ব্যবসার ১৮ বছরে দেড় হাজার কোটি টাকার মালিক কে আর গ্রুপ
২০০৪ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করে বাবার শিপ ব্রেকিংয়ের ট্রেডিং ব্যবসার হাল ধরেন সেকান্দার হোসেন টিংকু। ট্রেডিং ব্যবসার পাশাপাশি তখন ঠিকাদারি বিজনেসও ছিল তাদের। ওই সময় পুরানো শিপের স্টিম ব্রয়লার, জেনারেটর, কমপ্রেসারসহ বড় বড় যন্ত্রপাতি দেশের বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে সরবরাহ করতো।
তবে শুধু ট্রেডিং ব্যবসায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি সেকান্দার হোসেন। ফলে ২০০৮ সালে নিজেকে যুক্ত করেন স্টিল ব্যবসার সাথে। গড়ে তোলেন কিং স্টিলস লিমিটেড। পরের বছর ২০০৯ সালে গড়ে তোলেন কে আর শিপ রিসাইক্লিং ইয়ার্ড।
২০০৬ সালের আগে শিপ ব্রেকিংয়ে সমিতির মেম্বার হওয়াসহ বিভিন্ন জটিলতায় যে কেউ শিপ ব্রেকিং ব্যবসায় আসতে পারতো না। তখন সীমিত আমদানিকারকের কারণে স্ক্র্যাপের দাম হু হু করে বেড়ে চলছিল। পরে ওয়ান ইলেভেনের সময় ২০০৬ সালে শিপ ব্রেকিং ব্যবসা সবার জন্য উন্মুক্ত হয়। সেই সুবাদে শিপ রিসাইক্লিংয়ে যুক্ত হন সেকান্দার হোসেন।
২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত অনেক উদ্যোক্তা লোকসান দিয়ে শিপ ব্রেকিং খাত থেকে বেরিয়ে পড়লেও এই সময়ে ভালো ব্যবসা করেন কে আর শিপ ব্রেকিংয়ের স্বত্বাধিকারী সেকান্দার হোসেন।
এরপর ২০১৪ সালে ১৪৪ শতক জমি নিয়ে সীতাকুন্ডের বাঁশবাড়িয়া এলাকায় কে আর ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নাম দিয়ে গড়ে তোলেন আটা, ময়দা ও সুজির কারখানা। ২০১৫ সালে কে আর ফ্লেক্সি প্যাক লিমিটেড নামে গড়ে তোলেন প্যাকেজিং কারখানা। ২০১৬ সালে গড়ে তোলেন কে আর অক্সিজেন লিমিটেড ও এসএনটি শিপ রিসাইক্লিং লিমিটেড।
এরপর ২০১৭ সালে এবিএস শিপিং লাইনস এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালে গড়ে তোলেন কে আর স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড। এছাড়াও রয়েছে কে আর স্টিল স্ট্রাকচার লিমিটেড এবং কে আর বিল্ডারস লিমিটেড।
গ্রুপটির মাদার কনসার্ন হচ্ছে কে আর স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড। ইনভেস্টমেন্টের দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে কে আর ফ্লেক্সিপ্যাক লিমিটেড। বর্তমানে প্যাকেজিং কারখানার প্রতিমাসে প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি ৫০০ টন। যার মাসিক বিক্রয়মূল্য প্রায় ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকা। আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যে এই কোম্পানির প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি দ্বিগুণের চেয়ে বেশি করার চেষ্টা চলছে।
গ্রুপটির বর্তমানে শিপ ব্রেকিং, স্টিল রি-রোলিং মিল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন ম্যানুফ্যাকচারিং, পলি প্যাকেজিং এবং ফ্লেক্সি প্যাকেজিং, শিপিং লাইনসসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা রয়েছে। এছাড়া গ্রুপটির কার্গো ভেসেল ও টাগ বোটের ব্যবসা রয়েছে। গ্রুপটির কাছে যে মানের টাগ বোট রয়েছে তা দেশে শুধু আরেকটি শিপিং লাইনের কাছে রয়েছে।
২০০৯ সালে সেকান্দার হোসেন যখন শিপ ব্রেকিং ব্যবসা শুরু করেন, তখন কে আর শিপ ব্রেকিংয়ের জনবল ছিল ২৫ জনের মতো। বর্তমানে তিনটি শিপ ইয়ার্ডে ১ হাজার ৭০০ জন লোক ইয়ার্ডে কাজ করে। অন্যান্য কারখানাসহ সব মিলিয়ে বর্তমানে কে আর গ্রুপে ৪ হাজার ৩০০ কর্মী রয়েছে।
বর্তমানে গ্রুপটির প্রতিটি খাতে খুব ভালো ব্যবসা হচ্ছে। বিশেষ করে প্যাকেজিং খাতে ভালো করছে গ্রুপটি। গত দুই বছর করোনাকালীন সময়ে গ্রুপটিতে কোন কর্মী ছাটাই হয় নি। বরং ২০০ এর অধিক কর্মী নিয়োগ পেয়েছে। গত দুই বছর গ্রুপের সব কর্মীদের দুই ঈদে ফুল বোনাস দেয়া হয়েছে, যেটি গ্রস স্যালারির সমান। এছাড়া ওই দুই বছর বেতনের উপর গড়ে ১০ শতাংশের বেশি স্যালারি ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয়েছে।
বর্তমানে কে আর গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ব্যাংক ঋণের পরিমাণ সব মিলে ৫০০ কোটি টাকার নিচে। বর্তমানে ২ হাজার কোটি টাকার এসেট ভ্যালু রয়েছে গ্রুপটির।
গ্রুপটির বর্তমান ব্যবসা সম্পর্কে এই শিল্প উদ্যোক্তা বলেন, করোনা এবং ইউক্রেন সংকটের কারণে বিশ্ববাজারে শিল্পের কাচাঁমালের দাম বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে ফ্রেইট চার্জ ও ডলার মূল্য। যেই কারণে আমদানিকৃত কাচাঁমালের দাম গুনতে হচ্ছে অনেক বেশি। কিন্তু সেই পরিমাণে উৎপাদিত পণ্যের দাম বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না। ফলে প্রফিট মার্জিন কমে গেছে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে স্ক্যাপের মূল্য প্রতি টন ৭১০ ডলার। অন্যান্য খরচ যোগ করে প্রতি টন স্ক্র্যাপ আমদানিতে খরচ পড়ে প্রায় ৬২ থেকে ৬৩ হাজার টাকা। কিন্তু দেশীয় বাজারে সেই দামে স্ক্র্যাপ বিক্রি করা যাচ্ছে না। একইভাবে ফ্লেক্সি প্যাক কারখানাতেও প্রফিট মার্জিন আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে।
খুব দ্রুত এগ্রো বেইসড ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছেন এই তরুণ উদ্যোক্তা। ব্রয়লার, লেয়ার, সোনালী মুরগি, মুরগির বাচ্চা উৎপাদন, ফিড কারখানা গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে সেকান্দার হোসেনের। এর পাশাপাশি পরিকল্পনা আছে ধান চাষ করার। যেখানে কোন বাউন্ডারি থাকবে না, কোন আইল থাকবে না। যেখানে সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। নতুন যন্ত্রপাতি, উচ্চ ফলনশীল বীজ চাষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষ করে পাহাড়ের তলদেশে যেসব জায়গা পড়ে থাকে সেখানে ধান চাষ করার পরিকল্পনা করছেন সেকান্দার। এছাড়া ফার্মা প্যাকেজিং খাতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে তার।
কে আর গ্রুপে বিনিয়োগকারী ব্যাংক এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ভাটিয়ারি শাখার ব্যবস্থাপক সুলতান আলাউদ্দিন বলেন, "দীর্ঘ দিন ধরে কে আর গ্রুপের সাথে ব্যবসা করে আসছি। এতদিনের ব্যবসায় গ্রুপটির কোনো প্রতিষ্ঠান কখনো ঋণ খেলাপি হয় নি। কোন ঋণ রিসিডিউল করতে হয় নি।"
কে আর গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও সেকান্দার হোসেন টিংকু টিবিএসকে বলেন, "ব্যবসা শুরুর দিকটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল ফান্ড গঠন করা। যেহেতু আমি ছাত্র ছিলাম আমার কাছে টাকা-পয়সা তেমন কিছু ছিলোনা। তাই যখনই টাকার জন্য আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধুদের কাছে হাত বাড়ালাম, তখনই বুঝতে পারলাম, হোয়াট ইস কমপ্লেক্সিটি অফ লাইফ!"
"ব্যবসার প্রথম দিকে আমি অনেক টাকা লস করি। পরে আবার টাকা সংগ্রহ করি এবং সেই টাকা দিয়ে দুইটি ম্যাগনেটিক এক্সকাভেটর কিনি। তখন ম্যাগনেটিক এক্সকাভেটরের সংখ্যা অনেক কম ছিল যার কারণে মার্কেট ডিমান্ড ছিল অনেক হাই। এক থেকে দেড় বছরের মাথায় আমি বিনিয়োগের দ্বিগুণ টাকা প্রফিট করি। তখন লোন শোধ করার পরে আমার কাছে টোটাল এমাউন্ট ছিল প্রায় দেড় কোটি টাকা, তারপর থেকে আমাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, শিপ ইয়ার্ড করলাম এবং ব্যাংক লোন নিয়ে শিপ কিনলাম, একের পর এক প্রতিষ্ঠান গড়েছি। ব্যবসার পরিধি বড় করেছি। এখন আমার টার্গেট হলো আগামী দুই বছরের মধ্যে কমপক্ষে ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান করা", বলেন সেকান্দার।