ইউক্রেন ও অভিশংসন নিয়ে ট্রাম্পের ৬৫ মিথ্যাচার
অনেক বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অসততা দেখিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে ইউক্রেনের সঙ্গে লেনদেন ও অভিশংসন প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি যে ব্যাপক মাত্রায় অসততা প্রদর্শন করেছেন, তা বিরল।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইউক্রেন বিতর্কের সূত্রপাতের পর থেকে গত বৃহস্পতিবার মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে শুরু হওয়া অভিশংসনের বিচারপ্রক্রিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, জনতার আদালতে ট্রাম্পের আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রাথমিক কৌশল ছিল বিরামহীন মিথ্যাচার।
গত বছরের জুলাইয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনালাপ, ওই কল নিয়ে অভিযোগ করা হুইসেলব্লোয়ার (সাড়া জাগানো ব্যক্তি) কিংবা ইউক্রেনের সঙ্গে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের মতো কাহিনীর প্রতিটি অংশে মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছেন তিনি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট একই সময়ে এত এত বিষয়ে কপটতা দেখিয়েছেন যে, এর মধ্যে কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা তার রেকর্ড রাখা কষ্টকর।
ইউক্রেন ও অভিশংসন প্রক্রিয়া নিয়ে ট্রাম্প যে অসৎ বক্তব্য দিয়েছেন, তার একটি তালিকা করেছে সিএনএন। গত বছরের মধ্য নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া তালিকায় ৪৫টি ভুয়া বক্তব্য ও ফ্যাক্ট চেক ছিল। পরবর্তী সময়ে আরও ২০টি ভুয়া দাবি যুক্ত করায় মিথ্যা বক্তব্যের সংখ্যা হয়েছে ৬৫। এর বেশ কয়েকটি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনালাপ
১. জেলেনস্কির সঙ্গে জুলাইয়ের আলাপের একটি 'যথাযথ অনুলিপি' প্রকাশ করেন ট্রাম্প। অথচ সেই নথির প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা ছিল, এটি হুবহু অনুলিপি নয়।
২. মার্কিন সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলেক্সান্ডার ভিন্ডম্যান ট্রাম্পের পক্ষ থেকে দেওয়া ফোনালাপের অনুলিপিটিতে একটি শব্দ যোগ করতে চেয়েছিলেন। ট্রাম্পের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, 'তারা শব্দ যোগ করেছে।' যদিও কংগ্রেসে দেওয়া সাক্ষ্যে ভিন্ডম্যান বলেছিলেন, অনুলিপিতে তার প্রস্তাবিত দুটি 'স্বতন্ত্র' পরিবর্তন আনা হয়নি। তবে ভিন্ডম্যান এটাও বলেছিলেন যে, অনুলিপিটি বাস্তবতার নিরিখে সঠিক।
৩. ফোনালাপে জেলেনস্কিকে কোনো কিছু করতে বলেননি বলে দাবি ট্রাম্পের। তবে বাস্তবতা হলো, জেলেনস্কিকে সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলেন ট্রাম্প। ডেমোক্রেটিক পার্টির কম্পিউটার সার্ভার নিয়ে মিথ্যা প্রতিপন্ন হওয়া একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিষয়ে নজর দিতেও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে বলেন তিনি। একই সঙ্গে ট্রাম্প তার নিজ আইনজীবী রুডি গিলানি ও অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বারের সঙ্গে কথা বলতে বলেন জেলেনস্কিকে।
৪. ফোনালাপে ইউক্রেনে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ম্যারি ইয়োভানোভিচকে জেলেনস্কি আকস্মিক সমালোচনা করেন বলে দাবি করেন ট্রাম্প। যদিও আলাপের সময় ইয়োভানোভিচের বিষয়টি প্রথম সামনে এনেছিলেন ট্রাম্প।
৫. ট্রাম্পের বক্তব্য অনুযায়ী, তার ও জেলেনস্কির বক্তব্যের গড়পড়তা অনুলিপি দেখে মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি 'ক্ষুব্ধ' ছিলেন। ট্রাম্পের মতে পেলোসি বলেছেন, "এটা (এই অনুলিপি) তা নয়, যা হুইসেলব্লোয়ার বলেছেন।" যদিও প্রকাশ্যে এমন কোনো কথা বলেননি পেলোসি। তিনি গোপনে এ নিয়ে কথা বলেছেন, তারও কোনো নথি পাওয়া যায়নি। ফোনালাপ নিয়ে তার প্রকাশ্য বক্তব্য ছিল খুবই সমালোচনাত্মক।
৬. ট্রাম্পের দাবি, ফোনালাপের লিখিত কপি দেখে 'সবাই' বলেছে এটি নিখুঁত। ট্রাম্পের অতি আস্থাভাজন কয়েকজন এ বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। তবে নিশ্চিতভাবে সবাই নন।
৭. মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভাষ্য, জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনালাপের বিষয়ে সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মিচ ম্যাককনেল তার সঙ্গে কথা বলেছেন। ম্যাককনেল তাকে (ট্রাম্প) বলেন, "এ পর্যন্ত আমার জানা ফোনালাপগুলোর মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে সাদাসিধে।" তবে ম্যাককনেল বলেছেন, ট্রাম্পের সঙ্গে আলাপ হয়েছে বলে তার মনে পড়ে না।
৮. ট্রাম্পের দাবি, অক্টোবরের শেষের দিকে লোকজন ফোনালাপ নিয়ে আর কথা বলছিল না। কিন্তু অভিশংসনবিষয়ক তদন্তের কেন্দ্রে থাকা ফোনালাপ নিয়ে লোকজন এরপরও কথা বলেছেন।
৯. উইলিয়াম বারকে দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করিয়ে ট্রাম্প নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সংক্রান্ত একটি খবর দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট কল্পিত সূত্রের আলোকে ছাপে বলে ট্রাম্প দাবি করেন। তবে ওয়াশিংটন পোস্ট মনগড়া সূত্র ব্যবহার করেছে এমন কোনো নথি নেই।
১০. মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, গত বছরের ডিসেম্বরে জেলেনস্কি নিশ্চিত করেন, ট্রাম্প কোনো ভুল করেননি। যদিও জেলেনস্কি বলেছেন, ট্রাম্প তার ওপর কোনো চাপ প্রয়োগ করেননি। কিন্তু ট্রাম্প কোনো ভুল করেননি, তা বলেননি জেলেনস্কি।
হুইসেলব্লোয়ার
১. ট্রাম্পের মতে, হুইসেলব্লোয়ার 'একেবারে ভুল'। তবে বক্তব্যের অনুলিপি ও কংগ্রেসে সাক্ষ্যদানকারীদের মতে, হুইসেলব্লোয়ার ব্যাপকমাত্রায় সঠিক ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
২. মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, 'প্রতারণার' জন্য হুইসেলব্লোয়ারকে তদন্তের আওতায় আনা উচিত। কিন্তু জানা মতে, হুইসেলব্লোয়ার এমন কিছু করেননি, যাকে দূরতম পর্যায়ের প্রতারণা বলা যায়।
৩. প্রথম হুইসেলব্লোয়ার, তার সূত্র এবং দ্বিতীয় হুইসেলব্লোয়ার 'গায়েব' হয়ে গেছেন বলে ট্রাম্প দাবি করেন। যদিও এর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ দায়েরের পর হুইসেলব্লোয়ারদের প্রকাশ্যে বক্তব্য দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
৪. হুইসেলব্লোয়ারের কাছে থাকা সব তথ্য মাধ্যমিক ছিল বলে দাবি ট্রাম্পের। কিন্তু গোয়েন্দাদের জন্য ট্রাম্প নিযুক্ত মহাপরিদর্শক মাইকেল অ্যাটকিনসন বলেন, ফোনালাপের তথ্য হুইসেলব্লোয়ার অন্যজনের কাছ থেকে জানেন। তবে হুইসেলব্লোয়ার সন্দেহজনক বেশ কিছু কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সরাসরি জেনেছেন।
৫. হুইসেলব্লোয়ার আট বার ‘কুইড প্রো কিউ’ (কোনো কিছুর বিনিময়ে কোনো কিছু) শব্দ ব্যবহার করেছেন বলে ট্রাম্প দাবি করেন। কিন্তু অভিযোগেই এই শব্দটি ব্যবহার করেননি হুইসেলব্লোয়ার। অথচ হুইসেলব্লোয়ার ট্রাম্পের দাবিকৃত সংখ্যার অনেক কম বার শব্দটি ব্যবহার করেন।
৬. হুইসেলব্লোয়ার 'এখন বাইডেনের হয়ে কাজ করছেন' বলে জানান ট্রাম্প। যদিও এর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
প্রতিনিধি পরিষদের গোয়েন্দা কমিটি প্রধান অ্যাডাম শিফ প্রসঙ্গে
১. মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের গোয়েন্দা কমিটির শুনানিতে ট্রাম্পের কল নিয়ে অতিরঞ্জিত ব্যাখ্যা দিয়ে শিফ 'অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করেছেন' বলে অভিযোগ করেন ট্রাম্প। তবে ট্রাম্পের এ অভিযোগ বাস্তব নয়। কারণ মার্কিন সংবিধান কংগ্রেস সদস্যদের কমিটিতে করা মন্তব্যের জন্য নিষ্কৃতি দেয়।
২. শিফ রাষ্ট্রদ্রোহিতা করে থাকতে পারেন। তবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে মার্কিন সংবিধানে, শিফের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যার মিল নেই।
অভিশংসন প্রক্রিয়া
১. ট্রাম্পের অভিশংসন নিয়ে তদন্তের রুদ্ধদ্বার শুনানিতে রিপাবলিকানদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। অথচ তিনটি কমিটির রিপাবলিকান সদস্যদের শুনানি কক্ষে প্রবেশ করতে দেওয়ার পাশাপাশি সাক্ষীদের প্রশ্ন করতে দেওয়া হয়েছে।
২. অ্যাডাম শিফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রকাশ্য শুনানিতে রিপাবলিকানদের আইনজীবীসহ প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। অথচ রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকে আইনজীবী স্টিভ ক্যাস্টর সাক্ষীদের প্রশ্ন করেছেন।
জো বাইডেন ও তার ছেলে প্রসঙ্গে
১. ছেলে হান্টার বাইডেনের পাশাপাশি জো বাইডেন কমপক্ষে দুটি দেশ থেকে লাখ লাখ ডলার হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন ট্রাম্প। যদিও বিদেশে ছেল হান্টারের ব্যবসায়িক কার্যক্রম থেকে জো বাইডেন কোনো সুবিধা নিয়েছেন, এমন কোনো প্রমাণ নেই।
২. ট্রাম্প বলেন, কোনো কিছু না করেও কয়েকটি দেশের পক্ষ থেকে সম্ভবত লাখ লাখ ডলার পেয়েছেন জো বাইডেন। এটারও কোনো প্রমাণ নেই।
৩. ট্রাম্পের দাবি মতে, ২০১৮ সালে বাইডেনের দেওয়া বক্তব্যের ভিডিওতে দেখা যায়, ইউক্রেনের সঙ্গে তার অতীত কর্মকাণ্ডে দুর্নীতির প্রমাণ আছে। কিন্তু ওই ভিডিওতে দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের আলামত পাওয়া যায়নি।
ইউক্রেনের সঙ্গে লেনদেন
১. ট্রাম্পের দাবি, তিনি ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা পাঠাতে দেরি করেননি। কিন্তু তার প্রশাসন দেরি করেছে।
২. মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনেটররা ইউক্রেনের কাছে একটি চিঠিতে পাঠান, যাতে হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের পক্ষ ডেমোক্র্যাটদের দাবি মেনে না নিলে যুক্তরাষ্ট্রের অসহায়তা প্রত্যাহার করা হবে। অথচ ওই চিঠিতে ইউক্রেনকে কোনো হুমকি দেওয়া হয়নি।
জনমত জরিপ প্রসঙ্গে
১. প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসনের ফলে নিজের পক্ষে জনমত যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে বলে দাবি করেন ট্রাম্প। কিন্তু ট্রাম্পের পক্ষে জনমত উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। উল্টো ইউক্রেন কেলেঙ্কারির পর থেকে তার পক্ষে জনমত কিছুটা কমার নজির পাওয়া যায়।
২. ট্রাম্পের মতে, ট্রাম্পের অভিশংসন ও পদচ্যুতির পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত দেওয়া নিয়ে ফক্স নিউজের জরিপ সঠিক নয়। কিন্তু ফক্স নিউজ বলেছে, তাদের জরিপ ঠিক আছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ম্যারি ইয়োভানোভিচ প্রসঙ্গে
ট্রাম্পের মতে, কূটনীতিক হিসেবে ইয়োভানোভিচ যেখানে গেছেন, সেখানকারই পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। ইয়েনোভিচ সোমালিয়ায় গিয়ে সেখানকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছেন। কিন্তু ট্রাম্পের এ বক্তব্যের কোনো ভিত্তি নেই।