শেষ সময়ে রমরমা জুতার বাজার
পোশাক কেনা হয়েছে। এখন নতুন পোশাকের সঙ্গে প্রয়োজন মানানসই জুতা। তাই শেষ সময়ে পছন্দের জুতা বেছে নিতে ক্রেতাদের ভিড় ছিল মার্কেটে। সঙ্গে পাঞ্জাবি এবং জুয়েলারি দোকানের বেচাকেনাও ছিল রমরমা।
শনিবার (৩০ এপ্রিল) রাজধানীসহ সারা দেশে শপিং মলগুলোতে এ চিত্র দেখা গেছে। শপিংমলসহ ফুটপাতের দোকানগুলোতে দেখা যায়, অনেক বিক্রয়কর্মীই ক্রেতাদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
বিক্রেতারা জানান, রমজানের শুরু দিকে জমে ওঠে জামা-কাপড়ের বাজার। এরপর জুতা, জুয়েলারিসহ আনুষাঙ্গিক বাজার রমজানের শেষ ১০ দিনে জমে উঠেছে।
এবার রোজা ৩০টি হলে ঈদ হবে ৩ মে, মঙ্গলবার। তাই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে অভিজাত বিপণিবিতানে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলছে শেষ সময়ের কেনাকাটা।
ঈদকে কেন্দ্র করে অনেকেই পোশাকের সঙ্গে মিল রেখে জুতা পছন্দ করেন। শনিবার রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, চাঁদনি চক, গাউছিয়া, বসুন্ধরা সিটি, মৌচাক, ধানমন্ডির নূরজাহান মার্কেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের জুতার মার্কেট ছিল ক্রেতাদের পদচারণায় মুখর। তাদের হাতে হাতে নতুন জুতার ব্যাগ।
বসুন্ধরা সিটিতে বাটার শোরুম ইনচার্জ মোহম্মদ মেহেদি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "করোনার আগের স্বাভাবিক সময়ের মতো আমাদের বিক্রি হয়েছে। রমজানের শেষ দশদিন জুতার বিক্রি ভাল হয়।"
১২ বছর বয়সী মাহদি আলি বাবার সঙ্গে বসুন্ধরায় সিটিতে ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছে। মাহদির বাবা মাহবুব আলির হাতে ৪ বক্স জুতা। তিনি বলেন, "এখানে এক জায়গায় অনেক পণ্য পাওয়া যায়, তাই কেরানীগঞ্জ থেকে এসেছি। স্ত্রীর জন্য কিছু প্রসাধনী আর জুতা কিনেছি। ছেলে জন্য ক্যাজুয়াল সু কিনেছি।"
এপেক্স ফুটওয়্যারের দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম বৃহত্তম জুতার শোরুম রয়েছে সুন্ধরা সিটি শপিং মলের লেভেল-৭ এ। গতকাল শোরুম ছিল ক্রেতাদের ভিড়ে জমজমাট। প্রতিটি কাউন্টারেই ছিল দীর্ঘ লাইন।
এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর টিবিএসকে বলেন, "ঈদে আমাদের নতুন কালেকশন ছিল। সেই সঙ্গে গত দুই বছরের মহামারির কারণে বিক্রি কম হওয়ায় যে পণ্য স্টক ছিল সেগুলোও বিক্রি হয়ে গেছে।"
"তবে যখন করোনা ছিল না সেই ঈদের (২০১৯) মতো বিক্রি এখনও পুরোপুরি পৌঁছায়নি। আশা করি বাকি সময়ের কেনাকাটায় সেখানে পৌঁছাতে পারবো। তবে আমাদের আশা ছিল আরও বিক্রি হবে।"
তিনি আরও বলেন, "প্রথম ১০ থেকে ১২ রমজানে ব্যবসা স্লো ছিল, এরপর বিক্রি বেড়েছে। এবার গরম বেশি, এর ফলে ক্রেতারা যেই মার্কেটে সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশনের ভেতরে প্রয়োজনীয় সব পণ্য কেনাকাটার সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই বেশি কিনতে গিয়েছেন।"
সকালে মৌচাক মার্কেটে কথা হয় কুলসুম বেগমের সঙ্গে। তিনি টিবিএসকে বলেন, "কাপড় কেনার পর তার সঙ্গে মিল করে জুতা কেনা হয়। কয়েকটি দোকান দেখে আমার জন্য জুতা কিনেছি। এখন বোনের মেয়র জন্য জুতা কিনবো।"
রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোড জুতার জন্য বিখ্যাত। প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের বাইরেও বিভিন্ন জুতার দোকান রয়েছে এখানে। গতকাল বিকেলে ক্রেতাদের পদচারণায় হাঁটার মতো অবস্থা ছিল না। ক্রেতাদের এমন চাপ ছিল যে, বিক্রেতারা দম ফেলার ফুসরত পাননি।
ঈদে জামা কাপড়ের সঙ্গে কসমেটিকস ও জুয়েলারি কিনছেন নারী ক্রেতারা । ছেলেরা কিনছেন পাঞ্জাবি। মগবাজার আড়ং শোরুম বিকেলে ছিল ক্রেতায় একদম ভরপুর। জুয়েলারি কর্ণারের বিক্রিয় কর্মী মেহেরুন্নেসা বেগম টিবিএসকে জানান, করোনা ছাড়া স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তাদের বিক্রি বেশি হয়েছে।
বিক্রেতারা জানান, ২০ রোজার পর লং পাঞ্জাবির চাহিদা বেশি ছিল। তরুণদের জন্য সেমি লং পাঞ্জাবিটা বেশি চলছে। আর সাদা পাঞ্জাবি সব বয়সের ক্রেতাই পরতে পারে, তাই এর চাহিদাও ছিল বেশি।
দেশী দশ-এর এ্যাডমিন সরিফুজ্জামান রানা টিবিএসকে বলেন, "প্রায় দুই বছর পর আমাদের বিক্রি ভালো হয়েছে। বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের মতো ফিরে এসেছে। এতে আমরা খুশি।"
একই পরিস্থিতি দেখা গেছে ঢাকার বাইরেও।
চট্টগ্রামে ব্রান্ডের শো রুমের পাশাপাশি ফুটপাতের জুতার দোকানে শেষ সময়ে কেনাকাটা জমে উঠেছে। নিউ মার্কেট, আগ্রাবাদ ও জিইসি মোড়ের বিশাল এলাকাজুড়ে জমজমাট জুতার বাজারে ক্রেতাদের ভিড় ছিল উপচে পড়া।
বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ক্রেতারা ভিড় করছেন ঈদের জুতা কেনার জন্য। ফুটপাতের দোকানে ২০০ টাকা থেকে শুরু করে দেড় হাজার টাকা দামের জুতাও বিক্রি হচ্ছে।
ঈদের পাঞ্জাবির সঙ্গে সেন্ডেলের চাহিদা বেশি হলেও কেডস, সু জুতাও বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
বে এম্পোরিয়ামের চট্টগ্রামের ওআর নিজাম রোড শাখার ম্যানেজার মো. শাকিল টিবিএসকে বলেন, "রমজানের শুরুর দিকে বেচাবিক্রি নিয়ে খুব হতাশ ছিলাম। ২২ রমজানের পর থেকে বেচাবিক্রি বেড়েছে।"
ঢাকা বুট বার্ন চট্টগ্রামের জিইসি শাখার ম্যানেজার মোহাম্মদ মনির উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "রমজানের শেষের দিকে মানুষ জামা কাপড় কিনে এখন জুতা কিনছেন। তাই আমাদের বেচাবিক্রি ভালো।"
নগরীর আগ্রাবাদ ফুটপাতের জুতার দোকানী তপন শীলও বিক্রি বেশি হওয়ায় খুশি। টিবিএসকে তিনি বলেন, "মাসের শেষের দিকে মানুষ বেতন-বোনাস পেয়েছেন। মানুষের হাতে এখন টাকা এসেছে। তাই এখন বেচাবিক্রি ভালো হচ্ছে।"
দুপুরে কসমেটিকসের দোকান নগরীর রিয়াজুদ্দিন বাজারের মুখে কাজী স্টোরে গিয়ে দেখা যায় ক্রেতা সামলিয়ে হাপিয়ে উঠছেন বিক্রেতারা। বিক্রয় কর্মী আরিফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "নারীরা ঈদেও কসমেটিকস কেনাকাটা করেন। এবারের রমজানে শুরুর দিকে বেচাবিক্রি কম ছিল। তবে এখন বিক্রি ভালো।"
ঈদের ঠিক আগে আগে বরিশাল শহরের বিভিন্ন জুতার দোকানে বেচাকেনা বেড়েছে। কাতোয়াট্টি রোড, সদর রোড ও হাসপাতাল রোডে ব্র্যান্ডেড এবং নন ব্র্যান্ডেড জুতার দোকানে দেখা গেছে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। এই তিনটি রাস্তাই শহরের জুতা বিক্রির প্রধান কেন্দ্র।
কাটপাটির দোকানদার আল মামুন জানান, "গত এক সপ্তাহ ধরে বিক্রি বাড়ছে। আমাদের দোকানে অনেক ক্রেতা আসছেন তাদের জুতা বা স্যান্ডেল বেছে নিতে। আমি এখন পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ থেকে শতাধিক জোড়া জুতা বিক্রি করেছি।"
বরিশালে অ্যালেক্স জুতার মালিক প্রকৌশলী মো. আমির হোসেন বলেন,"আমার যথেষ্ট বিক্রি করেছি, এখনও খুচরা বিক্রেতারা নিয়মিত জুতা কিনতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। কিন্তু আমি চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে পারছি না, কারণ আমাদের উৎপাদন এখন সীমিত।"
তিনি বলেন, বিভাগের প্রতিটি শহরেই এখন তার পণ্য বিক্রি হচ্ছে।
শহরের অন্যতম জুতা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান কোহিনুর জুতার বিক্রয়কর্মী আব্দুল জলিল বলেন, "আমরা খুব সকালে দোকান খুলি এবং গ্রাহকদের চাহিদার কারণে গভীর রাত পর্যন্ত দোকান খোলা রাখি। আমাদের বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দশগুণ বেড়েছে।"
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নামী ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভালো বেচাকেনা হচ্ছে স্থানীয় পাদুকা কারখানায় উৎপাদিত জুতা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরে প্রায় ১০০ জুতার দোকান রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন নামী ব্র্যান্ডের শো-রুমও আছে। মূলত ২০ রোজার পর থেকে পোশাকের মতো জুতার বাজারও জমে উঠেছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় ব্র্যান্ডের মধ্যে লিগানী সুজ খুবই জনপ্রিয়। বিশেষ করে ছেলেদের জুতার জন্য সুনাম রয়েছে এই ব্র্যান্ডের।
আশিকুর রহমান নামে এক ক্রেতা জানান, তিনি উৎসব ছাড়া বাকি সময়গুলোতেও লিগানীর জুতা পরেন। নামী ব্র্যান্ডের তুলনায় দাম কম, কিন্তু অনেক টেকসই হয় লিগানীর জুতা। সেজন্য এবার ঈদেও লিগানীর জুতা কিনেছেন তিনি।
শহরের নিউ সিনেমা হল রোডের লিগানী সুজের সত্ত্বাধিকারী ফরহাদুল ইসলাম জানান, ২০ রোজার পর থেকে দোকানে বেচাকেনা আশানুরূপ হচ্ছে। ঈদের বাকি দুইদিনে এই বিক্রি আরও বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শ'খানেক পাদুকা কারখানা থেকে এবার ঈদ উপলক্ষ্যে অন্তত ২৫ কোটি টাকার জুতা বাজারজাত হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এতে করে করোনার কারণে গত দুই বছর যে ব্যবসায়ীক ক্ষতি হয়েছে, সেটি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন জেলা পিও ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ।
রাজশাহীর নগরীর বেশ কয়েকটি জুতোর বাজার ঘুরে দেখা গেছে সব দোকানেই ভিড় লেগে আছে। তবে ক্রেতাদের অভিযোগ দাম তুলনামুলক গতবারের চেয়ে বেশি।
সাহেব বাজারে লাকী সু স্টোরের সত্ত্বাধিকারী তারেক জানান, "প্রত্যেকটি চায়না প্রোডাক্টের দাম পিস প্রতি গড়ে ২০০ টাকা করে দাম বেড়েছে। ফলে আমাদেরও বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।"
বগুড়ার ব্যবসায়ীদের হিসাবে শহরে শতাধিক দোকান রয়েছে। এরমধ্যে বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের দোকান রয়েছেন শহরের 'এলিট শ্রেণির' বাজার হিসেবে পরিচিত জলেশ্বরীতলায়।
এখানে বাটার শো রুমের ম্যানেজার সৈয়দ জনির জানালেন, এবার মানুষের মধ্যে করোনার কোনো ভীতি নেই। সবাই কিছু না কিছু কেনাকাটা করছে। তবে প্রতি বছর মানুষের চাহিদা থাকে দামী জুতার ওপর। কিন্তু এবার ২ হাজার টাকার মধ্যে বেশি জুতা কিনছেন ক্রেতারা।
সিলেট নগরের জিন্দাবাজার এলাকার জনতা সুজের সত্ত্বাধিকারী কাইয়ুম আহমদ বলেন, গত ৩ থেকে ৪দিন ধরে ভালো ব্যবসা হচ্ছে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন টিবিএসকে কে বলেন, "এবার আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি বিক্রি হয়েছে। পোশাকসহ সব পণ্য বিক্রি মিলিয়ে পুরো রমজান মাসে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭৫ হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে।"
- টিবিএস চট্টগ্রাম, বরিশাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, বগুড়া ও সিলেট প্রতিনিধিরা এই প্রতিবেদন তৈরিতে অংশ নিয়েছেন।