টিআইএনধারীদের রিটার্নের আওতায় আনতে কঠোর পদক্ষেপ
করের আওতা বাড়াতে সরকার গত কয়েক বছরে বিপুল সংখ্যক মানুষকে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বরের (টিআইএন) আওতায় আনলেও তাদের দুই-তৃতীয়াংশই করের রিটার্ন জমা না দেওয়ায় সরকারের সে উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে আগামী বছর টিআইএনধারীদের রিটার্ন জমার আওতায় আনতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
নতুন বাজেটে, যে সকল ক্ষেত্রে টিআইএন গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে সে সকল ক্ষেত্রসহ আরো কতিপয় ক্ষেত্রে টিআইএনের পরিবর্তে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র উপস্থাপনের বিধান করা হচ্ছে। এছাড়া কোন কর্তৃপক্ষ রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র উপস্থাপনের বিষয়টি ভেরিফাই করতে ব্যর্থ হলে সর্বোচ্চ ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান করা হচ্ছে। তবে আয়কর কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা করলে সর্বোচ্চ ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা আরোপের বিধান করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ মনে করেন, ট্যাক্স বিভাগের বিভিন্ন আইন-কানুন করদাতাবান্ধব না হওয়ায় মানুষ রিটার্ন দিতে উৎসাহিত হয় না। আয়কর আইনের এমন বেশকিছু ইস্যু তুলে ধরে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'ফ্রেন্ডলি এটমোসফিয়ার তৈরি হলে টিআইএনধারীরা রিটার্ন দিতে উৎসাহিত হবেন। কিন্তু ভয়ভীতি দেখিয়ে রিটার্ন জমা বাড়ানো যায় না।'
বর্তমান ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিনেন্স অনুযায়ী, টিআইএনধারী হলে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বিধান রয়েছে। এমপিওভুক্ত স্কুল, পাবলিক ইউনিভার্সিটি, ফান্ড, পার্মানেন্ট এস্টাবলিশমেন্ট ও ফিক্সড বেজ নেই এমন অনিবাসী করদাতা, করযোগ্য আয় নেই এমন করদাতা যারা জমি বিক্রয় বা ক্রেডিট কার্ড এর জন্য টিআইএন গ্রহণ করেছেন, এমন সকল করদাতার আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক নয়।
এছাড়া নতুন বাজেটে, এমপিওভুক্ত স্কুল যাদের ইংরেজি ভার্সন রয়েছে এমন স্কুল ব্যতীত অন্যান্য এমপিওভুক্ত স্কুল, পাবলিক ইউনিভার্সিটি, স্বীকৃত প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন ফান্ড, অনুমোদিত গ্র্যাচুইটি ফান্ড, অনুমোদিত সুপারঅ্যানুয়েশন ফান্ড ও ওয়ার্কাস প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড এবং ফিক্সড বেজ নেই এমন অনিবাসী স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাদের আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা হতে অব্যাহতির বিধান করা হচ্ছে।
বিদ্যমান ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিনেন্স বিধান অনুযায়ী, কন্ট্রাকটর ও সাপ্লায়ারদের এতদিন পণ্য ও সেবার ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে টিআইএন না থাকলে ৫০% বেশি উৎস কর দেওয়ার বিধান রয়েছে। আগামী বছর থেকে এ ধরণের সেবা ক্রয় বিক্রয়ে রিটার্ন জমা দিতে হবে, অন্যথায় মোট উৎস করের ৫০% বেশি পরিশোধ করতে হবে।
যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এতদিন টিআইএন প্রদর্শন করতে হতো, তাদেরও আগামী বছর থেকে রিটার্ন জমার প্রমাণ (রিটার্ন স্লিপ বা সার্টিফিকেট) দেখাতে হবে, অন্যথায় সর্বনিম্ন ৫০০০ থেকে সর্বোচ্চ ২০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হবে।
আগামী ৯ জুন অর্থমন্ত্রীর ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনকালে ফাইন্যান্স বিল-এ এসব প্রস্তাব আসতে পারে।
ছোট করদাতার বিনিয়োগের সুবিধা বাড়ছে, কমবে বড়দের
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রচলিত বিধান অনুযায়ী একজন করদাতার মোট করযোগ্য আয় ১৫ লাখ টাকার অধিক হলে রেয়াতযোগ্য অংকের ওপর ১০% হারে এবং করযোগ্য আয় ১৫ লক্ষ টাকার কম হলে ১৫% হারে কর রেয়াত সুবিধা নিতে পারেন। তবে নতুন বাজেটে একজন করদাতার মোট করযোগ্য আয় নির্বিশেষে রেয়াতযোগ্য অংকের উপর ১৫% হারে কর রেয়াতের বিধান করা।
বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী, রেয়াতযোগ্য অংক হিসেবে মোট আয়ের ২৫% নির্ধারণ করা হলেও নতুন বাজেটে তা মোট আয়ের ২০% নির্ধারণ করা হচ্ছে।
এছাড়াও প্রচলিত বিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল না করলে কর অব্যাহতি বা হ্রাসকৃত হারে কর সুবিধা বাতিল হয়। তবে, নতুন বাজেটে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থ হলে কর রেয়াতের প্রাপ্যতা ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ৭.৫% করা হচ্ছে।
তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল না করলে, উৎসে আয়কর কর্তন ও সংগ্রহের বিদ্যমান বিধানাবলির পরিপালন না করলে কৃষি ও ফার্মিং এর ক্ষেত্র ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে ১ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে টার্নওভার বিশিষ্ট ব্যক্তি করদাতা ব্যতীত অন্যান্য সকল করদাতার আয় ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে না করলে কর অব্যাহতি বা হ্রাসকৃত হারে কর সুবিধা বাতিল হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, মূলত কর রিটার্নকে সহজ করতে তারা এই উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে করদাতাদের সবাই উপকৃত হবেন।
সেবা সরবরাহকারীর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ না থাকালে জরিমানা
কনট্রাকটর ও সাপ্লায়ারদের ক্রয় বিক্রয়ের বিভিন্ন শ্ল্যাবে ২% থেকে সর্বোচ্চ ৭% পর্যন্ত উৎস কর কর্তন করতে হয়। ফিন্যান্স বিলে আলোচ্য প্রস্তাব আসলে এবং তা সংসদে পাশ হলে, আগামী বছর থেকে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে রিটার্ন জমার আওতায় আসতে হবে। ধরা যাক, কোন প্রতিষ্ঠান সাত শতাংশ হিসেবে উৎস কর কর্তন করে ট্যাক্স অথরিটিকে ১০ লাখ টাকা বছরে জমা দিচ্ছে। ওই প্রতিষ্ঠান যদি রিটার্ন জমা না দেয়, তাহলে তাদেরকে আরো ৩.৫% হিসেবে ৫ লাখ টাকা বাড়তি দিতে হবে।
ঢাকার একটি ট্যাক্স জোনের ডেপুটি কমিশনার অব ট্যাক্সেস (ডিসিটি) দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সাধারণত বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে (সাপ্লায়ারদের ক্ষেত্রে) পণ্য সরবরাহ করা হলে তারা ঠিকমতো উৎস কর হিসাব করে এবং দেয়। কিন্তু ছোট প্রতিষ্ঠানের কাছে কিংবা অল্প পরিমাণ, যা কয়েক লাখ টাকা- পণ্য বিক্রয়কালে তারা এই ট্যাক্সের টাকা পরিশোধ করতে চায় না। সেক্ষেত্রে তারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে সমস্যা উভয় পক্ষেরই রয়েছে।
'এখন রিটার্ন জমা দেওয়া প্রয়োজন হলে এতে স্বচ্ছতা আসার সুযোগ তৈরি হবে এবং ধীরে ধীরে এ খাতের লেনদেনে স্বচ্ছতা তৈরি হবে,' বলেন তিনি।
উৎস কর কর্তনকারী সত্ত্বা হিসেবে যুক্ত হচ্ছে চার খাত
এছাড়া সোর্স ট্যাক্স বা উৎস কর কর্তনকারী সত্ত্বা হিসেবে ১৬টি খাতের বাইরে নতুন করে আরো চারটি খাত যুক্ত হতে যাচ্ছে। এগুলো হলো হোটেল, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার এবং পরিবহন সংস্থা, যাদের বার্ষিক টার্নওভার ১ কোটি টাকার বেশি হলে, উৎস কর কর্তন করতে হবে।
সেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সেবার মূল্য ২৫ লাখ টাকার কম হলে ১০% এবং বেশি হলে ১২% হারে কর কর্তনের বিধান রয়েছে। টিআইএন না থাকলে সেবা সরবরাহকারীর নিকট হতে ৫০% বেশি হারে উৎসে কর কর্তনের বিধান রয়েছে।
নতুন বাজেটে, টিআইএন এর পরিবর্তে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দাখিলে ব্যর্থ হলে সেবা সরবরাহকারীর নিকট হতে ৫০% বেশি হারে উৎসে কর কর্তন ও ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে সেবা সরবরাহের বিল গ্রহণে ব্যর্থ হলে ৫০% বেশি হারে উৎসে কর কর্তনের বিধান করা হচ্ছে।
ব্যাংক সুদে বাড়ছে উৎসে কর
বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী, কোম্পানি কর্তৃক অর্জিত ব্যাংক সুদ আয় হতে উৎসে ১০% কর কর্তন করা হয়। টিআইএন না থাকলে তা ৫০% বেশি হবার বিধান রয়েছে।
নতুন বাজেটে উৎসে কর কর্তনের হার ২০% করা এবং টিআইএন এর পরিবর্তে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দাখিলের বিধান করা হচ্ছে।
উৎসে কর কর্তনে ব্যর্থতায় জরিমানা ও বাধাদানে শাস্তি
এ উৎসে কর কর্তন বা সংগ্রহের ব্যর্থতায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির সর্বোচ্চ ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা আরোপের বিধান করা হচ্ছে।
উৎসে কর কর্তন ও সংগ্রহ ভেরিফাই ও এনফোর্স করার লক্ষ্যে উৎসে কর কর্তনকারী ব্যক্তির সংশ্লিষ্ট সকল প্রকার তথ্যে উপকর কমিশনারের অ্যাক্সেস নিশ্চিত করা এবং উক্ত কাজে উপ-কর কমিশনার বাধাগ্রস্ত হলে সর্বোচ্চ ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা আরোপের বিধান করা হচ্ছে।