অনুমোদন ছাড়া বিক্ষোভ ও স্লোগান নিষিদ্ধ করলো তালেবান
সরকারি অনুমোদন ছাড়া কোনো বিক্ষোভ বা কোনো ধরনের স্লোগান ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে তালেবান। আফগানিস্তানে তাদের শাসনের বিরুদ্ধে চলা বিক্ষোভ কমানোর জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে দলটি।
এই কট্টর ইসলামপন্থী দলের নব্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রথম এই আদেশে তালেবানরা প্রতিপক্ষকে সতর্ক করে দেয়, যেকোনো বিক্ষোভের আগে অবশ্যই সরকারের অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় 'কঠোর আইনি পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।'
নতুন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সিরাজউদ্দিন হাক্কানি।
দলটি ক্ষমতায় আসার পর কিছু শহরে তালেবান যোদ্ধা ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে বেশ কয়েকটি সংঘর্ষ ঘটে। এসব সংঘর্ষের বেশিরভাগেই নারীরা ছিল অগ্রভাগে।
এ অবস্থায় রাজধানী কাবুলে সশস্ত্র তালেবানরা একটি ছোট সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করে দেয়। অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব শহর ফৈজাবাদে আরও একটি বিক্ষোভ ভেঙে দেওয়া হয়েছে বলে রিপোর্ট করেছে আফগান সংবাদমাধ্যম।
এর আগে, মঙ্গলবার কাবুল ও হেরাত শহরে শত শত মানুষ বিক্ষোভ করলে বিক্ষোভ স্থলে দুজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
আফগানিস্তানের নতুন অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে তালেবান অনুগতদের নিয়ে। এ সভার সব সদস্যই পুরুষ। তালেবানের এ মন্ত্রিসভা তাদের মধ্যপন্থা ও অন্তর্ভুক্তি নিয়ে পূর্বে দেওয়া প্রতিশ্রুতির তুলনায় ভিন্ন এক রূপ দেখাচ্ছে।
কাবুলের উত্তরে পানশির উপত্যকায় সাম্প্রতিক বিজয়ের পর তালেবান তাদের ক্ষমতার দখল জোরদার করছে, এমন প্রমাণের মধ্যেই বিক্ষোভে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো।
একইসঙ্গে, মানবাধিকার বিষয়ে সঙ্কটময় পরিস্থিতির আরেকটি ইঙ্গিত দেখা যায় গত বুধবার। দেশের মহিলা ক্রিকেট দল-সহ নিষিদ্ধ করা হয় আফগান নারীদের সকল খেলাধুলা।
অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টার এসবিএস'কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তালেবানের সাংস্কৃতিক কমিশনের উপ-প্রধান আহমাদুল্লাহ ওয়াসিক বলেন, নারীদের খেলাধুলাকে উপযুক্ত বা প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয় না।
তিনি বলেন, 'নারীদের ক্রিকেট খেলার অনুমতি দেওয়া হবে বলে মনে করি না আমি, কারণ তাদের ক্রিকেট খেলা প্রয়োজনীয় নয়। ক্রিকেটে তারা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে, যেখানে তাদের মুখ ও শরীর ঢাকা থাকবে না। ইসলাম নারীদের এভাবে চলাফেরা করার অনুমতি দেয় না।'
'এটি মিডিয়ার যুগ, এবং তাদের খেলার ছবি ও ভিডিও ধারণ করা থাকবে, যা অন্য লোকেরা দেখতে পাবে। ইসলাম ও ইসলামি আমিরাত [আফগানিস্তান] নারীদের ক্রিকেট খেলতে দেবে না বা এমন ধরনের খেলাধুলা করতে দেবে না যেখানে তারা পর্দা রক্ষা করতে অক্ষম।'
বুধবার থেকে দায়িত্ব পালন করা নতুন তালেবান সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিরূপভাবে সাড়া দেওয়ায় এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি বলেছেন, বর্তমানের অস্থায়ী আফগান মন্ত্রিসভা তাদের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার নয়। তাছাড়া, ইসলামপন্থী দলটিকে আন্তর্জাতিক বৈধতা ও সমর্থন অর্জন করতে হবে বলেও যোগ করেন তিনি।
জার্মানিতে একটি মার্কিন বিমানঘাঁটি পরিদর্শনের সময় দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেইকো মাসের সঙ্গে একমত হয়ে তালেবান সম্পর্কে এ বক্তব্য দেন ব্লিংকেন। আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাবাসনের জন্য একটি ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয় ওই বিমানঘাঁটি। তিনি তলেবানকে আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে চাওয়া আমেরিকান এবং ঝুঁকিপূর্ণ আফগানদের বহনকারী চার্টার ফ্লাইটের অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানান।
আফগানিস্তান ত্যাগ করতে চাওয়া বিদেশি নাগরিক এবং আফগানদের সহযোগিতা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টার সমর্থক প্রায় ২০টি দেশের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন ব্লিংকেন ও মাস।
মাস বলেন, তালেবানের নতুন সরকার দেশটিতে 'আরও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পাঠানো এবং আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতার সংকেত নয়।' তালেবানদের কাছে এটা স্পষ্ট হওয়া উচিত, আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা তাদের, বিশেষ করে আফগানদের স্বার্থে থাকবে না।
এছাড়া, নতুন সরকারে অন্তর্ভুক্তির অভাব বিষয়ে সমালোচনায় যোগ দিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) বলেছে, তারা নতুন শাসকদের প্রতিশ্রুতি মানতে ব্যর্থ হয়েছে।
একজন ইইউ মুখপাত্র বলেন, 'মন্ত্রিসভার সদস্যদের নামগুলো প্রাথমিকভাবে বিশ্লেষণের পর একে আফগানিস্তানের সমৃদ্ধ জাতিগত ও ধর্মীয় বৈচিত্র্য সম্বলিত অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিল তালেবান।'
এছাড়া, জার্মানি, চীন ও জাপানও বুধবার আফগানিস্তানে তালেবানদের অস্থায়ী সরকার নিয়ে কিছুটা বিরূপ মনোভাব দেখায়।
এদিকে, গত বুধবার তার সরকারের আকস্মিক পতনের জন্য ক্ষমা চান আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। কিন্তু দেশ ছেড়ে পালানোর সময় নিজের সঙ্গে কয়েক মিলিয়ন ডলার নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন তিনি।
টুইটারে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে গনি জানান, তার নিরাপত্তা দলের অনুরোধের প্রেক্ষিতে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি। তাকে বলা হয়েছিল, যদি তিনি সেখানে থাকতেন, তাহলে 'নব্বইয়ের দশকে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মতো' পরিস্থিতি দেখতে হবে তাকে।
তিনি বলেন, 'কাবুল ত্যাগ করা আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষ করা এবং কাবুল ও এ শহরের ৬ মিলিয়ন নাগরিককে বাঁচানোর জন্য এটিই ছিল একমাত্র উপায়।'
আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করা গনি ছিলেন বিশ্বব্যাংকের একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা। টুইটবার্তায় তিনি আরও বলেন, 'দুর্নীতি একটি মহামারির মতো আমাদের দেশকে কয়েক দশক ধরে পঙ্গু করে রেখেছে, এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা ছিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দু।'
বিগত ৪০ বছর ধরে চলা যুদ্ধে ত্যাগ স্বীকার করা আফগানদের প্রশংসা করেন তিনি।
'এটি একটি গভীর দুঃখের বিষয় যে, আমার নিজের অধ্যায়টিও পূর্বসূরীদের মতো স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত না করেই শেষ হয়ে গেল। এটি অন্যভাবে শেষ করতে পারিনি বলে আমি আফগান জনগণের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী,' যোগ করেন গনি।
-
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান