কিছু সমর্থন পেলে, ৬০ হাজার কোটি ডলারের সেমিকন্ডাক্টর বাজারের একটি অংশ আমাদের হতে পারে
১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন মোহাম্মদ এনায়েতুর রহমান। এর পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক অ্যান্ড কম্পিউটার সাইন্সে মাস্টার্স করেন।
মাস্টার্স শেষে যোগ দেন একজন সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইনার হিসেবে যোগ দেন আমেরিকার বিশ্বখ্যাত বহুজাতিক সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি- এএমডি'তে। দীর্ঘদিন সেখানে কাজ করার পর বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং ২০০৮ সালে ঢাকায় মাত্র চারজন ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন তার নিজের সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন কোম্পানি- উল্কাসেমি।
তথ্যউপাত্ত পরিবেশক ওয়েবসাইট স্ট্যাটিসটার সূত্রে জানা যায়, ওই সময়ে বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের বাজার ছিল ২৪ হাজার ৮৫০ কোটি ডলার।
এনায়েতুরকে তাই বাংলাদেশে এ শিল্প প্রতিষ্ঠার একজন অগ্রদূত বলা যায়। তিনি এমন একটি বাজার ধরার উদ্যোগ নেন, যা তার কোম্পানিটি শুরুর দেড় দশকের মধ্যেই ৬০ হাজার কোটি ডলারে রূপ নিয়েছে।
এই প্রকৌশলীকে একজন অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিও বলা যায়। কারণ, ২১ শতকে এসে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত।
সেমিকন্ডাক্টর বা মাইক্রোচিপ; কম্পিউটার, স্মার্টফোন, ওয়াশিং মেশিন, ইলেক্ট্রিক কেতলি থেকে শুরু করে অটোমোবাইল, যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র সর্বত্র ব্যবহৃত হয়। আধুনিক জীবনযাপনের সবখানেই এর রাজত্ব।
প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের উত্থানের হাত ধরে, ভবিষ্যতে মানুষের ব্যবহৃত প্রায় সকল ডিভাইসে এটি সংযোজনের দরকার হবে।
বাংলাদেশে এপর্যন্ত একটি বাজার তৈরিতে-- উল্কাসেমি, নিউরাল সেমিকন্ডাক্টর, প্রাইম সিলিকন ও টোটোন ইলেকট্রনিক্সের মতো নয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদানই বেশি। ২০৩০ সাল নাগাদ মাইক্রোচিপের বৈশ্বিক বাজার সুবিশাল এক লাখ কোটি ডলারের হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ বাস্তবতায় বাংলাদেশের দুটি বড় কোম্পানি- ওয়ালটন ও এসিআই-- এ বাজারে প্রবেশ করার উদ্যোগ নিচ্ছে।
বৈশ্বিক পরামর্শক সংস্থা- ম্যাককিন্সের তথ্যমতে, ২০২১ সালে ২০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে সেমিকন্ডাক্টরের বিশ্ববাজার ৬০ হাজার কোটি ডলারের উন্নীত হয়।
এত বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও, ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের কোনো উল্লেখ ছিল না, আরও ছিল না এটি বিকাশের জন্য কোনো নীতিগত সহায়তার ঘোষণা।
এনায়েতুর রহমান বলেন, "বাংলাদেশেও চিপ প্রস্তুত করা সম্ভব একথা শুরুতে মানুষকে বোঝানোই যেত না। কিন্তু, এখন এ শিল্প বিকশিত হচ্ছে এবং সেজন্য এরদিকে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার।"
এনায়েতুরের কোম্পানিতে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ৩০০ ইঞ্জিনিয়ার। ২০২৪ সাল নাগাদ তিনি ৫০০ জনকে নিয়োগ দিতে চান। এজন্য প্রতিবেশী ভারতের মতো এখাতে সরকারকে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।
বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক বিভাগের অধ্যাপক ড. ফারসিম মান্নান মোহাম্মদী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সেমিকন্ডাক্টর চিপ ডিজাইনের মাধ্যমে বছরে ৫০ লাখ ডলার আয় করে বাংলাদেশ। অথচ প্রতিবেশী ভারতের এখাত থেকে আয় ৬ হাজার কোটি ডলার।"
ঈর্ষণীয় এ অবস্থানে এমনি এমনি পৌঁছায়নি ভারত। মানসম্পন্ন আইটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ভারত সরকার স্থানীয় সেমিকন্ডাক্টর শিল্পকে দৃঢ়ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে গত বছরের ডিসেম্বরে এক হাজার কোটি ডলারের এক সুবিশাল তহবিল ঘোষণা করে।
সরকারিভাবে এমন পদক্ষেপই গ্রহণযোগ্য। কারণ বাংলাদেশের শীর্ষ বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারী পোশাক শিল্পকে বহুদূর পেছনে ফেলে সবচেয়ে বেশি আয়কারী হওয়ার সম্ভাবনায় ভরপুর এই খাত।
ড. ফারসিম বলেন, "বাংলাদেশে আরএমজি সেক্টরে ৪০ লাখ লোক যে আয় করে, সেমিকন্ডাক্টরে এক লাখের কম মানুষ তার চেয়ে বেশি আয় করতে পারবে।"
"বাংলাদেশ থেকে ৫০০ জন ইন্টেলের মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। এটা মেধাপাচার। আমরা যদি এখানেই স্থানীয় শিল্প স্থাপন করতে পারি, এসব দক্ষ লোক দেশে ফিরবে। তবে সরকারের বিশেষ সহায়তা, সুদৃষ্টি ছাড়া এ ধরনের উচ্চ-প্রযুক্তি নির্ভর শিল্প পুরোপুরি বিকশিত হতে পারবে না। কারণ, এ শিল্প প্রতিষ্ঠায় বিপুল বিনিয়োগ দরকার হয়।"
অবশ্য সরকারি কর্মকর্তাদের দাবি, এরমধ্যেই কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকর্ণ কুমার ঘোষ বলেন, "সরকার বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্ক এবং যশোর সফটওয়্যার টেকনোলোজি পার্কসহ সারাদেশে ১০-১২টি বৃহৎ আইটি ভিলেজ, সিলিকন সিটি, ইলেক্ট্রনিক সিটি, আইটি ইনকিউবেটর ও আইসিটি পার্ক স্থাপন করছে। এসব পার্কে বিনিয়োগে কর অবকাশ সুবিধাসহ সহজ শর্তে প্লট দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি উল্কাসেমি বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে জমি নিয়েছে। তাদের সব ধরনের সহায়তা করতে আমরা প্রস্তুত। অন্য কেউ এগিয়ে আসলে তাদেরও সহায়তা করব।"
সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের উত্থান
১৯৮০'র দশকে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি হাব সিলিকন ভ্যালিতে এক দশকের বেশি সময় কাজ করেন দিদার ইসলাম। বছর ১৫ আগে নিজ কোম্পানি পাওয়ার আইসি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনিই হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের সেমিকন্ডাক্টর খাতে প্রথম বিনিয়োগকারী। প্রথমে তিনি একটি ফ্যাব্রিকেশন স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন।
নানা বাধায় এই কাজে সফল হতে পারেননি দিদার। পরে গড়ে তোলেন সোলারিক নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান। কোম্পানিটি বর্তমানে দেশে সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে কাজ করছে। উল্কাসেমি নিয়ে সে তুলনায় বেশি সাফল্য পেয়েছেন এনায়েতুর।
উল্কাসেমির সদর দপ্তর সিলিকন ভ্যালিতে। ২০০৮ সাল থেকে সার্কিট ডিজাইন ও লেআউট নিয়ে কাজ করছে কোম্পানিটি। চিপ নকশা ও ভেরিফিকেশনের কাজে কোম্পানিটি জড়িত হয় ২০১২ সাল থেকে।
যাত্রা শুরুর পর থেকে বাড়তে থাকে তাদের অর্ডার, আর সেসব পূরণ করতে কানাডার টরেন্টো ও ভারতের ব্যাঙ্গালোরে আরো দুটি কার্যালয় খুলেছে উল্কাসেমি।
২০২১ সালে বিশ্বের সেমিকন্ডাক্টর খাতের শীর্ষ কোম্পানি টিএমএসসি'র ডিজাইন সেন্টার অ্যালায়েন্স পার্টনার হয় উল্কাসেমি। বিশ্বের মাত্র ২০টি কোম্পানি টিএমএসসি'র ডিজাইন সেন্টার অ্যালায়েন্সে সম্পৃক্ততার সুযোগ পেয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্কে সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন সার্ভিস এর জন্য আড়াই কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণাও দিয়েছে উল্কাসেমি।
অন্যদিকে, দেশের পোশাক খাতের অন্যতম নেতৃস্থানীয় কোম্পানি- ডিবিএল গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান নিউরাল সেমিকন্ডাক্টর।
২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করে নিউরাল সেমিকন্ডাক্টর। প্রাথমিকভাবে কোম্পানিটি ২০ জন প্রকৌশলী নিয়োগ করেছিল, কিন্তু এখন ১০০ জনের বেশি সেখানে কাজ করছেন। চলতি বছরের মধ্যে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হবে বলে জানিয়েছেন কোম্পানির কর্মকর্তারা।
নিউরাল সেমিকন্ডাক্টরের চিফ অপারেটিং অফিসার শাখাওয়াত হোসেন বলেন, "আমরা বর্তমানে অ্যানালগ ডিজাইন, ডিজিটাল ডিজাইন, ডিজিটাল ভেরিফিকেশন, ফিজিক্যাল এবং টেস্টিং ডিজাইন নিয়ে কাজ করছি। আমাদের প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও মালয়েশিয়ার বিভিন্ন কোম্পানির হয়ে কাজ করছে।"
"প্রাথমিক পর্যায়ে, এই সেক্টরে প্রকৌশলীদের আকৃষ্ট করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। তবে এখনও উচ্চ-মূল্যের বাণিজ্যিক সফ্টওয়্যার, ইলেকট্রনিক ডিজাইন অটোমেশন সরঞ্জাম এবং বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে"- যোগ করেন তিনি।
ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ জব্বার বলেন, "সেমিকন্ডাক্টর সেক্টরের উন্নয়নে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে একটি আধুনিক পাঠ্যক্রমের সংযোজনের সাথে সাথে অত্যাধুনিক গবেষণাগার থাকা প্রয়োজন।"
আসছে ওয়ালটন ও এসিআই
দেশের ইলেকট্রনিক্স জায়ান্ট ওয়ালটন ২০১৮ সাল থেকে কম্পিউটার এবং ল্যাপটপ উৎপাদন শুরু করে। কোম্পানিটি দুটি ভিন্ন লাইনে ডেস্কটপ ও পাঁচটি লাইনে স্থানীয়ভাবে ল্যাপটপ তৈরি করছে। তৈরি করছে গেমিং কম্পিউটারও। এর অনেক আগে থেকেই মোবাইল ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স প্রস্তুত শুরু করে তারা।
কোম্পানিটি নিজস্ব সেমিকন্ডাক্টর খাতে খুব শিগগিরই বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন- এর একজন কর্মকর্তা। এ লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্কে জমিও নিয়েছে কোম্পানিটি।
অবশ্য কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার আগে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি এর কর্মকর্তারা।
ওয়ালটনের মতোই সেমিকন্ডাক্টর খাতে বিনিয়োগের তথ্য রয়েছে দেশের অন্যতম শিল্পগ্রুপ এসিআই নিয়েও। এসিআই গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান- এসিআই ইলেকট্রনিক্সের অধীনে হবে এ বিনিয়োগ।