টিআইএন আছে, রিটার্ন দেননি? আগামী অর্থবছরে রিটার্ন দিলে জরিমানা লাগবে না
ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (ই-টিআইএন) রয়েছে কিন্তু আয়কর রিটার্ন জমা দেন না, এমন ব্যক্তিদের আয়করের আওতায় আনতে জরিমানা মাফ করতে যাচ্ছে সরকার। অর্থাৎ আগে যারা রিটার্ন জমা দেন নি, আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে তারা রিটার্ন জমা দিলে অতীতের বছরগুলোর জন্য কোন ধরণের জরিমানা দিতে হবে না। এর ফলে প্রায় ৫০ লাখ টিআইএনধারীর জন্য জরিমানা না দিয়ে হয়রানিমুক্তভাবে ট্যাক্স অথরিটির কাছে তাদের আয়ের হিসাব দিয়ে কর দেওয়ার সুযোগ তৈরি হতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আগামী বাজেটে এ ধরণের প্রস্তাব তৈরি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), যা ৯ জুন অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিতে পারেন।
এমন প্রস্তাব আসলে ইতিবাচক হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, টিআইএন নিলেও হয়রানি ও জরিমানার ভয়ে অনেকে পরবর্তীতে রিটার্ন দিতে আগ্রহী হন না। এনবিআর তাদেরকে জরিমানা মওকুফের মাধ্যমে সুযোগ দিলে তা সময়োপযোগী প্রস্তাব হবে। এতে রাজস্ব আয় বাড়ার পাশাপাশি দেশের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা তৈরির সুযোগ তৈরি হবে।
দেশে বর্তমানে ই-টিআইএনধারীর সংখ্যা ৭৫ লাখের উপরে, যার দুই-তৃতীয়াংশই আয়কর রিটার্ন জমা দেয় না। সর্বশেষ ২০২১-২২ ট্যাক্স ইয়ারে রিটার্ন জমা হয়েছিলো ২৫ লাখের কিছু বেশি। ব্যক্তি হিসেবে, যাদের বছরে আয় আড়াই লাখ টাকার উপরে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে তাদের টিআইএন নেওয়া ও প্রতি বছর আয়ের হিসাব তথা ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এছাড়া ৩৭ ধরণের সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তিনটি খাত বাদে, যাদের রিটার্ন জমা দেওয়ার শর্ত রয়েছে।
এনবিআরের আয়কর বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, টিআইএনধারীদের মধ্যে ২৬ লাখের কোন হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না, যা 'ফাইল্ড কেইস' হিসেবে রাখা হয়েছে। এর অর্থ হলো, এসব টিআইএন বাতিল করা হচ্ছে না, কিন্তু স্থগিত আছে। ভবিষ্যতে কোন ধরণের সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে (যা আয়কর বিভাগের সঙ্গে ইন্টিগ্রেটেড আছে বা থাকবে) তাদেরকে ট্রেস করা সম্ভব হবে।
দুই বছর আগে পর্যন্ত কেবল যাদের করযোগ্য আয় ছিলো, টিআইএনধারীদের মধ্যে কেবল তাদেরই রিটার্ন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিলো। তবে গত দুই অর্থবছর আগে প্রায় সব টিআইএনধারীর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। তা সত্ত্বেও রিটার্ন জমা প্রত্যাশিতহারে বাড়ছে না।
ব্যক্তি করদাতা ছাড়াও দেশে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ এন্ড ফার্মস (আরজেএসসি)-তে প্রায় পৌনে দুই লাখ রেজিস্টার্ড কোম্পানি রয়েছে, যার মধ্যে রিটার্ন জমা দেয় ৩০ হাজারের কম সংখ্যক কোম্পানি।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের বাজেট সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যেসব ব্যক্তি টিআইএনধারী কখনোই রিটার্ন জমা দেননি কিংবা অতীতে দুয়েক বছর রিটার্ন জমা দিলেও বেশ কয়েক বছর ধরে আর রিটার্ন জমা দিচ্ছেন না, আগামী এক বছর রিটার্ন জমা দিলে তাদের উপর অতীতের কোন জরিমানা চাওয়া হবে না।
গত অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট এনবিআরের সাবেক সদস্য মোঃ আলমগীর হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এ ধরণের প্রস্তাব আনা হলে তা খুবই ইতিবাচক হবে করদাতা এবং কর বিভাগের জন্যও। বেশকিছু খাতে টিআইএন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু রিটার্ন আসছে না। যদি রিটার্নই না আসবে, তাহলে টিআইএন নিয়ে লাভ কী? এজন্য মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলো থেকে এক বছরের জন্য জরিমানা মওকুফের প্রস্তাব এসেছিলো।'
'যদি এক বছরের জন্য জরিমানায় অ্যামনেস্টি দিয়ে তাদেরকে রিটার্ন তথা করের আওতায় আনা যায়, তাহলে তাদের সম্পদ বিবরণী এনবিআরের কাছে রেকর্ড হয়ে যাবে। ফলে ট্যাক্স খাতে শৃঙ্খলা আনার সুযোগ তৈরি হবে।
আরেকজন সাবেক এনবিআর সদস্য ড. সৈয়দ মোঃ আমিনুল করিম এ উদ্যোগ নেয়া হলে তা ইতিবাচক হবে উল্লেখ করে বলেন, 'আগে জরিমানা ও কর্মকর্তাদের হয়রানির ভয়ে মানুষ রিটার্ন দিতে আসতে চাইতেন না। কেননা রিটার্ন দিলেই ডিসিটি থেকে জয়েন্ট কমিশনার হয়ে উপরের স্তরে ওই ফাইল যেতেই থাকবে এবং করদাতাকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। এক বছরের জন্য জরিমানা বাতিল করা হলে, এ সুযোগ থাকবে না, ফলে করদাতা ও রাজস্ব বিভাগ– উভয়েই উপকৃত হবেন।'
জিডিপিতে করের অবদান বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম পিছিয়ে থাকা একটি দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশই ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিওতে বাংলাদেশের উপরে অবস্থান করছে। ধীরে ধীরে এতে বাংলাদেশের অবনমন হচ্ছে। একসময় ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও ১০% থাকলেও সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, তা ৮ শতাংশের নিচে নেমে গেছে।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে বলেছিলেন, দেশে অন্তত দুই কোটি মানুষ কর দেওয়ার সামর্থ্য রাখে। অথচ ওই সময় রিটার্ন দাখিলকারীর সংখ্যা ছিল ১৭ লাখের মতো।
আইনে কী আছে আর বাস্তবতা যা বলছে
বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশের ১২৪ ধারা অনুযায়ী, যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া কোনো ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থ হলে আগের রিটার্ন এর অ্যাসেসমেন্টের ১০% বা এক হাজার টাকার মধ্যে যেটি বেশি, ওই পরিমাণ অর্থ এবং প্রতিদিনের জন্য ৫০ টাকা জরিমানা গুনতে হবে।
যেসব টিআইএনধারী কখনোই রিটার্ন জমা দেননি, তাদের জরিমানা পাঁচ হাজার টাকার বেশি হবে না।
অবশ্য এ ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন জরিমানা কী হবে, সে ক্ষমতা ডেপুটি কমিশনার অব ট্যাক্সেস (ডিসিটি)-এর হাতে দেওয়া হয়েছে।
আয়কর বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইনে জরিমানার কথা বলা থাকলেও সর্বনিম্ন কত হবে, সে বিষয়ে কিছু বলা নেই। ফলে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কখনো কখনো তাদের সুবিধামত সিদ্ধান্ত দেন, যাতে করদাতা নাখোশ হন, আবার একেবারে কম জরিমানা করলে কর অফিস থেকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। এই ব্যবস্থায় অনিয়মেরও সুযোগ থেকে যায়।
এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের একজন ডিসিটি নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, সাধারণত নতুন করে রিটার্ন জমা দেওয়া করদাতাদের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়।
সাবেক এনবিআর সদস্য আলমগীর হোসেনও বলেন, কম কর ধরা হলে আবার ওই কর্মকর্তাকে জবাবদিহি করতে হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে।