দাম বেড়ে যাওয়ায় কমে গেছে বিক্রি, সংকটে টিস্যু শিল্প
ক্রমবর্ধমান দামের কারণে টিস্যু পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় সংকটে পড়ছে দেশের টিস্যু শিল্প।
মূলত কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যয় বৃদ্ধি ও ইউটিলিটি খরচ বেড়ে গেছে। এ কারণে পণ্যের মূল্য সমন্বয়ে দাম বাড়িয়েছে টিস্যু পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। আর এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে কমে গেছে ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা।
গত কয়েক বছর ধরে বাড়ি, স্কুল, কর্মক্ষেত্র, হাসপাতাল ও পাবলিক প্লেসে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি, পরিচ্ছন্নতা এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য টিস্যু পণ্যের ব্যবহার প্রসারিত হওয়ায় শিল্পটি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২২ সালের শুরুর দিকে করোনা মহামারি টিস্যু পণ্যের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। এরপর ধারাবাহিকভাবে পণ্যটির চাহিদা বাড়ছিল।
টিস্যু শিল্পের অন্যতম প্রধান উৎপাদনকারী, যেমন বসুন্ধরা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা পেপার মিলস, মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের ফ্রেশ টিস্যু এবং সোনালী টিস্যুর বিক্রিও কমেছে।
পারটেক্স গ্রুপ, বাংলা টিস্যু, সুপার স্টার ও বেঙ্গলসহ টিস্যু বাজারের অন্যান্য উৎপাদক বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে একই ধরনের পরিস্থিতির অতিক্রম করছে।
বসুন্ধরা পেপার মিলসের মহাব্যবস্থাপক এবং কোম্পানি সচিব মাজেদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'ক্রমবর্ধমান খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে টিস্যু শিল্প অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। টিস্যু পণ্যের দাম বাড়ানোর কারণে পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। তবে কাঁচামালের খরচ এবং ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে।'
ফ্রেশ টিস্যুর মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয়) মো. ইয়াসিন মোল্লা বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা সত্ত্বেও এ বছর টিস্যু পেপার বিক্রি স্থবির রয়েছে।
ইয়াসিন টিবিএসকে বলেন, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতি ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করেছে, ভোক্তাদেরকে প্রয়োজনীয় পণ্যকে অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য করেছে।' তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বসুন্ধরা পেপার মিলসের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, বর্তমানে টিস্যু পণ্যের বাজারের আকার প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা—এবং ৮০ শতাংশ মানুষ মাসে একবার টিস্যু পেপার ব্যবহার করে।
বেড়েছে কাঁচামাল ও জ্বালানির দাম
শিল্পসংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, গত কয়েক মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে টিস্যু পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত পাল্পের দাম ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
এক বছর আগে প্রতি টন পাল্প পেপারের দাম ছিল ৫৫০ ডলার থেকে ৬০০ ডলার। এই বছর প্রতি টন পাল্পের দাম বেড়ে হয়েছে প্রায় ৮৫০ ডলার থেকে ৯০০ ডলার।
এদিকে গত বছরের জানুয়ারিতে সরকার বিদ্যুৎ, শিল্প ও বাণিজ্যিক (হোটেল-রেস্তোরাঁ) খাতে গ্যাসের দাম ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। বৃহৎ শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ১১.৯৮ টাকা থেকে ৩০ টাকা করা হয়েছে। মাঝারি শিল্পের জন্য গ্যাসের নতুন মূল্য ১১.৭৮ টাকা থেকে ৩০ টাকা নির্ধারণ করেছে।
বাড়তি খরচ সমন্বয়ের জন্য কিছু প্রধান টিস্যু উৎপাদনারী টিস্যু পণ্যের দাম গড়ে ১০-২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
'পণ্যের দাম বাড়ার সাথে সাথে টিস্যু পণ্যের চাহিদা কমে গেছে,' মাজেদুল বলেন।
বিক্রি কম
বসুন্ধরা পেপার মিলসের টিস্যু পণ্যের বিক্রি পরিমাণের দিক থেকে প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে। মূল্যবৃদ্ধির কারণে কোম্পানিটির মোট আয় কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু অতিরিক্ত খরচে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মুনাফা প্রায় অর্ধেকে নেমেছে।
কোম্পানিটির বার্ষিক আর্থিক হিসাব অনুযায়ী, বসুন্ধরা পেপার মিলসের মোট আয় হয়েছে ১ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা এবং মুনাফা করেছে ১৯.১৫ কোটি টাকা। এক বছর আগে কোম্পানিটির মুনাফা ছিল ৪৫.৫০ কোটি টাকা। টিস্যু পণ্য থেকে কোম্পানিটির আয় হয়েছে ৫৭৮ কোটি টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বসুন্ধরা পেপার মিলস ২৪ হাজার ৮৪০ টন টিস্যু পণ্য বিক্রি করেছে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৮ শতাংশ বা ৩ হাজার ৩৮ টন কম।
মাজেদুল বলেন, 'বছরের পর বছর ধরে টিস্যু শিল্পের প্রবৃদ্ধি হয়েছে—বিশেষ করে মহামারির সময় যখন মানুষ এই পণ্যগুলোকে স্বাস্থ্যবিধির জন্য বেছে নিয়েছিল। তবে মূল্যস্ফীতির কারণেও এই পণ্যগুলোর ব্যবহার এখন কমছে।'
বসুন্ধরা পেপার মিলসের রপ্তানিও কমেছে। ২০২২-২৪ অর্থবছরে কোম্পানিটি ১২৫ কোটি টাকার টিস্যু পণ্য রপ্তানি করলেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে করেছে ৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে রপ্তানি কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ।
সোনালী টিস্যু উৎপাদনকারী ইউনুস গ্রুপের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে টিস্যু পণ্যের চাহিদা কমে গেছে।'
তিনি বলেন, ক্রমবর্ধমান উৎপাদন খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে কোম্পানিকে তৈরি পণ্যের দাম বাড়াতে হয়েছে। 'ফলে সোনালী টিস্যুর বার্ষিক বিক্রি প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে।'