ঘোষণার দিনই ফাইজার নির্বাহীর লাখ লাখ শেয়ার বিক্রির নেপথ্য ঘটনা কী?
গত সোমবার মার্কিন ফার্মাসিউট্যিক্যাল জায়ান্ট ফাইজার ইঙ্ক জার্মান জৈব-প্রযুক্তি কোম্পানি বায়োএনটেকের সঙ্গে যৌথভাবে উৎপাদিত করোনাভাইরাস টিকার সবশেষ ট্রায়ালের প্রাথমিক ফল ঘোষণা করে। সেখানে ৯০ শতাংশের বেশি সফলতা অর্জনের কথা জানানো হয়। ওই একইদিনে ফাইজার মুখ্য নির্বাহী অ্যালবার্ট বৌরলা তার মালিকানায় থাকা ৫৬ লাখ শেয়ার বিক্রি করে দেন। অথচ ঘোষণার পর আরও চাঙ্গা হতে থাকে কোম্পানিটির বাজারদর।
প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীরা কোম্পানির অভ্যন্তরীণ তথ্য জেনে অসাধু উপায়ে যেন শেয়ার লেনদেন করে লাভবান না হতে পারেন- সেজন্য একটি বানিজ্যিক আইন রয়েছে। স্বচ্ছতা নিশ্চিতের সেই বিধি মোতাবেক বৌরলা তার শেয়ার বিক্রি করেছেন।
ফাইজারের টিকা নিয়ামক সংস্থার অনুমোদন পেলে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার এটির অসংখ্য ডোজ কিনতে আরও শত শত কোটি ডলার ব্যয়ের অঙ্গীকার করেছে। সে অবস্থায় লাভজনক একটি শেয়ার দ্রুত বিক্রির পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাজার সংশ্লিষ্ট অনেকেই।
টিকাটি চূড়ান্তভাবে মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন পাবে না- এমন সন্দেহ থেকেই কী বৌরলা তার অংশীদারির একটি বড় অংশ বিক্রি করলেন! নাকি ঘোষণার তারিখ সম্পর্কে তিনি আগে থেকেই জানতেন?
এরকম গুঞ্জন ও সমালোচনা বাজারে চাউর হয়েছে বটে। এমন সন্দেহের পেছনে রসদ যুগিয়েছেন আবার নির্বাচনে পরাজিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বয়ং। তার দাবি, ইচ্ছে করেই নির্বাচনের পর তৃতীয় ট্রায়ালের ফল ঘোষণা করেছে ফাইজার।
এসব কিছুর প্রেক্ষিতে প্রকৃত ঘটনার দিকেও নজর দেওয়া দরকার।
আসল ঘটনা হচ্ছে, প্রায় মাস-দুয়েক আগেই বৌরলার শেয়ার বিক্রির পরিকল্পনা করা হয়েছিল 10b5-1 শীর্ষক এক পরিকল্পনার আওতায়। এটি নির্দিষ্ট দিনে পুঁজিবাজারে কারো মালিকানাধীন শেয়ারের স্বয়ংক্রিয় লেনদেন নিশ্চিত করে।
আগস্টেই প্রাথমিক সফলতার ভিত্তিতে ফাইজারের শেয়ারদর বেড়েছিল। এবং ওই সময়ে করা বিক্রয় পরিকল্পনার আওতায় যথেষ্ট মুনাফা হাতে রেখেই শেয়ার বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন বৌরলা।
কোম্পানির ব্যবসা সংক্রান্ত গোপনীয় তথ্য, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা জানেন না- তেমন তথ্য জানা না থাকলে নির্বাহীরা এভাবে শেয়ার বিক্রির উদ্যোগ নিতে পারেন। এমন তথ্যকে বলা হয়, 'মেটেরিয়াল নন-পাবলিক ইনফরমেশন।' এবং অনেক সময় এর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে কোম্পানির দর প্রভাবিত হয়।
তাই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক বৌরলার শেয়ার বিক্রির সময় নিয়ে। এনিয়ে তাকে কেন্দ্রীয় নিয়ামক সংস্থার সমালোচনার মুখে পড়তে হতে পারে। বিষয়টি হয়তো আরও অনুসন্ধান করেও দেখা হবে।
কারণ, গত ১৯ আগস্ট তার শেয়ার বিক্রির পরিকল্পনা সচল করেছিলেন ফাইজার নির্বাহী। সিক্যুউরিটিজ এবং এক্সচেঞ্জ কমিশন সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
এরপরের দিন ২০ আগস্ট প্রথম ট্রায়ালে টিকার সুরক্ষা এবং কার্যকারিতে প্রসঙ্গে অতিরিক্ত তথ্য প্রকাশ করে ফাইজার। ওই সময় দেওয়া ঘোষণায় আশা প্রকাশ করা হয়, গবেষণা সঠিক পথে থাকায় অক্টোবর নাগাদ একটি সফল টিকা উৎপাদন করে, মার্কিন ওষুধ প্রশাসনের কাছে তারা অনুমোদন চাইতে পারবে।
ফক্স বিজনেস, সিএনবিসি এবং ব্লুমবার্গের মতো অর্থনৈতিক নিউজ চ্যানেলগুলো এই সংবাদ আগস্ট মাসে বেশ গুরুত্ব দিয়ে সম্প্রচার করেছে। ঘোষণার দিন সিএনবিসি জানায়, 'টিকা বাজারে আনার আশাব্যঞ্জক সময় জানানোর পর আজ (ফাইজার) স্টক বেশ দ্রুতগতিতে বাড়ছে।'
এনিয়ে মন্তব্য করেছেন পেনিসিলভানিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান অনুষদের সহকারী অধ্যাপক ড্যানিয়েল টেইলর। টিকা গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীদের শেয়ার কেনা-বেচা তিনি শুরু থেকেই ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষন করছেন।
টেইলর বলেন, নিঃসন্দেহে বৌরলার স্টক পরিকল্পনা এবং কোম্পানির সংবাদ বিজ্ঞপ্তির সমান্তরাল সময় খুবই সন্দেহজনক। ট্রায়ালের ফল ঘোষণার আগের দিন থেকে 10b5-1 পরিকল্পনাকে নিজেদের ইচ্ছেমত সময়ে কাজে লাগিয়ে কোনো ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার নির্বাহীর শেয়ার বিক্রির পদক্ষেপ যথাযথ নয়।''
তবে মার্কিন গণমাধ্যম এনপিআর- এর প্রশ্নের জবাবে ফাইজারের এক মুখপাত্র জানান, ২০ আগস্টের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে 'মেটেরিয়াল নন-পাবলিক ইনফরমেশন' ছিল না এবং কোম্পানির স্টক লেনদেন প্রশাসক ইতোপূর্বে বৌরলার শেয়ার বিক্রির পরিকল্পনা যাচাই করেও দেখছেন।
ওই মুখপাত্র আরও জানান, ইতোপূর্বে আমরা অক্টোবর নাগাদ নিয়ামক সংস্থার অনুমোদন চাওয়ার বিষয়ে আশা প্রকাশ করেছিলাম। আগস্টের প্রেস রিলিজে সেই তারিখ সম্পূর্ণ নিশ্চিত করা হয়নি। তাছাড়া বিজ্ঞপ্তিতে শুধু টিকা নিয়ে একাডেমিক গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়। এই গবেষণা কাজের সময় এবং তার ফলাফলের উপর কোম্পানি প্রশাসনের সরাসরি কোনো হস্তক্ষেপ নেই। বৈজ্ঞানিকেরা কাজের স্বাধীনতা নিয়েই গবেষণা করছেন।
ফাইজারের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ''কোম্পানির পুঁজি ব্যবস্থাপকের সম্মতি নিয়ে ড. বৌরলার ব্যক্তিগত আর্থিক পরিকল্পনার আওতায় তার শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে। তাছাড়া, বৌরলা গত ফেব্রুয়ারিতেই আলোচিত পরিমাণ শেয়ার বিক্রিতে সম্মতি দিয়েছিলেন। শেয়ারমূল্য নির্দিষ্ট একটি পরিমাণে পৌছানো মাত্রই তা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন তিনি।''
গত সোমবার ফাইজার নির্বাহীর বিক্রিত শেয়ারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হলেও, কোম্পানিটি জানায় এখনও তিনি বার্ষিক বেতনের চাইতে নয়গুণ বেশি অংশীদারিত্বের মালিক।
এব্যাপারে বিশেষজ্ঞ টেইলর জানান, সেপ্টেম্বরে করোনাভাইরাস টিকা নিয়ে গবেষণাকারী আরেক কোম্পানি মডের্নার একাধিক নির্বাহী তাদের শেয়ার বিক্রির পরিকল্পনা পরিবর্তন করে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার মাত্র কিছুক্ষণ আগে নির্ধারণ করেছিলেন। এই প্রবণতা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। কারণ, ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই এসব নির্বাহী নিজ অংশীদারিত্ব বিক্রির মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার মুনাফা করেছেন।
''কোম্পানির বাজার পরামর্শকরা বা অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রকরা এই ধরনের পদক্ষেপকে আইনি বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, যা আমার মধ্যে দুশ্চিন্তার জন্ম দিয়েছে। ষ্টক এক্সচেঞ্জ কমিশনের জন্য এটা সতর্কবার্তা। 10b5-1 পরিকল্পনাটি এখন সংশোধন করা উচিৎ। তবে সেটা কীভাবে করা হবে, সেটা তারাই ভালো বুঝবেন,'' তিনি যোগ করেন।
- সূত্র: এনপিআর