পশ্চিমে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টিকা রয়েছে এবং সেগুলো বণ্টন না করার পেছনে তাদের কোন অজুহাত খাটে না: গর্ডন ব্রাউন
শীঘ্রই দশ বিলিয়ন কোভিড টিকার উৎপাদন কার্যক্রম শেষ হবে। তথ্য গবেষণা সংস্থা এয়ারফিনিটি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী জানুয়ারির মধ্যে টিকা উৎপাদন এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছে যাবে, যখন প্রতিটি মহাদেশের প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ টিকার মজুদ থাকবে। জুনের মধ্যে ডোজের সংখ্যা দাঁড়াবে ২৭ বিলিয়নে, যা বিশ্বের সম্পূর্ণ জনসংখ্যাকে দু'বার করে টিকা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
কিন্তু এতো উৎপাদন সত্ত্বেও আমরা বিশ্বের প্রতিটি দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করতে পারছি না। কারণ অস্ত্র ও শক্তি প্রতিযোগিতার কাছে মানবিক এই চাহিদা হেরে যাচ্ছে।
টিকা বণ্টনের বর্তমান প্রবণতা বজায় থাকলে, আগামী গ্রীষ্ম পর্যন্ত বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ টিকা নেওয়ার সুযোগ পাবে না।
সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত টিকার ঘাটতির কারণে এমন ঘটনা বোধগম্য ছিল। কিন্তু বর্তমানে টিকার ঘাটতি নয়; বরং এই সংকটের পিছনে ধনী দেশগুলোর টিকার ন্যায়সঙ্গত বণ্টনে ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ধনী দেশগুলো ইতিমধ্যে তাদের ৬০ শতাংশের বেশি নাগরিককে সম্পূর্ণরূপে টিকাদান করেছে, যেখানে দরিদ্র দেশগুলো তাদের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশকে টিকা দিতে পেরেছে। ধনী দেশগুলো টিকার বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য তৈরি করে বসেছে; যার কারণে দরিদ্র দেশগুলোর মাঝে টিকার সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
এই মাসে এবং অদূর ভবিষ্যতে হাজার হাজার মানুষ টিকার অভাবে মৃত্যুবরণ করবে। তবে টিকার এই সংকট স্বল্প উৎপাদনজনিত সংকট নয়, বরং ধনী দেশগুলোর বেপরোয়াভাবে টিকা মজুদের কারণেই সৃষ্টি হয়েছে।
উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর সংগঠন জি-৭ এর পক্ষ থেকে বরিস জনসন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ২০২১ এবং ২০২২ সালের মধ্যে পুরো বিশ্বকে টিকার আওতায় আনা হবে। কিন্তু বর্তমানে তার সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনা নেই। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে জনসংখ্যার ১০ শতাংশ এবং ডিসেম্বরের মধ্যে ৩০ শতাংশকে টিকা দেওয়ার যেই লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা বিশ্বের ১০০টিরও অধিক দেশ পূরণ করতে সমর্থ হবে না বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে।
গত বছর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী দরিদ্র দেশগুলোয় টিকার সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করতে কোভ্যাক্স কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল। এই কর্মসূচীর আওতায়, চলতি বছরের জুনে জি-৭ দেশগুলো দরিদ্র দেশগুলোতে ৮৭০ মিলিয়ন ডোজ টিকা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিলেও, এখন পর্যন্ত তারা মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডোজ সরবরাহ করেছে। বিশ্বব্যাপী টিকা উৎপাদনের মাত্র ৪ শতাংশ পেয়েছে কোভ্যাক্স কর্মসূচী।
টিকার বৈজ্ঞানিক সাফল্যকে সকলের জন্য প্রকৃত সুরক্ষায় পরিণত করতে এবং টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বকে ধনী-দরিদ্র দু'টি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়া থেকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। এটি আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা এবং একটি নৈতিক বিপর্যয়। যদি পুরো পৃথিবী একটি রাষ্ট্র হত, তাহলে আমরা হয়তো এটাকে ব্যর্থরাষ্ট্র বলতাম।
এবং আমরা সময়ের বিপরীতে এমন এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছি, যখন এই ব্যাপারগুলো হয়তো ঘুরে দাঁড়াবে। বেশিরভাগ টিকা নিশ্চিতকারী দেশগুলোতে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার বেশ কমে এসেছে। অন্যদিকে, যেসব দেশ তাদের অধিকাংশ নাগরিকের জন্য টিকা নিশ্চিত করতে পারেনি, সে সব দেশে সংক্রমণের উচ্চ হার নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যুর হার বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্যজনকভাবে, আফ্রিকান দেশগুলো এই সপ্তাহে আফ্রিকান নেতাদের কাছে, ম্যান্ডেলা-অনুপ্রাণিত প্রবীণ গোষ্ঠীর কাছে এবং আফ্রিকান এনজিওগুলোর কাছে টিকার সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করতে ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যমে আবেদন জানিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, তারা আর পশ্চিমের প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করবে না; তারা তাদের নিজস্ব টিকা ক্রয়কারী সংস্থা তৈরি করবে এবং সেইসঙ্গে এখন তারা নিজেরাই টিকা উৎপাদনের কথা ভাবছে।
কিন্তু সামনে এগোনোর আরেকটি পথ আছে। পশ্চিমাঞ্চলের অব্যবহৃত এবং অতিরিক্ত টিকা কোভ্যাক্স কর্মসূচীকে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি বাইডেনের সভাপতিত্বে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ প্রান্তে একটি জরুরি জি-৭ টিকা শীর্ষ সম্মেলনের আহ্বান করা উচিত।
এ ধরণের পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আমাদের পর্যপ্ত পরিমাণ টিকার মজুদ রয়েছে। টিকা উৎপাদন ইতোমধ্যেই মাসিক দেড় বিলিয়ন ডোজে পৌঁছেছে, এবং বছরের শেষ নাগাদ মাসিক এই উৎপাদন ২ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। ততদিনে, আমাদের ১ বিলিয়নেরও বেশি অব্যবহৃত ডোজ মজুদ থাকবে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি, এই মজুদের সংখ্যাটি ২ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে।
এতদিন পর্যন্ত পশ্চিমা নেতারা যে কোনো কারণে উৎপাদন সরবরাহ শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় অতিরিক্ত টিকা মজুদ করে রেখেছিলেন। তবে এখন সেসব বাধা বিপত্তির আশঙ্কা কাটিয়ে ভবিষ্যতের জন্য টিকার ক্রমবর্ধমান উৎপাদনের নিশ্চয়তা দেওয়ার যথেষ্ট সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। এতো টিকা উৎপাদন হচ্ছে যে এখন বড় ঝুঁকি হলো, লক্ষ লক্ষ টিকা অব্যবহৃত থেকেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আমরা অবিলম্বে এই কর্মসূচী শুরু করতে পারি। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে পশ্চিমা দেশগুলো ৫০০ মিলিয়ন ডোজ টিকা সরবরাহ করতে পারে এবং এরপরে প্রতি মাসে ২০০ মিলিয়ন করে সরবরাহ করতে পারে। এই পরিকল্পনার অধীনে, ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রতিটি নিম্ন-আয়ের দেশ, তার জনসংখ্যার ৬০ শতাংশকে টিকা দিতে পারবে এবং এভাবে এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তারা ধনী দেশগুলোর বর্তমান টিকা স্তরে পৌঁছতে পারবে।
দরিদ্র দেশগুলোতে টিকা অনুদান হিসেবে দিয়ে ধনী দেশগুলোর বুস্টার ডোজের সুযোগকে হাতছাড়া করতে হবে না। উৎপাদনের বর্তমান ধারা বজায় রাখা গেলে, আগামী বছরের মধ্যে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপ, টিকা নেয়নি তাদের জনসংখ্যাকেও টিকা দিতে পারবে; টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে বুস্টার সরবরাহ করতে পারবে; এবং এমনকি ১২ বছরের বেশি বয়সীদের জন্যও টিকা সরবরাহ করতে পারবে। সেইসঙ্গে দরিদ্র দেশগুলোর চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট দান করাও সম্ভব হবে। এবং বিশ্বের বৃহত্তম টিকা প্রস্তুতকারক দেশ চীন যদি এই প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে রাজি হয়, তাহলে আমরা সেই লক্ষ্যে আরো কিছু সময় আগেই পৌঁছতে পারবো।
কর্মসংস্থান, ব্যবসা এবং বাণিজ্য পুনরায় সুষ্ঠুভাবে শুরু করার সুবিধার সঙ্গে তুলনা করলে, এই কর্মসূচীর আর্থিক খরচ হবে যথেষ্ট কম। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২০২২ সালের জন্য নির্ধারিত টিকার লক্ষ্য পূরণে কোভ্যাক্সের প্রয়োজন হবে মাত্র ৪ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া, সামগ্রিকভাবে জীবন বাঁচাতে প্রয়োজনীয় আরো চিকিৎসা সামগ্রীর মোট খরচ দাঁড়াবে বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলার। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে এই দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিলে, এটি বাইডেনের অনুমিত ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলার সমমূল্যের কোভিড মোকাবেলা প্যাকেজের মাত্র ১.৫ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। এবং নিঃসন্দেহে এটিই সবচেয়ে সাশ্রয়ী।
বিশ্বে সুষ্ঠুভাবে টিকার বণ্টনকে অস্বীকৃতি জানালে আমরা নিজেরাই পরাজিত হবো। রোগটির সংক্রমণের হার অতি উচ্চ এবং টিকা গ্রহণ করেনি এমন ব্যক্তিদের মাধ্যমে এটি ছড়াতে পারে। তাই পরবর্তীতে ভাইরাসটির এমন রূপও বেরিয়ে আসতে পারে, যার মাধ্যমে টিকার বর্তমান সাফল্য হুমকির মুখে পড়ার সম্ভবনা রয়েছে। বিশ্বব্যাপী আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের স্থায়িত্ব এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধির সম্ভাবনাকে তুলে ধরতে এই পদক্ষেপ দ্রুতই নিতে হবে।
ইংল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, টিকা নেওয়ার মাধ্যমে ইতিমধ্যে ইংল্যান্ডে ১ লক্ষ মানুষের জীবন বেঁচেছে। আফ্রিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর মানুষ যদি টিকার অভাবে তাদের জীবন হারাতে থাকে, তাহলে সেসব অঞ্চলের মানুষেরা আমাদের উপরে পরবর্তীতে আস্থা রাখতে পারবে কিনা সে ব্যাপারটিও আমাদের ভেবে দেখা উচিত। ডব্লিউএইচও'র প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রেয়েসুস বলেছেন, টিকার সুষ্ঠু বণ্টন এখন আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরো বিশ্ব একসঙ্গে কাজ করতে পারে কিনা এটি তারও একটি পরীক্ষা। আমাদের অবশ্যই এই পরীক্ষায় সফল হতে হবে।
- মূল লেখা- গর্ডন ব্রাউন, জাতিসংঘের শিক্ষা বিষয়ক বিশেষ দূত এবং যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী (২০০৭-২০১০)
- অনুবাদ- জান্নাতুল তাজরী তৃষা