বেকারি ব্যবসা: ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে
করোনা মহামারিতে ১২ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে বেকারি শিল্প। সেই ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন বেকারি খাতের ব্যবসায়ীরা। কিন্তু কাঁচামালের দাম লাগামহীন দামের কারণে আরও গভীর সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এই শিল্প।
গত এক বছরে বেকারি উপাদানের দাম বেড়েছে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত, শ্রমিক খরচ বেড়েছে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত এবং ইউটিলিটি বিল বেড়েছে ১০ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে উৎপাদন খরচ হয়ে গেছে দ্বিগুণ।
কিন্তু কাঁচামালের দাম দ্বিগুণ হলেও বিক্রি কমে যাওয়ার আশঙ্কায় পণ্যের দাম সে অনুপাতে বাড়ানো সম্ভব হয়নি বলে জানান স্থানীয় উদ্যোক্তারা। উল্টো তাদের লাভের মার্জিন কমে এসেছে।
চট্টগ্রামে বেকারি খাতে আদি প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী গণি বেকারী। ১৮৭০ সাল থেকে ব্যবসা করছে তারা। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার নুরল আমিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, 'কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে এখন আমরা প্রতিটি পণ্যে ন্যূনতম ১০ টাকা বেশি নিতে বাধ্য হচ্ছি। এ নিয়ে প্রতিদিন বাকবিতণ্ডায় জড়াতে হচ্ছে।'
তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, 'বিক্রি কমে গেছে প্রায় অর্ধেক। আমরা যদি লাভ করতে না পারি তাহলে কর্মচারিদের বেতন দেব কীভাবে? এভাবে চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।'
সারা দেশে বেকারি কারখানার সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। এসব কারখানায় কাজ করে ২০ লাখ শ্রমিক। মূলত বিস্কুট, কুকিজ, কেক, পাউরুটি, চানাচুর, প্যাটিসসহ নানা ধরনের বেকারি আইটেম তৈরি হয় এসব কারখানায়।
বাংলাদেশ ব্রেড, বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন টিবিএসকে জানান, 'মহামারিতে আমরা ইতিমধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছি। নানা শর্তের কারণে আমাদের কোনো উদ্যোক্তাই সরকারঘোষিত প্রণোদনার ঋণ পায়নি।
'এছাড়াও, বিভিন্ন সময়ে [গত এক বছর ধরে] সমস্ত কাঁচামালের দাম বেড়েছে। সম্প্রতি পাম তেল রপ্তানির উপর ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞা এবং গম রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেছে।'
তিনি আরি বলেন, 'আমরা এখন এক মারাত্মক সংকটে আছি। বিক্রি কমে যাওয়া এবং শ্রম ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় শত শত কারখানা এখন ধসে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তা হলে হাজার হাজার শ্রমিক চাকরি হারাতে পারে।'
টিবিএসের সঙ্গে কথা বলার সময় শিল্প সংশ্লিষ্টরা ইঙ্গিত দেন চলতি মাসেই তারা পণ্যের দাম আরেক দফা বাড়াতে পারেন। এর আগে এ বছরের জানুয়ারিতে তারা পণ্যের দাম বাড়িয়েছিলেন।
চট্টগ্রামের আল-হাসান বেকারির ম্যানেজার মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, 'প্রথম দুই দফা কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির পর আমরা গত জানুয়ারিতে বেকারি পণ্যের দাম সমন্বয় করেছিলাম। কিন্তু চার মাসের ব্যবধানে কাঁচামালের দাম দ্বিগুন হয়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে চলতি মাসের শেষে আবারও দাম সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটি কার্যকর হলে এ মাসের মধ্যে অন্তত ১০ শতাংশ দাম বাড়বে।'
জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ওয়েল ফুডের চেয়ারম্যান সৈয়দ নুরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'আমরা এখনো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। স্টকে থাকা কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদন চালিয়ে নিচ্ছি, কোনো পণ্যের দাম বাড়ানো হয়নি। তবে কাঁচামালের আউটসোর্সিং সম্ভব না হলে পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হবে কোম্পানি।'
বৈশ্বিক উত্তেজনার সঙ্গে আরও ঘনীভূত হচ্ছে সংকট
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে এমনিতেই বাজার ছিল চড়া, এর মধ্যে ভারত গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজারে বেকারি শিল্পের অত্যাবশ্যকীয় এই পণ্যের দাম বেড়েছে লাফিয়ে।
বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, শিকাগোয় গমের মূল্য সূচক ৫ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়েছে, যা গত ২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ বছর সার্বিকভাবে বৈশ্বিক বাজারে গমের দাম ৬০ শতাংশ বেড়েছে। ফলে রুটি থেকে শুরু করে নুডলস পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের খাদ্য উপকরণের দামও বেড়েছে।
অন্যদিকে খাদ্যের বাড়তি মজুদ গড়তে চলতি বছর বৈশ্বিক বাজারের অর্ধেকেরও বেশি গম একাই কেনার পরিকল্পনা করেছে চীন, যা সরবরাহ সংকটসহ দাম আরও উসকে দিচ্ছে।
বসুন্ধরা মাল্টিফুড লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার মো. রেদোয়ানুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিতিশীলতার প্রভাব কতটা ভয়ংকর হয়ে ওঠে, তা আমরা ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রে দেখছি। আমাদের গম আমদানির সোর্সগুলোর মধ্যে এখন কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া বিকল্প হিসেবে রয়েছে। বর্ষাকাল থেকে যখন দেশের ভেতরে আটাসহ বেকারি পণ্যের বাড়তি চাহিদা মেটাতে অতিরিক্ত গম আমদানির প্রয়োজন হবে, তখন থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে গম না পাওয়ার আশঙ্কা করছি আমরা।'
এদিকে ভোক্তারা বলছেন, পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতার সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। কোনো কারণ ছাড়াই তারা হু-হু করে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে বলে অভিযোগ ভোক্তাদের।
কনজ্যুমারস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন মালেক বলেন, 'বাড়তি দামের আটা-ময়দা বাজারে আসার আগেই বেকারি পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। দেশে উৎপাদিত লবণেও যদি আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ানো হয়, তাহলে জনগণ কোথায় যাবে?'
এমনিতেই ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির চাপে নাকাল নিম্ন ও মধ্য-আয়ের মানুষ। এর মধ্যে বেকারি পণ্যের দাম আরেক দফা বাড়ালে এই দামের বোঝাও তাদের ঘাড়েই চাপবে।