আমাজন বন উজাড়ে পরোক্ষ ভূমিকা রাখছে বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ডসমূহ
প্রাডা এবং জারার মতো বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো তাদের নামীদামী-বিলাসী চামড়াজাত বা লেদার পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে আমাজন রেইনফরেস্ট ধ্বংস করায় ভূমিকা রাখছে। সম্প্রতি নতুন এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।
সাপ্লাই চেইন গবেষণা ফার্ম স্ট্যান্ড.আর্থ(stand.earth) পরিচালিত এই গবেষণায় বলা হয়, ভিএইচএম, প্রাডা, জারা, কোচ, এইচ অ্যান্ড এম, নাইকি, অ্যাডিডাস, নিউ ব্যালেন্স, টেভা, ইজিসি ও ফেন্ডির মত ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো তাদের পণ্যের জন্য যেসব জায়গা থেকে চামড়া সংগ্রহ করে, সেসব চামড়া কারিগরদের কাজের সঙ্গে আমাজন বন নিধনের যোগসূত্র রয়েছে। গত ২৯ নভেম্বর স্ট্যান্ড.আর্থ তাদের এক প্রতিবেদনে বিষয়টি তুলে ধরে।
তবে আমাজন ধ্বংসের সাথে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর সরাসরি সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তা গবেষণায় দেখানো হয়নি, জানিয়েছে সিএনবিসি।
স্ট্যান্ড আর্থের প্রতিবেদনে সহযোগিতা করেছে জলবায়ু নিয়ে কর্মরত অলাভজনক সংস্থা স্লো ফ্যাক্টরি। স্লো ফ্যাক্টরি প্রতিবেদনে লেখে, "আপনি যদি একটা লেদারের জুতা বা বেল্ট পরেন কিংবা লেদারের হাতব্যাগ বহন করেন, তাহলে ধরেই নেওয়া যায় এটি গরুর চামড়া থেকে তৈরি যা আমাজন রেইনফরেস্টকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।"
প্রতিবেদনে ৮৪টি কোম্পানি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে স্ট্যান্ড আর্থ। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, এদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ কোম্পানিই এ বিষয়ে নিয়মভঙ্গ করেছে।
এটি আরও জানায়, বন উজাড় বিষয়ে স্পষ্ট নিয়ম থাকা সত্ত্বেও ২৩টি ফ্যাশন ব্র্যান্ড তাদের নিজস্ব নিয়ম ভঙ্গ করেছে।
বেশিরভাগ ব্র্যান্ডই বেশকিছু ট্যানারি ও উৎপাদনকারীর সাথে চুক্তিবদ্ধ রয়েছে, যারা কিনা আমাজন রেইনফরেস্টে পালিত গরু নিয়ে কাজ করে।
সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের তথ্যানুযায়ী, পঞ্চাশটিরও বেশি ব্র্যান্ডের জেবিএস-এর সাথে সাপ্লাই চেইন সংযোগ রয়েছে। জেবিএস ব্রাজিলের সর্ববৃহৎ চামড়া রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। আমাজনে অবৈধভাবে বন উজাড়ে ব্যস্ত কৃষকদের সাথে এই প্রতিষ্ঠানটির সরাসরি সংযোগ রয়েছে।
ব্রাজিলের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস (আইএনপিই) এর ডেটা থেকে জানা যায়, বিগত ১২ বছরের মধ্যে ২০২০ সালে ব্রাজিলে আমাজন বন নিধনের মাত্রা সর্বোচ্চ। গবাদিপশু পালনকে এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়।
টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বন নিধনের পরিমাণ সামান্য কমে এলেও, ২০১৯ সালে জাইর বলসোনারো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বন নিধনের মাত্রা ৯২ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে।
ব্রাজিলে কৃষি ব্যবসার সাথে জড়িতদের সঙ্গে বলসোনারোর বেশ সুসম্পর্ক থাকায় আমাজন বনকে শোষণের দিকে ঠেলে দিতে দ্বিধা করেননি তিনি। এ কাজ নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়ার জন্য পরিবেশবাদী কর্মকর্তাদের ছাঁটাই, আইন অমান্য ও ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড-এর মতো অলাভজনক সংস্থাগুলোকে আইনি নোটিশ ধরিয়ে দেওয়ার মতো কাজ করেছেন বলসোনারো।
গবেষণার লেখকদের একজন অ্যাঞ্জেলিন রবার্টসন দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এই জরুরি অবস্থার সময়ে যদি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি কোনো ভূমিকা রাখতে চায়, তবে এটাই সুযোগ।"
স্লো ফ্যাক্টরি'র সহপ্রতিষ্ঠাতা সেলিন সেমান বলেন, ব্র্যান্ডগুলোর উচিত এমন জায়গায় বিনিয়োগ করা যারা পরিবেশ দূষিত করবে না। "চামড়া সংগ্রহের জন্য দিনশেষে আমাদের একটা বিকল্প খুঁজতেই হবে যা কিনা প্রাণীজ ও প্লাস্টিকভিত্তিক হবে না", বলেন সেমান।
১ কোটি বছর পুরনো আমাজন বন আজও প্রাণীবৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ যেখানে রয়েছে ৩৯ হাজার কোটি গাছ। বছরের পর বছর ধরে কৃষিজমি, মানুষের বাড়িঘর বা আগুনের ফলে আমাজন বন উজাড় হয়ে চলেছে।
বিশ শতকে আমাজনের মাটির নিচে থাকা খনিজ সম্পদ হুমকির মুখে পড়ে। এ অঞ্চলে অবকাঠামো বাড়তে থাকায় এবং বিত্তবানরা গবাদিপশুর র্যাঞ্চ তৈরি করায় আমাজনের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে।
১৯৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, পেরু, সুরিনাম, কলম্বিয়া, গায়ানা ও ফ্রেঞ্চ গায়ানাজুড়ে আমাজন তার ১০ লাখ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল হারিয়েছে। এর মানে দাঁড়ায়, এক দিনে ২০০,০০০ একর বা প্রতি মিনিটে ৪০টি ফুটবল মাঠের সমান অঞ্চল হারিয়েছে আমাজন।
২০১৮ সালে বিজ্ঞানীরা জানান, আমাজন যদি তার ২৫ শতাংশের বেশি অঞ্চল হারিয়ে ফেলে তাহলে আবহাওয়ার ধরনের কারণে সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্র আরো শুষ্ক হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, আমাজনের বিভাজনের কারণে এটি পুরো বাস্তুতন্ত্রকে পতনের দিকে এগিয়ে নেবে, অর্থাৎ এ অঞ্চলের প্রাণীজগত ধ্বংস হতে থাকবে।
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর লাতিন আমেরিকান স্টাডিসের কোয়ান্টিটেটিভ জিওগ্রাফার রবার্ট ওয়াকার অনুমান করেছে, আমাজন বন নিধনের হার যদি এভাবেই চলতে থাকে তাহলে ২০৬৪ সালের মধ্যে আমাজন পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাবে।