'এক বছরে কর ছাড়ের সুফল মেলে না'
স্থানীয় শিল্পের বিকাশে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে উৎপাদন খাতের বেশ কিছু সেক্টরে কর অবকাশ সুবিধা ও ভ্যাট অব্যাহতি দিয়েছে সরকার। করোনার ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য করহার কমানো হয়েছে অনেক খাতে। বাজেটে দেয়া এসব সুবিধার প্রতিফলন নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী। ফোনে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন টিবিএসের সিনিয়র প্রতিবেদক আব্বাস উদ্দিন নয়ন।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার করপোরেট কর ২৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য ২২.৫ ও তালিকা বহির্ভূত কোম্পানির জন্য ৩০ শতাংশ করেছে। এটি আমাদের ব্যবসার জন্য ভালো। তবে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোতে করপোরেট করহার আরো কম। আমাদের প্রস্তাব হলো এ করহার আরো কমিয়ে নিয়ে আসা।
চলতি অর্থবছরে বাজেটে সরকারের আরো একটি বড় উদ্যোগ ছিল 'মেড ইন বাংলাদেশ'কে প্রণোদনা দেওয়া। এর অংশ হিসেবে শত কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগের অটোমোবাইল শিল্পে ২০ বছরের কর অব্যাহতি, ওয়াশিং মেশিন, ব্লেন্ডার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেক্ট্রিক সেলাই মেশিন, ইন্ডাকশন কুকার, কিচেনহুড সহ বিভিন্ন ধরণের হোম অ্যাপ্লায়েন্স উৎপাদনকারী শিল্পে ১০ বছরের কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। স্থানীয় উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে এগ্রো বেইজড ইন্ডাস্ট্রি স্থাপন, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, আইটি হার্ডওয়্যার খাতে ১০ বছরের কর অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ঢাকার বাইরে বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণে দেয়া হয়েছে ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা। নিঃসন্দেহে এসব ভালো উদ্যোগ। তবে এর সুফল পেতে একটু সময় দিতে হবে।
করোনার ভয়াবহতা শেষ হলো কয়েকদিন আগে। করোনার অভিঘাত থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরণের কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারির দাম বাড়তে শুরু করেছে। তেলের দাম বাড়ার কারণে গত দুই বছর ফ্রেইট চার্জ ৮-১০ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। বৈশ্বিক বাজার থেকে কাঁচামাল প্রাপ্তি নিয়েও সংকট তৈরি হয়েছে। এমতাবস্থায় নতুন বিনিয়োগ আসা বেশ কঠিন।
আশার কথা হলো- করোনার আগেই কেউ কেউ এনবিআরের প্রণোদনা দেয়া এসব ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগ শুরু করেছেন। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে এরই মধ্যে অনেকে জমি নিয়েছে। যদিও কেমন বিনিয়োগ হয়েছে বা পরিকল্পনা এসেছে তার পরিমাণ আমাদের কারো কাছেই নেই।
চলতি বাজেটে প্রতিষ্ঠানে মোট এমপ্লয়ির ৫ শতাংশ বা কমপক্ষে ১০০ জন প্রতিবন্ধী বা থার্ড জেন্ডার থেকে নিয়োগ দিলে ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য করপোরেট করে ৫ শতাংশ ছাড় দিয়েছে এনবিআর। তবে এ সুযোগটি দেশের কোম্পানিগুলো কাজে লাগাতে পারেনি। কারণ হলো- কোন প্রতিষ্ঠানে ২০০০ শ্রমিক থাকলে তাকে কমপক্ষে ১০০ থার্ড জেন্ডার নিয়োগ দিতে হবে। আমাদের দেশে এতো বিপুল পরিমাণ থার্ড জেন্ডার খুজে পাওয়া বেশ কঠিন। এখন এনবিআরকে শর্ত সহজ করতে হবে।
মোবাইল, রেফ্রিজারেটর, এসিসহ ইলেকট্রনিক্স খাতে ভ্যাট ছাড়ের সুযোগ চলতি বছরও অব্যাহত রেখেছে সরকার। সব ক্ষেত্রে না হলেও কিছু ক্ষেত্রে এর সুফল মিলছে। এক সময় ফ্রিজ, টেলিভিশন ও এসি আমদানি নির্ভর হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থানীয় শিল্প গড়ে উঠায় এখন আমদানি নির্ভরতা অনেক কমেছে। স্থানীয় শিল্পগুলো বৃহৎ আকার ধারণ করেছে।
স্থানীয় মোবাইল ফোন শিল্পের প্রসারে সরকার কর অব্যাহতির পাশাপাশি ভ্যাটও অব্যাহতি দিয়ে আসছে। স্থানীয় উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এর ফলে স্থানীয় চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ স্মার্ট ফোন ও ৫০ শতাংশ ফিচার ফোনের চাহিদা এখানকার কোম্পানিগুলো পূরণ করছে। এছাড়া দেশীয় জাহাজ শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতির পাশাপাশি ট্যাক্সও কমিয়ে দেয়ার ফলে নতুন করে সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা বেড়েছে।
তরুণ উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের জন্য বাজেটে বিশেষ তহবিল গঠন করা হয়েছে। তবে সুষ্ঠু নীতিমালার অভাবে এ তহবিলের সুফল পাওয়া সম্ভব হয়নি। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ তহবিল বিতরণের জন্য নীতিমালা প্রণয়নের প্রস্তাব করছি। এছাড়া কর ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ, দ্রুত, আধুনিক, যুগোপযোগী এবং সবাইকে কর প্রদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এ ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ডিজিটাল করার প্রস্তাব করছি।
বর্তমান আইনে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিভিন্ন খরচের ওপর মূসকের হার ৫ থেকে ১৫ শতাংশ আরোপিত আছে, এ হার ৩ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা দরকার। কোম্পানির গ্রস প্রফিট (জিপি) খাতভিত্তিক ভাবে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে, যা যুক্তিসঙ্গত নয়। আবার জিপি কমে গেলে অথবা ব্যবসায় লস হলে বিবেচনায় নেয়া হয় না। এমনকি আগের বছরের তুলনায় বিক্রি কম হলেও কর কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় নিতে রাজি হয় না; এ ধারণার সমাপ্তি টানা দরকার। নিবন্ধিত হওয়ার পর মুনাফা অর্জনে নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এসময়ের ব্যয় অথবা লস বিবেচনা করা হয় না; আমি সেজন্য প্রাথমিক খরচের বিষয়টি (কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পূর্বের খরচ) বিবেচনা করার প্রস্তাব করছি।
সর্বোপরি ইনফ্লেশনের কারণে নতুন বাজেটে স্থানীয় শিল্পের সুবিধা আরো বাড়ানো দরকার বলে মনে করছি আমি।