২০২৪ সালে বাংলাদেশের বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা বেড়েছে, তবু দক্ষিণ এশিয়ায় ৩য়
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের গবেষণা কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও ২০২৪ সালে বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার প্রবৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় মন্থর ছিল।
অনলাইন ম্যাগাজিন সায়েন্টিফিক বাংলাদেশ-এর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ১৫ হাজার ৪১৩টি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের প্রকাশনা নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এ অঞ্চলে ভারতের অবস্থান প্রথম ও পাকিস্তান দ্বিতীয়। চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত স্কোপাস তালিকাভুক্ত আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক নথিপত্র নিয়ে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সায়েন্টিফিক বাংলাদেশ।
তবে ২০২৪ সালের বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার সংখ্যা ২০২৩ সালের চেয়ে মাত্র ৩৮৫টি বেশি।
২০২৩ সালে বাংলাদেশি গবেষকদের প্রকাশনার সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ২৮টি, যা ২০২২ সালের তুলনায় ২ হাজার ১৮৫টি বেশি। এর আগে ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ৮৪৩, ২০২১ সালে ১১ হাজার ৪৪৭, ২০২০ সালে ৯ হাজার ১১৬, ও ২০১৯ সালে ৮ হাজার ৩০১টি।
তবে সায়েন্টিফিক বাংলাদেশ-এর সম্পাদক ড. মুনির উদ্দিন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এটি আসলে মন্থর প্রবৃদ্ধি নয়, বরং স্থিতিশীলতা।
তিনি বলেন, করোনা মহামারির সময়ে বৈশ্বিকভাবে, বিশেষত বাংলাদেশে গবেষণা কার্যক্রম ব্যাপক বেড়েছিল। মহামারি-সংক্রান্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা শেষ হওয়ার কারণে প্রকাশনার সংখ্যা এখন স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে এসেছে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে তুলনামূলকভাবে কাছাকাছি অবস্থানে থাকলেও ২০২৪ সালে বাংলাদেশি গবেষকদের প্রকাশনার সংখ্যা পাকিস্তানের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ।
গত বছর ভারতীয় গবেষকরা ৩.৩৪ লাখ বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। পাকিস্তানের সংখ্যা ছিল ৪২ হাজার ৩৫৩, শ্রীলঙ্কার ৪ হাজার ১০৭, নেপালের ৩ হাজার ৯৯৭, আফগানিস্তানের ৭৭০, ভুটানের ২৬৭ ও মালদ্বীপের ১৮৪। ২০২৩ সালে ভারত ও পাকিস্তান যথাক্রমে ২.৯২ লাখ ও ৩৯ হাজার ৯২২টি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেছিল।
স্কোপাসের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি সাইম্যাগো জার্নাল অ্যান্ড কান্ট্রি র্যাঙ্ক অনুসারে, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ৫৪তম অবস্থানে ছিল। ভারত তৃতীয় ও পাকিস্তান ২৬তম স্থানে রয়েছে। এশীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ ১৩তম স্থানে রয়েছে; বাংলাদেশের আগে আছে ভিয়েতনাম।
বিশিষ্ট গবেষকরা বলছেন, গবেষণায় বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার কারণ মূল কারণ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, প্রয়োজনীয় ভৌত সম্পদের ঘাটতি ও সীমিত আর্থিক বরাদ্দ।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াও নিবেদিত গবেষক তৈরির পথে অন্যতম বাধা বলে উল্লেখ করেন তারা।
এ বিষয়ে ড. মুনির উদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার ভিত্তিতে দেশগুলোকে চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে—বিজ্ঞানে উন্নত দেশ, বিজ্ঞান-দক্ষ দেশ, বিজ্ঞান-উন্নয়নশীল দেশ এবং বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকা দেশ। বর্তমানে বাংলাদেশ বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকা ৬৬টি দেশের একটি।'
তিনি আরও বলেন, 'গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ সুরক্ষা, সাইবার নিরাপত্তা, জৈব সুরক্ষা, জলবায়ু সহনশীলতা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, সামরিক শক্তি, সীমান্ত সুরক্ষা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারবে না।'
সৌদি আরবের কাসিম ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. মুনির আরও বলেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে এবং যুবসমাজের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির জন্য বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গত বছর বাংলাদেশের বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা
স্কোপাসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১ হাজার ৫০০টি প্রকাশনা নিয়ে বাংলাদেশের শীর্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান ধরে রেখেছে। আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪১০টি।
১ হাজার ১০০-র বেশি প্রকাশনা নিয়ে এ তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ডিআইইউ)। প্রায় ৯০০ প্রকাশনা নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) তৃতীয় স্থানে রয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আছে চতুর্থ অবস্থানে।
বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার র্যাঙ্কিংয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি পঞ্চম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ষষ্ঠ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তম, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি অষ্টম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নবম ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দশম অবস্থানে আছে।
২০২৪ সালে বাংলাদেশি গবেষকদের প্রকাশনার প্রধান বিষয়গুলো ছিল প্রকৌশল, কম্পিউটার বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান।
প্রতিবেদনটিতে প্রবন্ধের পাশাপাশি কনফারেন্স পেপার, রিভিউ, বইয়ের অধ্যায়, চিঠি, ভুল সংশোধনী, নোট, সম্পাদকীয়, ডেটা পেপার, বই, সংক্ষিপ্ত সমীক্ষাসহ বিভিন্ন ধরনের গবেষণা নথি স্থান পেয়েছে।
তবে ২০২৪ সালে কোনো পেটেন্ট নিবন্ধিত হয়নি। এছাড়া গত বছর প্রথমবারের মতো টেক্সটাইল গবেষণায় প্রকাশনা দেখা গেছে।
২০২৪ সালে গবেষণায় অর্থায়ন করা শীর্ষ ১৫ সংস্থার মধ্যে ১১টিই ছিল বিদেশি সংস্থা।
জাতীয় সংস্থাগুলোর মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় অর্থায়নে প্রথম (সার্বিক তালিকায় দ্বিতীয়) অবস্থানে ছিল। শীর্ষ ১৫ অর্থায়ন সংস্থার তালিকায় একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বুয়েট এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) এ তালিকায় স্থান পেয়েছে।
বাংলাদেশি গবেষকদের প্রবন্ধ প্রকাশ করা শীর্ষ জার্নালগুলো হলো: হেলিয়ন, প্লস ওয়ান, সায়েন্টিফিক রিপোর্টস, আইইইই অ্যাকসেস, হেলথ সায়েন্স রিপোর্টস, সাসটেইনেবিলিটি সুইজারল্যান্ড, আরএসসি অ্যাডভান্সেস, এনভায়রেনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চ।
রিসার্চিফাই-এর তথ্য অনুযায়ী, হেলিয়নের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ছিল ৪; এবং প্লস ওয়ানের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ছিল ৩.১১।
ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর বা জার্নাল ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর (জেআইএফ) হলো একটি মেট্রিক যা একটি জার্নালের আপেক্ষিক গুরুত্ব মূল্যায়ন করে। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে একটি নির্দিষ্ট জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধের গড় উদ্ধৃতির সংখ্যা দেখে ওই জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর নির্ধারণ করা হয়।
স্কোপাস ডেটাবেজ অনুসারে, ২০২৪ সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রংপুরের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক আবু রেজা মো. তৌফিকুল ইসলাম ১০৬টি নিবন্ধ প্রকাশ করে শীর্ষস্থান অর্জন করেছেন।
দ্বিতীয় স্থানে আছেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের এম খালিদ হোসেন এবং তৃতীয় স্থানে আছেন বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, দিনাজপুর-এর আকবর হোসেন।