ইরানি বিজ্ঞানীর হত্যাকারী কে, তার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ তাকে হত্যা করা হলো কেন?
গত শুক্রবার গুপ্তহত্যার শিকার হন শীর্ষ ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিজাদেহ। প্রকাশ্য দিবালোকে এই হামলা কে করেছে বিশ্ববাসী সেটা এখন ভালো করেই জানে। কিন্তু, ইসরায়েল প্রকৃত কোন উদ্দেশ্য হাসিলে এমন আততায়ী অভিযান চালালো তা নিয়ে বিশ্লেষক মহলে চলছে তুমুল বিতর্ক।
দায় স্বীকার বা অস্বীকার কোনটাই না করার অতীত ধারাবাহিকতা থেকেই বিশ্লেষকরা নিশ্চিত ইসরায়েলি গুপ্তচরেরা গোপন এ অভিযানে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। কিন্তু, এর মাধ্যমে ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতিনিয়াহু কোন লক্ষ্যটি অর্জন করতে চাইছেন; সেটাই হয়ে উঠেছে বিতর্কের বিষয়।
তিনি কী ইরানকে সামরিক আঘাত হানার উস্কানি দিলেন? কারণ, ইরান যদি ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে কোনো হামলা চালায় সঙ্গেসঙ্গেই তার মাধ্যমে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির উপর মার্কিন প্রশাসনের সাম্প্রতিক কঠোর অবস্থান গ্রহণযোগ্যতা পাবে। ট্রাম্প প্রশাসনের শেষ সময়ে এমন হামলা ওয়াশিংটনকে দেশটির বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার উৎসাহও যোগাবে।
ইসরায়েলের জন্য এমন অনেক সুবিধা অর্জনের পথই খোলা আছে। তবে, নব-নির্বাচিত মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ট্রাম্প বিশ্ব শক্তিগুলোর সঙ্গে স্বাক্ষরিত ইরানের পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করলেও, ওবামা আমলে স্বাক্ষরিত ওই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ফেরানোর কথা বলেছেন জো বাইডেন। তবে কী সেই কূটনীতি বাধাগ্রস্ত করতেই মোহসেন ফখরিজাদেহ হত্যাকাণ্ড?
নাকি তার মতো মেধাবী বিজ্ঞানীকে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়ে- তা হারাতে চাননি নেতিনিয়াহু। কারণ, ২০০৩ সালে স্থগিত হওয়া ইরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রকল্পে ফখরিজাদেহ-ই নেতৃত্ব দেন। তার অনুপস্থিতি দেশটির পরমাণু উচ্চাভিলাষে বাধা দেবে এবং ওয়াশিংটনের ভয়ে ইরান আক্রমণ চালানো থেকে বিরত থাকবে- এমন বিশ্বাস থেকেই তাকে হত্যার সবুজ সংকেত দেয় তেল আবিব?
এখন পর্যন্ত ইরান সংযতই আছে। নেতিনিয়াহু কী তবে পাশার দানে সঠিক চাল দিয়েছেন?
এসব তত্ত্বের প্রতিটির পেছনে বাস্তবসম্মত আছে যুক্তি। এবং যেকোনো একটি কারণ এই হত্যাকাণ্ড সংগঠনের নেপথ্যে কাজ করতে পারে। নাকি এসবের সম্মিলিত প্রভাবেই সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়?
ইসরায়েলের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও সামরিক বাহিনীর সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতে, নেতিনিয়াহু একজন অতি-সতর্ক রাজনীতিবিদ। কিন্তু, আচমকা সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতাও তার স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে, বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে আঘাত হানার সুযোগ পেলে, তিনি সহজে তা হাতছাড়া করেন না।
তাই তার প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝতে হলে, বর্তমান পরিস্থিতির দিকেও এক নজর দেওয়া দরকার।
সম্প্রতি নিজ দেশের মধ্যেই দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে আইনি চাপ মোকাবিলা করছেন নেতিনিয়াহু। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ময়দানেও তিনি কিছুটা অসুবিধাজনক অবস্থায়। এরমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে আবার চলছে কূটনীতিক জোট তৈরির এক পালাবদল। উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সঙ্গে সখ্যতা গড়ছে ইসরায়েল।
তবে সবচেয়ে বড় অনুঘটক হতে পারে ট্রাম্প শাসনামলের বিদায় ঘন্টা। বাইডেন ইরানকে কূটনীতির মাধ্যমে বিরোধ নিরসনের সুযোগ দিতে চেয়েছিলেন। তাই ইসরায়েলি নিরাপত্তা পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, এই সুযোগে ইরানকে আগ্রাসী করলে তাতে ক্ষমতা ছাড়ার আগেই দেশটির পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালানোর নির্দেশ দিতে পারেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের ইরান ডেস্কের সাবেক প্রধান ইয়োল গুজানস্কি বলেন, 'গত দেড় মাস ধরে বিবি (নেতিনিয়াহু) ইরানের প্রতি বারবার সতর্ক করে বলে আসছিলেন, ইসরায়েলের উপর কোনো প্রকার পাল্টা-হামলা চালানো হলে মধ্যপ্রাচ্যে মহাপ্রলয় বেঁধে যাবে। তিনি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই এমন হুঁশিয়ারি দেন।''
ট্রাম্প ক্ষমতা ছাড়ার আগে কী করবেন তা কেউ জানেনা। এমন ইঙ্গিতও দিয়েও ইরানকে ভয় দেখান তিনি।
নেতিনিয়াহু বিদেশি শত্রুকে ঠিক সেই মুহূর্তেই এমন খোঁচানো শুরু করেন যখন দেশের ভিতরে তার জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামে। তার অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় ইসরায়লে দুর্দশায় পড়েছে এমন অভিযোগ উঠেছে। জেরুজালেমের একটি আদালতে তার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের দায়েও মামলা চলছে।
নেতিনিয়াহু বোকা নন। তিনি জানেন, এই অবস্থায় ইসরায়েলের এক নম্বর শত্রু ইরানকে উস্কে দিতে পারলেই জনসমর্থন তার পক্ষে ফিরে আসতে বেশি সময় লাগবে না।
এমন অভিমত পোষণ করেন ইসরায়েলের প্রাক্তন সহকারী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা চাক ফ্রেইলিখ।
তিনি বলেন, ''সাধারণত বিবি (নেতিনিয়াহু) সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে খুব সতর্ক সিদ্ধান্ত নেন, এটাই সত্য। কিন্তু, যখন একাধিক কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন এবং তার সাথে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উপায় তার সামনে আসবে, তখন তিনি কী করতে পারেন? তিনি তখন এমন নাটকীয় কোনো পরিস্থিতি তৈরি করবেন; যার মাধ্যমে নিজেকে অদ্বিতীয় রাষ্ট্রনেতা হিসেবে সবার কাছে তুলে ধরা যায়।''
ফখরিজাদেহ হত্যার পেছনে তাই একাধিক অনুঘটককেই প্রধান চালিকাশক্তি মনে করছেন এ বিশেষজ্ঞ।
ওদিকে ইরান তার শহীদ বিজ্ঞানীকে সমাহিত করেছে এবং তার জানাজা থেকেই উঠেছে প্রতিশোধের আহ্বান। ইরানি নেতারা কঠোর প্রতিশোধ নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন এমন অবস্থায় পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে কোনো সমঝোতা হওয়া সম্ভব নয়।
ফ্রেইলিখ মনে করেন, এই সুযোগে ইরানের পরমাণু স্থাপনা ধ্বংসে যুক্তরাষ্ট্রকে বাঙ্কার বিদ্ধংসী বোমা ব্যবহার করার প্ররোচনা দিতে পারবেন নেতিনিয়াহু। আর সেটা করা যাবে বাইডেন পেন্টাগনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার আগেই। ইরানের পরমাণু জ্বালানি তৈরির সেন্ট্রিফিউজ ট্রাম্প হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে দিলে, তাতে বাইডেন আমলে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার ঝুঁকিও চিরতরে দূর হবে।
- সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট অবলম্বনে