ভারতের অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহার চায় বাংলাদেশি পাট ব্যবসায়ীরা
পাটপণ্যের উপর আরোপিত অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহার করতে ভারতকে চিঠি দেওয়ার পর নিজেদের পাটশিল্প রক্ষা ও রপ্তানি বাড়াতে এই শুল্ক অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা।
ভারতীয় পাটকল সমিতির (আইজেএমএ) দাবি, বাংলাদেশ সরকারের প্রণোদনা ভারতের পাটশিল্পের জন্য হুমকিস্বরূপ।
তবে এ খাতের বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা বলছেন, ২০১৭ সাল থেকে কার্যকর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক বহাল রাখতে ভারত সরকারের উপর চাপ সৃষ্টিতেই তারা এমনটা বলছে।
নিয়মানুযায়ী, কোনো পণ্যের উপর পাঁচ বছরের বেশি মেয়াদে অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করা যায় না।
বাংলাদেশের পাটপণ্যের উপর আরোপিত অ্যান্টি ডাস্পিং শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য গত মাসে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
বাংলাদেশি পাটপণ্যের উপর ভারতের আরোপিত এন্টি ডাম্পিং শুল্কের মেয়াদ পাঁচ বছর হয়ে যাওয়ায় এর মেয়াদ বাড়াতে সানসেট রিভিউ শুরু করছে দেশটি।
রোববার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডাব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান জানান, ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রীকে লেখা চিঠির কোনো উত্তর আসেনি এখনো।
ভারতীয় সংবাদপত্র দ্য হিন্দুর এক প্রতিবেদনে ভারতীয় পাটকল সমিতির এক বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, "ভারত সরলার অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ না করলে এতোদিনে দেশের পাত খাত ধ্বংস হয়ে যেত"।
বাংলাদেশের পাট খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, এই শুল্ক আরোপের কারণে রপ্তানি কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের পাট শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) ভাইস-চেয়ার ও গোল্ডেন জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মৃধা মনিরুজ্জামান মনির বলেন, "অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কের কারণে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্রমান্বয়ে কমছে। একই দেশের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে দুই ধরনের নীতি থাকতে পারে না। ফিনিশড গুডসে অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটি দেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি কিন্তু নিজেদের মিলগুলোর জন্য তারা র'জুট নিয়ে যাচ্ছে। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি, অ্যান্টি-ডাম্পিং তুলে দেওয়া হোক অথবা র'জুট আমদানির ওপর কর বাড়ানো হোক।"
ভারতীয় পাটকলগুলোর স্বার্থেই বাংলাদেশ থেকে পাট ও পাটপণ্য আমদানিতে দ্বৈতনীতি বাস্তবায়ন করা হয়েছে উল্লেখ করে এই দ্বৈতনীতি প্রত্যাহার অথবা বাংলাদেশে থেকে কাঁচাপাট আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক ট্যাক্স বসানোর দাবি জাানিয়েছেন তিনি।
ভর্তুকির বিষয়ে তিনি বলেন, "রপ্তানিতে সরকার যে প্রণোদনা দিচ্ছে, তা সহায়ক হয়েছে কিন্তু অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কের কারণে ব্যয় বেশি হচ্ছে। এই প্রণোদনা যে বাংলাদেশ-ই শুধু দিচ্ছে এমনটা নয়, ভারত সরকারও তো দিচ্ছে। আমরা তো এটা নিয়ে কোনো অভিযোগ করছি না।"
রপ্তানি উৎসাহিত ও বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার পাটসহ বিভিন্ন পণ্যে নগদ ভর্তুকি প্রদান করে।
২০১৭ সালে ভারত সরকার বাংলাদেশের পাটপণ্য রপ্তানির ওপর প্রতি টনে ১৯ ডলার থেকে ৩৫২ ডলার পর্যন্ত অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে।
ভারতের মিনিস্ট্রি অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের কমার্স ডিপার্টমেন্টের এক নির্দেশনায় বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে রপ্তানি হওয়া পাটের সুতা, হেসিয়ান ফ্যাব্রিক, সেকিং ও সিবিসি এবং পাটের বস্তার উপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করা হয়।
প্রথম দফায় এই শুল্ক আরোপের ৫ বছর মেয়াদ গত জানুয়ারিতে শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় শুল্ক আরোপের মেয়াদ আগামী জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
বার বার অনুরোধ সত্বেও ভারত অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহার না করায় গত বছর ভারতে কাঁচাপাট রপ্তানির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের পরিকল্পনা করছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে কাঁচাপাট রপ্তানির ক্ষেত্রে ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
তবে পাটের উচ্চমূল্য এবং দেশীয় চাষীদের ক্ষতির আশঙ্কা থেকে সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এই শুল্ক প্রত্যাহারের আবেদন জানানো হলেও ভারত সরকার কোনো উদ্যোগই নেয়নি। শুধুমাত্র পাটপণ্যের কাঁচামাল র'জুটকে এই শুল্কের বাইরে রাখা হয়েছে। কারণ ভারতীয় মিলগুলোর প্রয়োজনীয় কাঁচামালের একটি অংশের যোগান দেয় বাংলাদেশের পাটখাতের উদ্যোক্তারা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই শুল্কের কারণে ভারতে পাটপণ্য রপ্তানিতে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, পণ্য আমদানিতে খরচ বেশি হওয়ায় ভারতীয় ক্রেতা হারাচ্ছে দেশের পাট শিল্প।
এরফলে, ভারতে বাংলাদেশের পাটপণ্য রপ্তানি কমছে। অর্ডার না থাকায় অনেক মিল এখন বন্ধ ও কোথাও কোথাও সীমিত পরিসরে উৎপাদন চলছে বলে জানান তারা।
বাংলাদেশ পাটপণ্য রপ্তানিকারক সমিতি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ভারতীয় মিলগুলো চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করতে না পারায় চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়। সরকার তো শুধু ভারতে পণ্য রপ্তানির জন্যই প্রণোদনা দিচ্ছে না। সব দেশের ক্ষেত্রেই দিচ্ছে, এতে ভারতের জুট মিলগুলো কোনো সমস্যা হওয়া কথা নয়।"
"জুট শিল্পের সাথে প্রায় চার থেকে সাড়ে চার কোটি মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। বিশাল সংখ্যক মানুষের জীবিকা ও পাট শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই সরকার ইনসেনটিভ দিচ্ছে। ইনসেনটিভ না দিলে ফ্যাক্টরিগুলো চলানো যাবে না।"
তুলিকা ইকো লিমিটেডের প্রধান কার্য নির্বাহী ইসরাত জাহান চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "ভারত তার বিভিন্ন পণ্যের ওপর যেমন প্রণোদনা দেয়, তেমনি বাংলাদেশও রপ্তানি বৃদ্ধির ও শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রণোদনা দিয়ে থাকে।"
পাট শিল্পকে আরো এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রণোদনা দেওয়া হয়, এটা কোন দেশের সাথে সম্পৃক্ত না। অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ককে ইস্যু করার জন্য এগুলো কেবল-ই অজুহাত বলে মন্তব্য করেন তিনি।