টিস্যু ও বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদনে ঝুঁকছে কাগজ শিল্প
দেশে মুদ্রণ ও হাতে লেখার কাগজের চাহিদা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।
তবে পেপার বৈচিত্র্যময় পণ্যের চাহিদা দ্রুত গতিতে বাড়ছে। বিশেষ করে মহামারির সময় টিস্যু ও হাইজেনিক পণ্যের বাজার ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে।
এ খাতের অন্যতম বড় একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেপার মিলস এসোসিয়েশনের আর্থিক প্রতিবেদনের বিশ্লেষণের তথ্য থেকে এ খাতের বর্তমান পরিস্থিতির ধারণা পাওয়া যায়।
কোভিড-১৯ মহামারি শুরু আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১১০৫ কোটি টাকা মোট আয় করে প্রতিষ্ঠানটি। এরমধ্যে পেপার খাতের আবদান ছিল ৫৬ শতাংশ, আয় ছিল ৬১৮ কোটি টাকা। এর দুই বছর পর, ২০২০-২১ অর্থবছরে কোম্পানিটির মোট ৮৮৮ কোটি টাকা আয়ে পেপার খাতের অবদান কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশে, আয় ছিল ৩৭৬ কোটি টাকা।
তবে, একই সময়ে কোম্পানিটির মোট আয়ে হাইজেনিক পণ্যের অবদান ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৯ শতাংশে দাঁড়ায়, যা এ যাবতকালে সর্বোচ্চ।
চাহিদার এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে এই শিল্পের কিছু উদ্যোক্তা কাগজের উৎপাদন কমিয়ে এর পরিবর্তে বৈচিত্র্যময় কাগজ পণ্যের উৎপাদন বাড়িয়েছে। অনেকে এমনকি শুধুমাত্র বৈচিত্র্যময় পণ্যগুলো নিয়ে কাজ করছে।
উদ্যোক্তাদের মতে, ডিজিটাল মিডিয়ার প্রসার বা অনলাইন নির্ভরতায় সরকারি-বেরসকারি অফিসে কমছে কাগজের ব্যবহার। শিক্ষা-কার্যক্রমও অনলাইন নির্ভর হওয়ায় ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে কাগজের চাহিদা।
তারা বলছেন, প্রায় দুই বছর ধরে মহামারির কারণে স্কুল বন্ধ থাকার যে প্রভাব পড়েছে তা থেকে পুনরুদ্ধার ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে আরও কয়েক বছর সময় লাগতে পারে।
বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, করোনার কারণে কাগজের চাহিদা কমার কারণে শুধুমাত্র পেপার পণ্য উৎপাদন করে এমন প্রায় ৫০টি মিল বন্ধ হয়ে গেছে।
অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে শতাধিক পেপার মিলের মধ্যে ৪১টির মতো কোম্পানি পেপার ও পেপারজাত পণ্য বা ডাইভারসিফাইড পণ্য উৎপাদন করে।
খাত সংশ্লিষ্টরা টিবিএস-কে জানিয়েছেন, বৈচিত্র্যময় কাগজ পণ্যের চাহিদা বাড়ায় মিলগুলো এসব পণ্যের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। শিল্পখাতের উদ্যোক্তাদের শঙ্কা সামনের দিনগুলোতে পেপার খাতের ব্যবসা আরও সংকুচিত হবে।
বসুন্ধরা পেপারের জিএম এম মাজেদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, দেশের ৮০ শতাংশ টিস্যু পেপারের চাহিদা মিটিয়ে থাকে তার কোম্পানি। টিস্যু ও হাইজেনিক পণ্যের উৎপাদন বাড়াচ্ছে কোম্পানিটি।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই কোম্পানিটি ভবিষ্যতে আরও কয়েকটি নতুন পণ্য আনার পরিকল্পনা করছে বলে জানান তিনি।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে কাঁচামালের উর্ধ্বমুখী দাম এ খাতের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও কাঁচামাল আমদানিতে শিপিং ভাড়া বৃদ্ধির কারণে ব্যয় বাড়ছে।
মেঘনা পাল্প অ্যান্ড পেপারের নতুন টিস্যু প্ল্যান্ট
স্থানীয় টিস্যুর বাজারের ৮-১০ শতাংশ শেয়ারধারী মেঘনা পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলস তাদের 'ফ্রেশ' ব্র্যান্ডের মাধ্যমে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াচ্ছে।
এ লক্ষ্যে কোম্পানিটি ইতোমধ্যেই একটি নতুন প্ল্যান্ট কিনেছে। এর আগে আরও একই আমদানি করেছিল।
অনলাইন নিউজ পোর্টাল পাল্পেপারনিউজের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুনে নতুন প্রোডাকশন প্ল্যান্ট কিনতে রিকার্ড এসপিএ'র সাথে চুক্তি সই করে মেঘনা পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলস।
এ বছরের সেপ্টেম্বরে যন্ত্রপাতি স্থাপনের কথা রয়েছে।
ফোরড্রিনিয়ার ফর্মেশন সেকশনসহ পেপার মেশিনটি প্রতি মিনিটে সর্বোচ্চ ১০০০ মিটার গতিতে প্রতিদিন ৭০ টন উৎপাদনে সক্ষম। ফোরড্রিনিয়ার এক ধরনের কাগজ তৈরির যন্ত্র। কাগজ, পেপারবোর্ড এবং অন্যান্য ফাইবারবোর্ড উত্পাদন করা হয় এর মাধ্যমে।
চাহিদা ও উৎপাদন
দেশে বিভিন্ন ধরনের কাগজের চাহিদা প্রায় ৯ লাখ টন, কিন্তু ২০-৩০টি বড় ও বাকি ছোট পরিসরের স্থানীয় উৎপাদকদের উৎপাদন ক্ষমতা বছরে ১৬ লাখ টন।
দেশের কাগজের বাজার ৫০০০ কোটি টাকার। স্থানীয় বাজারের ৬০-৭০ শতাংশই লেখার ও মুদ্রণের কাগজ।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাত্র এক দশক আগেও সম্পূর্ণভাবে আমদানির ওপর নির্ভরশীল ছিল বাংলাদেশ।
যদিও দেশে এ খাতের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০'র দশকে, বড় শিল্প গ্রুপগুলো ৯০'র দশকে এ খাতে বিনিয়োগ শুরু করে ধীরে ধীরে স্বনির্ভর হয়ে ওঠে।
বর্তমানে দেশের পেপার মিলগুলো দেশের চাহিদা মিটিয়ে পণ্য রপ্তানি করছে। এ খাতে কাজ করে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ।
বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, এ খাতে ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে উদ্যোক্তারা।
এ খাতের সঙ্গে মুদ্রণ, প্রকাশনা, কালি তৈরি, অলঙ্করণ, প্যাকেজিং এবং বাঁধাইয়ের মতো প্রায় ৩০০টি আনুষঙ্গিক খাত জড়িত।