আশরাফ ঘানি: নায়কোচিত প্রেসিডেন্ট থেকে যেভাবে আফগানদের কাছে খলনায়ক হয়ে উঠলেন
দরিদ্র দেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কীভাবে ঘটাতে হয় দীর্ঘদিন তা নিয়ে গবেষণা করেছেন আশরাফ ঘানি। ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক ফুলব্রাইট স্কলার। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘে চাকরির আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অভিজাত কিছু উচ্চ বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতা করেছেন।
তিনি সহ-গবেষকদের সঙ্গে যৌথভাবে 'ফিক্সিং ফেইলড স্টেটস: অ্যা ফ্রেমওয়ার্ক ফর রিবিল্ডিং অ্যা ফ্র্যাকচারেড ওয়ার্ল্ড" গবেষণা নিবন্ধ লেখেন। যার অর্থ দাঁড়ায়- ব্যর্থ রাষ্ট্রের সংস্কার: একটি ভেঙ্গে পড়া দেশকে কীভাবে পুনর্নির্মিত করা যায়।
এমন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী ঘানিই ছিলেন সম্ভবত সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি যিনি আফগানিস্তানের দুরাবস্থা নিরসনের উপায় জানতেন।
তবে রোববার (১৫ আগস্ট) কাবুল থেকে পালানোর পর থেকে তাঁর বর্তমান অবস্থান নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে রহস্যের ধুম্রজাল। কোন সংবাদে বলা হচ্ছে তাঁকে তাজিকিস্তানে দেখা গেছে, কেউবা দেখার কথা বলছে দুবাই বা ওমানে। রাশিয়ার দাবি, ঘানি চারটি গাড়ি ও একটি হেলিকপ্টার ভর্তি নগদ অর্থকড়ি নিয়ে পালিয়েছেন।
ফলাফল- আফগানদের কাছে তিনি আজ এক খলনায়ক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান থেকে শুরু করে খোদ তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারাই প্রকাশ্যে প্রেসিডেন্টের নিন্দা করেছেন। আত্মগোপনে চলে যাওয়া ঘানি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকারীদের সাথে যোগাযোগের সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।
ক্ষমতা থেকে ঘানির পতন অনেক দিক থেকেই, জনতার ভোটের পরিবর্তে যুদ্ধবাজদের টাকার বিনিময়ে কিনে একটি জোড়াতালি দেওয়া আফগান সরকার প্রতিষ্ঠার মতো ভ্রষ্ট মার্কিন নীতির প্রতিফলন। আশরাফ ঘানি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী পশতুনদের একজন হলেও, দেশের মানুষ তাঁকে বহিরাগত হিসেবেই দেখেছে, নানা মতধারায় বহুধা বিভক্ত গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণের যার কোন রাজনৈতিক কারিশমা নেই। ধীরে ধীরে আরো জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তিনি।
নয়াদিল্লি ভিত্তিক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষণা ফেলো কবির তানেজা বলেন, "আফগানিস্তান শাসনের বাস্তবতার সঙ্গে ঘানি কখনো খাপ খাওয়াতে পারেননি। তিনি বিভিন্ন গোত্র ও উপজাতির প্রতিনিধিত্বকারী যুদ্ধবাজ আফগান নেতাদের বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন।"
২০০১ সালে মার্কিন আগ্রাসনের পরবর্তীকালে সুদীর্ঘ ২৫ বছর পর প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানে ফিরে আসেন আশরাফ ঘানি। তিনি প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের প্রশাসনে টানা দুই মেয়াদ অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তখন থেকেই আন্তর্জাতিক সহায়তা দানকারী সংস্থাগুলোর নয়নের মণি হয়ে ওঠেন। প্রসিদ্ধ আন্তর্জাতিক দৈনিকগুলোর উপ-সম্পাদকীয়তে প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর লেখা নিবন্ধ। এমনকি এক পর্যায়ে তাঁকে জাতিসংঘের পরবর্তী মহাসচিব হিসেবেও বিবেচনা করা হয়েছিল।
২০০৯ সালে নির্বাচনে প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন আশরাফ ঘানি। কিন্তু, জয় পাননি। এরপর, সাবেক যুদ্ধবাজ নেতা থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদলাভকারী আব্দুল রশিম দোস্তাম- এর মতো কিছু প্রভাবশালী আফগান রাজনীতিবিদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাধেন। এবং পরের নির্বাচনে বিজয়ী হন। তবে এই বিজয়ও নিশ্চিত ছিল না। নির্বাচন পরবর্তী বিরোধ নিরসনে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে কাবুল সফরে আসেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। সমঝোতার আওতায় শীর্ষ নির্বাহী পদের বিনিময়ে ঘানির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হন কারজাই। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রণীত আফগান সংবিধানে এ নামের কোনো পদই ছিল না।
২০১৭ সালে বিবিসি'কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উষ্মা প্রকাশ করে ঘানি বলেন, 'তাঁকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজটি করতে হচ্ছে।' তবে তিনি এও দাবি করেন যে, আফগান নিরাপত্তা বাহিনী তালেবানকে কোণঠাসা করে ফেলেছে এবং ২০২১ সালের মধ্যেই জোট বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে পারবে।
তাঁর এ ভবিষৎবাণীও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধাবসানে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তালেবানের সঙ্গে সরাসরি শান্তি আলোচনা শুরু করেন। ট্রাম্প প্রশাসন ওই আলোচনায় ঘানি সরকারকে যুক্ত করেনি।
তারপর চলতি বছর আগামী ৩১ আগস্ট নাগাদ সকল সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কাবুলমুখী তালেবান অগ্রযাত্রার মুখে ক্ষমতা ছেড়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান বারবার আগ্রাহ্য করেন ঘানি।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন ইউরোপে সাবেক আফগান রাষ্ট্রদূত এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের ফেলো ওমর সামাদ বলেন, "ঘানি শান্তির ভনিতা করলেও ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে আসলে তিনি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হোক- এমনটাই চেয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের ব্যাপক প্রাণহানির ঝুঁকি তাঁকে ভাবায়নি। তালেবান আরও হিংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে জেনেও তিনি বিচলিত হননি।"
সামাদের মতে, "তিনি পদত্যাগ করলে তালেবান হয়তো রক্তপাতের ঝুঁকি আছে জেনে-কাবুল দখল করতে আসতো না। এবং সকল পক্ষের অংশগ্রহণে আরও বহুপক্ষের সমন্বয়ে একটি ক্ষমতার পালাবদল দেখা যেত।"
'আমি পালাব না!'
তালেবান যখন রাজধানীর প্রায় উপকণ্ঠে তখনও জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন ঘানি, বলেছেন তিনি ১৯২৯ সালে ব্রিটিশ ভারতে পালিয়ে যাওয়া রাজা আমানুল্লাহ খানের নিয়তি বরণ করবেন না।
আরও আগে গেল ৪ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে যোগদানকালে তিনি দৃঢ়স্বরে বলেন, "আমি পালাব না! আমি নিরাপদ আশ্রয়ে লুকাতে চাই না, বরং শেষপর্যন্ত জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকব।"
এত গালভরা বুলির পর তালেবান যখন পুরো দেশ ঝটিকা অভিযানের মাধ্যমে দখল করতে করতে কাবুলে প্রবেশ করলো- ঘানি তখন নিজের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াটা অনুভব করলেন। পালানোর কয়েক ঘণ্টা আগে সরকারের প্রকাশিত এক ভিডিওতে মানুষের সহায়তার জন্য টেলিফোন হেল্পলাইন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিতে দেখা যায় তাঁকে।
'বিশ্বাসঘাতকতা'
পালানোর পর ফেসবুক পোস্টে ঘানি জানান, তিনি কাবুলে রক্তপাত এড়ানোর জন্যেই দেশ ছেড়েছেন। কিন্তু, এ পদক্ষেপে ক্ষুদ্ধ হয়েছে তাঁর মন্ত্রীসভা।
টুইটারে প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিসমিল্লাহ মোহাম্মদী বলেছেন, "তিনি আমাদের সকলের হাত পেছনে বেঁধে দেশকে বিক্রি করে দিয়েছেন। ঘানি ও তাঁর সহযোগীদের ওপর অভিশাপ নেমে আসুক।"
ঘানির অনুপস্থিতিতে তালেবানের সঙ্গে দোহায় নতুন সরকার গঠনের আলোচনায় বসেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইসহ আফগান রাজনীতিকরা। তাদের মধ্যে অনেক ইস্যুতে দ্বিমত হতে পারে, কিন্তু ঘানি বিদ্বেষের বেলায় দুই পক্ষই এক।
তালেবান মিডিয়া টিমের এক সদস্য আবুদুল হক হামাদ বলেন, "আশরাফ ঘানি নিজ মাতৃভূমি, সরকার ও গোত্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। এমন গাদ্দারীকে সব সময় স্মরণে রাখতে হবে।"
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত