দুই বছরে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক বেড়ে দ্বিগুণ, লেনদেন তিনগুণ
করোনা মহামারিতে 'ক্যাশলেস ইকোনমি' ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। রীতিমতো বাধ্য হয়েই সবাইকে কেনাকাটা থেকে শুরু করে ব্যাংক লেনদেনের সব কাজ অনলাইনে করতে হয়েছে। সহজে লেনদেন সম্পন্ন করা, সময় ও পরিশ্রম সাশ্রয়, হাতের মুঠোয় লেনদেনের তথ্য পাওয়া সহ নানা কারণে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে ইন্টারনেট ব্যাংকিং বা আই-ব্যাংকিং এ।
গত দুই বছরে আই-ব্যাংকিং এর ব্যবহারকারী বেড়েছে দ্বিগুণ, আর লেনদেন বেড়ে হয়েছে তিনগুণ। করোনার প্রকোপ প্রায় থেমে এসে অর্থনীতি পুরোপুরি সচল হলেও সমানতালে বাড়ছে গ্রাহক ও লেনদেন।
২০০৪ সালে শুরুর দিকে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যালেন্স চেক করার সুবিধা চালু করে এবি ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংক। ধীরে ধীরে অন্য সুবিধাগুলো যুক্ত করা হয়। বর্তমানে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে ব্যালেন্স ট্রান্সফার, বিভিন্ন ফি পরিশোধ, হোটেল-রেস্টুরেন্টের বিল পরিশোধ, বাস-ট্রেন-বিমানের টিকিট কাটা, বিকাশ ও নগদের মতো মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) একাউন্টে ব্যালেন্স ট্রান্সফার সহ নানারকম সুবিধা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
সম্প্রতি জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন জোট 'বেটার দ্যান ক্যাশ অ্যালায়েন্স' ও এটুআই পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে শুধুমাত্র ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হলে তা জিডিপিকে ১.৭% বা ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি বাড়িয়ে দেবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুধু ফেব্রুয়ারি মাসে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬ লাখ ৯৯ হাজার। আগের বছরের ফেব্রুয়ারিতে গ্রাহকের এই সংখ্যা ছিল ৩৩ লাখ ১৩ হাজারের মতো। গত এক বছরে গ্রাহক বেড়েছে ৪১.৮৪%। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রাহকের এই সংখ্যাটি ছিল মাত্র ২৬ লাখ ৫ হাজার। অর্থাৎ, দুই বছরের ব্যবধানে গ্রাহক বেড়েছে প্রায় ২১ লাখ।
শুধু গ্রাহকই নয়, বেড়েছে লেনদেনও। গত ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রাহকদের ৪৪ লাখ ৯৬ হাজার ৯৩১টি লেনদেনের আর্থিক মূল্য ছিল ১৭ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা।
গতবছরের একই মাসে লেনদেন হয়েছিল ৮ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। এক বছরে লেনদেন বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, টাকার অঙ্কে সেটি ৯ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে লেনদেন হয়েছিল তিন ভাগের একভাগ। ওই সময়ে ১৭ লাখ ১৬ হাজার ৩৬২টি লেনদেনে ৬ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা বিনিময় করা হয়েছিল।
সেইসঙ্গে ইন্টারনেট ব্যাংকিংকে আরো সহজ করতে দেশের ব্যাংকগুলোর শতভাগ শাখাই এখন অনলাইনের আওতায় চলে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে বিভিন্ন ব্যাংকের ১০ হাজার ৯৪১টি ব্রাঞ্চের সবগুলোতেই অনলাইন সুবিধা চালু ছিল। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনলাইনের আওতায় ছিল ৯২.৩৫ শতাংশ ব্রাঞ্চ।
বাংলাদেশ ব্যাংকও নীতি সংশোধন করে ভূমিকা রেখেছে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের প্রসারে। গতবছরের সেপ্টেম্বরে ইন্টারনেট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে লেনদেনের সর্বোচ্চ সীমা বাড়িয়েছে তারা। একজন গ্রাহকের দৈনিক লেনদেনের সীমা ২ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে সিঙ্গেল ট্রানসেকশনের সীমা ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে করেছে ১ লাখ। এছাড়া একজন গ্রাহকের দৈনিক সর্বোচ্চ লেনদেন ৫টি থেকে বাড়িয়ে ১০টি করা হয়েছে।
গ্রাহকদের অভিযোগ অনলাইনে এনপিএসবি লেনদেন ঘিরে
অনলাইনে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে টাকা ট্রান্সফার করার জনপ্রিয় মাধ্যম ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশ (এনপিএসবি)। বাংলাদেশ ব্যাংক মধ্যস্ততাকারী হয়ে এই সুবিধাটি গ্রাহকদের দিয়ে থাকে। সাধারণত কোনো গ্রাহক অনলাইনে এই মাধ্যমে ব্যালেন্স ট্রান্সফার করলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তা প্রাপকের একাউন্টে পৌঁছে যায়। তবে অনেকেই এই সুবিধা পেতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন।
গ্রাহকেরা জানান, কিছু কিছু সময় ব্যালেন্স ট্রান্সফার করা হলে তা গ্রাহকের একাউন্টে না পৌঁছালেও প্রেরকের একাউন্ট থেকে টাকা কেটে নেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এক থেকে তিন দিনের মধ্যে প্রেরকের একাউন্টে টাকা ফেরত চলে আসে। তবে বেশ কয়েকজন গ্রাহকের অভিযোগ সেই টাকা ফেরত পেতে তাদের এক সপ্তাহ থেকে এক মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
ইন্টারনেট ব্যাংকিংকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ফেসবুক গ্রুপগুলোতে গ্রাহকদের এমন বেশকিছু অভিযোগ দেখা গেছে। তাদের দাবি, গ্রাহকদের ভোগান্তি কমাতে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
অনলাইনে টাকা ট্রান্সফার প্রযুক্তিগতভাবে সম্পাদিত হয় বলে এতে কদাচিৎ 'ট্রানসেকশন ফেইলর' ধরণের সমস্যা হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ব্যাংক এশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আরফান আলী।
তিনি টিবিএসকে বলেন, "এ বিষয়গুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালিত সিস্টেমের উপরও কিছুটা নির্ভর করে। তবে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যে অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই) রয়েছে, সেগুলো সংরক্ষণ ও ঠিকমতো তত্ত্বাবধান করা ব্যাংকগুলোর নিজস্ব দায়িত্ব।"
"তাতে হয়তো ট্রানসেকশন ফেইলরের মতো ঘটনাগুলো কমে আসবে। তবে রিফান্ডের সমস্যাটি সমাধান করতে বাংলাদেশ ব্যাংককেই উদ্যোগী হতে হবে", যোগ করেন তিনি।