চারটে করে বিয়ে! এক কোটি অনুপ্রবেশ: বাংলাদেশ নিয়ে বিজেপির মিথ্যাচারের প্রমাণ দিলেন ভারতের দুই অর্থনীতিবিদ
গত ২০ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলায় বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এক সমাবেশে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে ‘অবৈধভাবে বসবাসরত এক কোটি বাংলাদেশি মুসলিমকে’ বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে।
এ ছাড়াও ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন সিএবি ও এনআরসির পক্ষে প্রচারণা চালাতে গিয়ে বিজেপির নেতাকর্মীরা বলছেন, অধিকাংশ মুসলমানের চারজন করে স্ত্রী। ফলে তাদের পরিবারে অনেক সন্তান জন্ম নেয়। এ কারণে অদূর ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে।
এ বিষয়টি নিয়ে বিজেপির রাজ্যপ্রধান থেকে শুরু করে বিজেপির নেতাকর্মীরা যে কী পরিমাণ মিথ্যাচার করেছে ও প্রপাগান্ডা ছড়িয়েছে, তা পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী গণমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে পরিসংখ্যান ও তথ্য-প্রমাণ দিয়ে তুলে ধরেছেন দেশটির দু'জন অর্থনীতিবিদ শুভনীল চৌধুরী ও শাশ্বত ঘোষ।
তারা লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান উভয় জনগোষ্ঠীরই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার লাগাতারভাবে কমছে। কিছু সীমান্তবর্তী জেলাতে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার পুরো রাজ্যের মুসলমানদের গড় বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হলেও অনেক জেলাতেই তা কম।
যেসব জেলায় হিন্দুদের জনসংখ্যার হার বাড়ছে, সেসব জেলাতেই মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বাড়ছে। ফলে ‘ব্যাপক অনুপ্রবেশ’-এর যে তত্ত্ব দেওয়া হয়েছে, তা ধোপে টেকে না। এর বিস্তারিত ব্যাখায় তারা পশ্চিমবঙ্গে নানা সময়ে হওয়া আদমশুমারির ফলাফল তুলে ধরেন।
ওই ফলাফল থেকে দেখা যায়, ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ। এ সময় পুরো ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। অর্থাৎ ভারতের থেকে পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি ছিল।
এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়েছে, দেশ বিভাগের ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা) থেকে উদ্বাস্তুদের আগমন, ভারতের অন্যান্য প্রান্ত থেকে শ্রমজীবী মানুষের পশ্চিমবঙ্গে চলে আসা ইত্যাদি। তবে ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (২৪ দশমিক ৮ শতাংশ) ভারতের বৃদ্ধির হারের (২৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ) প্রায় সমান হয়ে যায়।
এর পরের দশক ১৯৭১-৮১তে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (২৩ দশমিক ১৭ শতাংশ) ভারতের তুলনায় (২৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ) আরও কমে যায়। ২০০১-১১ দশকে ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ, যেখানে পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
এই পরিসংখ্যান উপস্থাপনের পর ওই সম্পাদকীয়তে তারা লিখেন, “১৯৫১-৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে মানুষ এই রাজ্যে এলেও তার পরে কোনো বড় ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটেনি। ঘটলে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ভারতের থেকে কম হতো না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির তথ্য থেকে উদ্বাস্তু আগমন বা অনুপ্রবেশের সম্পূর্ণ চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়। কারণ এই হার রাজ্যের উন্নয়ন, শিক্ষা, মহিলাদের ক্ষমতায়ন ইত্যাদির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই আমাদের তাকাতে হবে ‘অনুপ্রবেশ’-এর তথ্যের দিকে।”
অনুপ্রবেশের তথ্যের জন্য এই দুই অর্থনীতিবিদ ২০০৮ সালে করা হার্ভার্ড, ইয়েল ও শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন অধ্যাপকের একটি গবেষণার ফলাফল এবং ১৯৭১ সালে প্রকাশিত বই ‘দ্য অ্যাগনি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’ থেকে নেওয়া বিভিন্ন তথ্য সংযুক্ত করেন।
মার্কিন এই তিন অধ্যাপকের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৩১ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে সমগ্র ভারতে আগত অভিবাসী মানুষের সংখ্যা ৭৩ লাখ। আবার অনেক মানুষ ভারত থেকে অন্য দেশে চলেও গিয়েছেন।
এই তথ্যের ভিত্তিতে সম্পাদকীয়তে ভারতের দুই অর্থনীতিবিদ দাবি করেন, “বিজেপি যে এক কোটি ‘অনুপ্রবেশ’ এর গালগল্প শোনাচ্ছে, এই তথ্য তাকে মিথ্যা প্রমাণ করে।”
‘দ্য অ্যাগনি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’ বইতে লেখক রণজিৎ রায় ১৯৭১ সালে ভারতীয় সংসদে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ভারতে আগত মানুষের সংখ্যা ৪১ লাখ ১৭ হাজার, যাদের মধ্যে ৩১ লাখ ২১ হাজার মানুষকে পশ্চিমবঙ্গে পুনর্বাসন করা হয় এবং বাকি প্রায় ১০ লাখ মানুষকে অন্যান্য রাজ্যে পাঠানো হয়।
১৯৭০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের সংখ্যা হয় ৫২ লাখ ১৪ হাজার। এই উদ্বাস্তুদের অধিকাংশই হিন্দু। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ কোটি উদ্বাস্তু ভারতে চলে আসতে বাধ্য হন। এদের অধিকাংশই স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন হওয়ার পরে ফিরে যান বলে সরকার দাবি করে।
আনন্দবাজারে প্রকাশিত এই এই সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “২০১১ সালের জনগণনার সময় পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী প্রায় ২২ লক্ষ মানুষ জানান যে, তাদের জন্ম বাংলাদেশে। এদের মধ্যে ৫০ শতাংশ (১১ লাখ) মানুষ নদিয়া এবং উত্তর চব্বিশ পরগনার বাসিন্দা। ধারণা করা হয়, তারা মূলত মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ।”
সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়, “মুসলমানপ্রধান জেলাগুলো যেমন মালদহ, মুর্শিদাবাদে বাংলাদেশকে নিজের জন্মস্থান বলা মানুষের সংখ্যা নগণ্য। বাংলাদেশে জন্মেছেন বলেই এই মানুষগুলি বেনাগরিক হতে পারেন না। দেশভাগ এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে মানুষ এই রাজ্যে এসেছেন। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তথ্য, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা প্রকাশিত গবেষণাপত্র, রণজিৎ রায় প্রদত্ত সরকারি তথ্য এবং ২০১১ সালের জনগণনার রিপোর্ট জানাচ্ছে— পশ্চিমবঙ্গে কয়েক কোটি অনুপ্রবেশকারী আছে, এ কথাটি ডাহা মিথ্যা।”
দুই অর্থনীতিবিদ সম্পাদকীয়তে লেখেন, ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ছিল ১৪ দশমিক ২ শতাংশ, যা ২০০১ থেকে ২০১১ সালে কমে হয় ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। একই সময়ে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২৫ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে কমে হয় ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ সম্প্রদায়-নির্বিশেষে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে।
তারা লেখেন, “২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গে সার্বিক জন্মহার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা টিএফআর, অর্থাৎ এক জন নারী তার জীবনে গড়ে মোট যতগুলো সন্তানের জন্ম দেবেন) ছিল ২ দশমিক ৬, যা ২০১১ সালে কমে হয় ১ দশমিক ৭ এবং ২০১৫-১৬ সালে হয় ১ দশমিক ৮। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মহার এই বছরগুলোতে ছিল যথাক্রমে ২ দশমিক ২, ১ দশমিক ৭ ও ১ দশমিক ৬। মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ২০০১ সালে জন্মহার ছিল ৪ দশমিক ৬, যা মাত্র ১০ বছরে কমে হয় ২ দশমিক ২ এবং ২০১৫-১৬ সালে হয় ২ দশমিক ১।
“অর্থাৎ প্রতি মুসলমান মায়ের সন্তানসংখ্যা গত ১৫ বছরে কমেছে দুইয়ের বেশি। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের মধ্যে জন্মহারের পতনের পরিমাণ দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর ফলে মুসলমানদের জন্মহার প্রায় হিন্দুদের জন্মহারের কাছাকাছি চলে এসেছে। শিক্ষার প্রসার, গর্ভনিরোধকের ব্যবহার বৃদ্ধি, সন্তানদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার আকাঙ্ক্ষা জন্মহারের এই তাৎপর্যপূর্ণ পতনের জন্য দায়ী।”
পশ্চিমবঙ্গের জেলাভিত্তিক হিসাব দিয়ে ওই দুই অর্থনীতিবিদ সম্পাদকীয়তে দেখান, মুসলমানপ্রধান জেলাগুলোতে মুসলমানদের জন্মহার দুইয়ের কাছাকাছি। এই জেলাগুলোর মধ্যে কোচবিহার, দক্ষিণ দিনাজপুর, বর্ধমান, কলকাতা এবং উত্তর চব্বিশ পরগনাতে এই হার দুইয়ের চেয়ে কম। ২০০১ থেকে ২০১৫-১৬ সালের মধ্যে এই মুসলমানপ্রধান জেলাগুলোর অধিকাংশের ক্ষেত্রেই এক জন মুসলমান মায়ের সন্তান সংখ্যা কমেছে গড়ে দুইয়ের বেশি।
তারা বলেন, “প্রচুর সন্তানের জন্ম দেওয়ার যে অপবাদ মুসলমান সমাজ সম্পর্কে দেওয়া হয়, তা ভিত্তিহীন। হিন্দুদের জন্মহার অনেক বছর ধরেই নিম্নগামী। ২০০১ সালের পর থেকে মুসলমানদের জন্মহার দ্রুত কমার ফলেই পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক জন্মহার কমে বর্তমানে ভারতে সর্বনিম্ন হয়েছে।”
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের চারটি বিয়ে করা সংক্রান্ত তথ্যটিও যে স্রেফ প্রপাগান্ডা, তা সম্পাদকীয়তে তুলে ধরেন এই দুই অর্থনীতিবিদ।
তারা বলেন, “অনেক শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুর মুখেও প্রায়ই শোনা যায় যে মুসলমানেরা নাকি চারটে করে বিয়ে করেন। ২০১৫-১৬ সালের জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষা রিপোর্টের ভিত্তিতে গণনা করে দেখা যাচ্ছে যে, পশ্চিমবঙ্গে ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ হিন্দু স্ত্রী জানিয়েছেন যে, তাদের স্বামীদের আরও অন্তত এক জন বিবাহিত স্ত্রী আছেন।”
অর্থনীতিবিদদ্বয় বলেন, “সমগ্র ভারতে এই গড় ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। মুসলমান নারীদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ২ দশমিক ৭৭ শতাংশ স্ত্রী জানিয়েছেন যে, তাদের স্বামীদের আরও অন্তত এক জন বিবাহিত স্ত্রী আছেন। সর্বভারতীয় গড় ২ দশমিক ০৫ শতাংশ। অর্থাৎ মুসলমান সমাজে স্বামীর একাধিক স্ত্রীর সঙ্গে বসবাস করা মহিলার সংখ্যা ৩ শতাংশের কম। অধিকাংশ মুসলমান পুরুষের চারটে বিয়ে, এই কথাটা নিখাদ মিথ্যা।”
সম্পাদকীয়র শেষে দুই অর্থনীতিবিদ মতামত দেন, “মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে প্রচারের একটিও পরিসংখ্যান ধোপে টেকে না, সেগুলির ভিত্তিতে যে রাজনীতি চলে, তার স্বরূপ বুঝতে সমস্যা হয় না।”