গড়ে প্রতিদিন ১৫টি অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন ট্রাম্প
ইরানের বিপ্লবী গার্ডস কমান্ডার কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার পেছনে যুক্তি হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, সোলেইমানি মার্কিন কূটনীতিক ও সামরিক সদস্যদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছিলেন। আর তাই মার্কিন সামরিক বাহিনী হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করেছে।
সোলেইমানি যে আক্রমণের পরিকল্পনা করছিলেন- এমন তথ্য কোথায় পেলেন ট্রাম্প? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। তার এই বক্তব্য নিয়ে সন্দেহ করছেন খোদ মার্কিন নাগরিকরাই। আর এই সন্দেহও অমূলক নয়।
সম্প্রতি মার্কিন তথ্য বিশ্লেষক দল ফ্যাক্ট চেকার্স ডাটাবেজ ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিটি সন্দেহজনক বিবৃতি অনুসরণ এবং বিশ্লেষণ করে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩ বছরে প্রতিদিন গড়ে ১৫টির বেশি বানোয়াট ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার করেছেন ট্রাম্প।
আর নির্বাচন যতো এগিয়ে আসছে, বানোয়াট তথ্য প্রচারণার মাত্রা যেন বেড়েই চলেছে।
২০১৭ সালে দুই হাজারটি বিভ্রান্তিকর মন্তব্য ও তথ্য প্রচার করেন ট্রাম্প । ২০১৮ সালে তিনি এই ভুয়া তথ্যের তালিকায় যুক্ত করেছেন আরও পাঁচ হাজার ৬৮৯টি। অর্থাৎ এক বছরে সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ- সাত হাজার ৬৮৮টিতে।
আর ২০১৯ সালে ভুয়া বা বিভ্রান্তিমূলক দাবির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে সেগুলোরও দ্বিগুণ। গত ১০ ডিসেম্বর ছিল প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার ১০৫৫তম দিন। অর্থাৎ প্রায় তিন বছরে মোট ১৫ হাজার ৪১৩টি ভুয়া তথ্য দিয়েছেন ট্রাম্প।
ফ্যাক্ট চেকার্স ডাটাবেজের শেষ আপডেট বলছে, এখন দিনে গড়ে ৩২ টিরও বেশি বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করছেন তিনি।
২০১৯ সালের অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় ভুয়া তথ্য প্রচার করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। মার্কিন সংসদের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের একটি গণতান্ত্রিক দখলকে ব্যর্থ করার জন্য মরিয়া ট্রাম্প শুধু অক্টোবরেই দিনে গড়ে প্রায় ৪০টি করে প্রায় ১১০০ টিরও বেশি বানোয়াট তথ্য প্রচার করেন।
গত ২৫ জুলাই ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ট্রাম্পের ফোন কল নিয়ে বেশ হৈ চৈ হয়েছিল- যাতে তিনি ২০২০ সালের নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর তদন্ত এবং পরবর্তী ইমপিচমেন্ট তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, গত দু'মাসে ট্রাম্পের করা প্রায় ৬০০ মিথ্যা বা বিভ্রান্তিমূলক দাবিই ছিল ইউক্রেনের তদন্তের সঙ্গে সম্পর্কিত।
আর ট্রাম্প নিজেও বিশ্বাস করেন যে মিথ্যাচারের নিখুঁত পুণরাবৃত্তির মাধ্যমে সহজেই একটি অভিশংসনের বিচারের হাওয়া পাল্টে দিতে পারেন তিনি।
ট্রাম্পের প্রতি ছয়টি তথ্যের একটি ছিল অভিবাসন সম্পর্কে। ২০১৯ সালের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে তার প্রতিশ্রুত প্রাচীরের তহবিলের জন্য রীতিমতো ব্যস্ত ছিল মার্কিন সরকার। তখনই এই বিভ্রান্তিকর প্রচারণার সংখ্যা বেড়ে যায়।
তার দ্বিতীয় সর্বাধিক পুণরাবৃত্তির তথ্য ছিল- মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মিত হচ্ছে- শুধু এ দাবিটিই করা হয়েছিল ২৩৫ বার।
ট্রাম্প ১৮১ বার বলেছেন যে, তিনি আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে কম কর নির্ধারণ করেছেন। ১৭৫টি অনুষ্ঠানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট দাবি করেছেন যে বাণিজ্য ঘাটতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের টাকা ‘হারিয়ে গেছে’। অর্থনীতি সম্পর্কে যে তার জ্ঞান কতোটা কম, এটা তারই প্রমাণ। বাণিজ্য ঘাটতির কারণে কোনো দেশের টাকা ‘হারিয়ে’ যেতে পারে না। বড় জোর, আয় কমতে পারে। বাণিজ্য ঘাটতি মুদ্রার মান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বার্ষিক রিজার্ভ ও বিনিয়োগের হারের মতো ম্যাক্রো অর্থনীতির বিষয়গুলোর ওপর নির্ভর করে।
মিথ্যা দাবি পুনরাবৃত্তি করার ট্রাম্পের প্রবণতা নিয়েও কাজ করেছে ফ্যাক্ট চেকার ডাটাবেস। ট্রাম্পের প্রায় ৪০০টি ঘটনা রেকর্ড করে দেখা গেছে একই তথ্য ভিন্ন ভিন্ন রূপে কমপক্ষে তিনবার পুণরাবৃত্তি করেছেন তিনি।
এদিকে ট্রাম্পের ২০ শতাংশেরও বেশি মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য ছড়ায় তার টুইটার থেকে।
গত ৩ জানুয়ারি কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার যুক্তি হিসাবে ট্রাম্প তার টুইটে বলেন, ‘মার্কিন সামরিক বাহিনী নির্ভুল হামলা চালিয়ে বিশ্বের এক নম্বর সন্ত্রাসী কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করেছে। সোলাইমানি মার্কিন কূটনীতিক ও সামরিক সদস্যদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু এটা করার আগেই যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ধরে ফেলেছে এবং সরিয়ে দিয়েছে।’
তবে আশার কথা হলো, ট্রাম্পের ভুয়া আর বিভ্রান্তিমূলক বিবৃতি যতো বাড়ছে, এসবের কার্যকারিতা ততোই কমে যাচ্ছে। এই ব্যর্থতার প্রমাণও রয়েছে।
২০১৮ সালের ফ্যাক্ট চেকার জরিপ অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজনেরও কম ট্রাম্পের সবচেয়ে প্রচলিত মিথ্যা বক্তব্য বিশ্বাস করে। জরিপে প্রতি ছয়জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে মাত্র একজন ট্রাম্পপন্থী তার গুটিকয় মিথ্যা প্রচারণাকে সত্য হিসেবে মেনে নেয়।