ন রেখে বলেন তিনি।
এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও আর্থিক বরাদ্দ না বাড়লে আগামীতে মাথাপিছু খাদ্য বিতরণ কমাতে হবে। অবশ্য সুবিধাভোগীর সংখ্যা কমিয়েও বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারবে ত্রাণ মন্ত্রণালয়। তবে এই দুইটির কোনটিই করার মতো অবস্থায় দেশ এখন নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী বাস্তবায়নে আগামী বছরের জন্য ৮০৯.৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। চলতি বছরেও একই পরিমাণে বরাদ্দ রয়েছে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে।
এর মধ্যে গম কেনা বাবদ ৩৩৬.৭১ কোটি টাকা ও চাল কেনা বাবদ ৪৭২.৫০ কোটি টাকার বরাদ্দ অপরিবর্তিত থাকছে।
গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন (মাটির কাজ) বাবদ নগদ ত্রাণ পরিচালনায় নতুন বাজেটে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ১৫০০ কোটি টাকা। চলতি বছরের মূল ও সংশোধিত বাজেটেও এ খাতে একই পরিমাণে বরাদ্দ রয়েছে।
ভিজিএফ ত্রাণ পরিচালনায় চাল বাবদ নতুন বছরে ৯৯২.৪৫ কোটি টাকার বরাদ্দ অপরিবর্তিত থাকছে। নগদ ত্রাণ কাজে ১৪৫০ কোটি টাকার বরাদ্দ মাত্র ১০০ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৫৫০ কোটি টাকায়।
ঢেউটিন বাবদ ৭৫ কোটি টাকা থেকে ৭ কোটি টাকা বেড়ে বরাদ্দ দাঁড়াচ্ছে ৮২ কোটি টাকায়। বরাদ্দ বৃদ্ধির হার ৯.৩৩ শতাংশ।
কম্বল কেনায় ৫০ কোটি টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা বেড়ে বরাদ্দ দাঁড়াচ্ছে ৫৫ কোটি টাকায়। বরাদ্দ বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ।
অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান খাতেও বাড়ছে না বরাদ্দ। এ খাতে চলতি বছরের ১৬৫০ কোটি টাকার বরাদ্দ অপরিবর্তিত থাকছে আগামী বছরেও। বিশেষ অনুদান বাবদ ২০ কোটি টাকাও থাকছে অপরিবর্তিত।
তবে শিশুখাদ্য ও গবাদি পশুর খাদ্য অনুদান বাবদ বরাদ্দ বাড়ছে ২৫ শতাংশ করে। এই দুই খাতে চলতি অর্থবছরে ২০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ থাকলেও ৫ কোটি করে বাড়িয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য ২৫ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) অননুমোদিত অবস্থায় রয়েছে এমন প্রকল্প অনুমোদন দিতে চলতি বাজেটে থোক বরাদ্দ রয়েছে ৩০.৭৮ কোটি টাকা। প্রায় সাড়ে চারগুণ বাড়িয়ে নতুন বাজেটে এ খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ১৪০ কোটি টাকা।
ইমার্জেন্সি মাল্টি সেক্টর রোহিঙ্গা ক্রাইসিস রেসপন্স প্রকল্পেও নতুন বাজেটে বরাদ্দ প্রায় দ্বিগুণ হচ্ছে। এ প্রকল্পের ১৬০ কোটি টাকার বরাদ্দ উঠছে ৩১৪.৫৬ কোটি টাকায়। বাড়ছে ১৫৪.৫৬ কোটি টাকা।
এছাড়া মন্ত্রণালয় ও এর অধিভুক্ত সংস্থার কর্মীদের বেতন ভাতা ৮.৯ শতাংশ, প্রশাসনিক ব্যয় ১৭ শতাংশ, প্রশিক্ষণ ব্যয় ২৫ শতাংশ, ভ্রমণ ব্যয় ১২২ শতাংশ, উদ্ভাবন খাতে ২৫ শতাংশ, যানবাহন খাতে ৮০ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
উপেক্ষিত মধ্যমেয়াদী প্রক্ষেপণ
২০২০-২১ অর্থবছরের মিডিয়াম টার্ম বাজেট ফ্রেমওয়ার্কে (এমটিবিএফ) ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে মোট ১১৮১৫.৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রাক্ষলন করা হয়েছিল।
দীর্ঘমেয়াদী প্রাক্ষলন থেকে আট শতাংশের বেশি কমিয়ে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ১০৮৬৫.১০ কোটি টাকা। আগামী কয়েক বছরের বরাদ্দ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে বাজেট বক্তব্যের সাথেই এমটিবিএফ প্রকাশ করা হয়। এমটিবিএফ অনুযায়ী আগামী অর্থবছর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অনকূলে বরাদ্দ আরও ৯৫০.৫৪ কোটি টাকা বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্রে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল রেখে প্রতিবছরই বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা থাকলেও গত সাত বছরে বাস্তবে এর কোন প্রতিফলন হয়নি।
তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে কাজ হারিয়ে সবচেয়ে বেশি আয় কমেছে দরিদ্র মানুষের। এর ফলে দারিদ্র্যহারও বেড়েছে। তাদের এ ক্ষতি পুনরুদ্ধারের আগেই দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় অন্যান্য খাতে ব্যয় কমিয়ে হলেও বাড়তি দামে খাবার কিনছে মানুষ।
তিনি বলেন, অনেকেই কম দামের খাবার কিনছেন, অনেকেই কম পরিমাণে খাবার খাচ্ছেন, আবার অনেকেই এক বেলা না খেয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। খাদ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাবের কারণে আগামীতে শিক্ষা ও উৎপাদনশীলতাও কমে আসবে বলে তার আশঙ্কা।
এ অবস্থায় দরিদ্র মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণের পাশাপাশি তাদের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখা ও সামষ্টিক অর্থনীতির সামগ্রিক চাহিদা ধরে রাখতে করোনার ক্ষতি পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত নগদ অর্থ ও খাদ্য সহায়তা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন তিনি।