এভারেস্টে ওঠার নতুন পথ আবিষ্কার, বিপজ্জনক খুম্বু তুষারপ্রপাত এড়াতে পারবেন আরোহীরা
পাহাড়ের বুক চিড়ে নামা উত্তাল ঝর্ণার স্রোত দেখে মানুষের মুগ্ধতা যুগ যুগের। কিন্তু, ঝর্ণা যদি হয় জমাট তুষারের তাহলে পর্বতারোহীদের জন্য রীতিমত আতঙ্কের। মাউন্ট এভারেস্টে উঠতে নেপালের দিকে যে পথটি সেখানেই রয়েছে বিপজ্জনক খুম্বু তুষারপ্রপাত। প্যাসেজটি এতই কুখ্যাত যে, পর্বতারোহনে সুদক্ষ শেরপারাও রৌদ্র্য ঝলমল দিনে এপথে পা মাড়ানোর সাহস করেন না।
খুম্বু তুষারপ্রপাতকে এভারেস্টের বুকে এক জমাট নদী বা হিমবাহ বলাই যায়। প্রায় এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ পথ সাধারণত রাতে বা ভোর বেলায় পাড়ি দেন পর্বতারোহীরা। আলোর অভাব দূর করে হেলমেটে লাগানো হেডল্যাম্প। বলাই বাহুল্য, অন্ধকারের বুক চিড়ে এভাবে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতে ওঠাও কম ঝুঁকিপূর্ণ হয়। প্রতি মুহূর্তেই থাকে ভুল পদক্ষেপের শঙ্কা। তবুও এটাই তুলনামূলক নিরাপদ।
কারণ রোদের তাপে তুষারপ্রপাতের বরফ অস্থিতিশীল হয়, এজন্য সুর্য বিদায় নেওয়ার অনেক পরে মধ্যরাত্রি ৩টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই খুম্বু প্যাসেজ পাড়ি জমানোর নিয়ম। এসময় ঝুলন্ত হিমবাহগুলো তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকে, তুষার ধসের ঝুঁকিও থাকে কম।
অপরদিকে দিনের বেলায় সুর্যের দেখা মিললে হিমরাজ্যের পর্বতের বুকে স্বস্তির উষ্ণতা ছড়ালেও, সেই তাপে গলতে পারে হিমবাহ। তুষারের আচ্ছাদন ফেটে বাড়ে ধসের ঝুঁকি।
২০১৪ সালের ১৮ এপ্রিল ঘটেছিল এমনই এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। হিমবাহের উঁচু বরফচূড়া বা সেরাক ধসে তার নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারান ১৬ জন শেরপা গাইড। ওই ঘটনার পর সেবছরের সকল অভিযাত্রা বাতিল করেছিল নেপাল সরকার।
হিমালয় পর্বতমালায় অভিযানের তথ্য সংরক্ষণের তথ্যকোষ হিমালায়ান ডেটাবেজ অনুসারে, ১৯৫৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তুষারধসে ৪৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
তবে সুখবরও আছে। ফরাসি-নেপালি একটি যৌথ দল সম্প্রতি বিপজ্জনক খুম্বু তুষারপ্রপাত এড়িয়ে এভারেস্ট চূড়ায় ওঠার বিকল্প একটি পথ আবিষ্কারের দাবি করেছেন। তাদের আবিষ্কৃত পথ নিরাপদ হলে তা হবে পর্বতারোহনের ইতিহাসে যুগান্তকারী এক ঘটনা। কারণ, প্রায় সাত দশক আগে এডমুন্ড হিলারি ও শেরপা তেনজিং নোরগে এভারেস্ট শৃঙ্গ জয়কারী প্রথম মানুষ হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখান। তারা দক্ষিণপূর্ব খাদের পথ ধরে আরোহণ করেছিলেন, পরবর্তী অভিযাত্রীরা এই পথ ব্যবহার করে আসছেন।
কিন্তু, এখানেই ৫ হাজার ৫০০ মিটার থেকে থেকে ৫ হাজার ৮০০ মিটার পর্যন্ত উচ্চতায় বিস্তৃত খুম্বু তুষারপ্রপাত। এভারেস্ট বেজ ক্যাম্পের ঠিক উপরেই এর অবস্থান। প্রতি বছর বসন্তকালীন অভিযাত্রা মৌসুমে এর নিচেই অস্থায়ী তাঁবু গড়েন শত শত আরোহী। তাই আরোহীদের সামনে প্রথম বড় চ্যালেঞ্জই হলো প্রাণঘাতী খুম্বু তুষারপ্রপাত।
নতুন পথের সন্ধান পাওয়া অভিযাত্রী দলের সদস্য ও বিখ্যাত ফরাসি পর্বতারোহী মার্ক বাটার্ড কাঠমান্ডু পোস্টকে বলেন, 'গেল নভেম্বরে আমরা কুখ্যাত খুম্বু তুষারপ্রপাত এড়িয়ে যাওয়ার একটি বিকল্প পথে আরোহণের পরীক্ষা চালাই। পথটি বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক কিনা তা জানতে আগামী বছর বসন্ত মৌসুমেও এই পথে যাব আমরা। এটি জীবন রক্ষাকারী বিকল্প হবে বলে আমরা আশা করছি।'
মার্ক বাটার্ড অতীতেও ইতিহাস গড়েছেন। ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি বোতলজাত অক্সিজেনের সাহায্য ছাড়াই এভারেস্ট চূড়ায় আরোহণ করেন। এজন্য তার সময় লেগেছিল ২২ ঘণ্টা ২৯ মিনিট। এঘটনায় তিনি গিনেস বুক অব রেকর্ডসেও নাম লেখান। এরপর ১০ বছর পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল তার এ রেকর্ড। ১৯৯০ সালে তিনি দ্বিতীয়বার এভারেস্ট চূড়ায় ওঠেন।
তিন দশক পর যেন নতুন রেকর্ড গড়তেই এভারেস্টের কোলে ফিরেছেন ৭০ বছরের বাটার্ড। এবারের লক্ষ্য অবশ্য আবিষ্কার।
তিনি বলেন, 'আরোহীদের জীবন রক্ষাই আমার এবারের মিশন। বিকল্প পথটি বাণিজ্যিকভাবে অভিযান উপযোগী হবে বলে আমি নিশ্চিত।'
আসছে বসন্তে তাই আবিষ্কৃত নতুন পথে আবারো চূড়ায় উঠতে চান বাটার্ড। সফল হলে তিনিই গড়বেন বোতলজাত অক্সিজেন ছাড়া সর্বোচ্চ পর্বত চূড়ায় পা রাখা সর্বজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির রেকর্ড।
বর্তমানে এভারেস্ট চূড়ায় বোতলজাত অক্সিজেন ছাড়াই ওঠার রেকর্ড ইতালিয় নাগরিক অ্যাবেলে ব্রাঙ্কের দখলে। ২০১০ সালে তিনি ৫৫ বছর ২৬৪ দিন বয়সে এই রেকর্ড গড়েন।
সূত্র: কাঠমান্ডু পোস্ট