পানশির: কাবুল থেকে এক ঘণ্টার দূরত্বে 'অপরাজিত' এক উপত্যকা
আফগান রাজধানী কাবুলের উত্তরে অবস্থিত পানশির উপত্যকায় তালেবান বিরোধী কয়েক হাজার যোদ্ধার একটি দল অবস্থান নিয়েছে বলে জানা গেছে। সরু প্রবেশদ্বার ও উঁচু পাহাড়ে ঘেরা এই উপত্যকাটির অবস্থান কাবুল হতে ৩০ মাইল বা এরচেয়েও কিছুটা বেশি দূরত্বে।
আফগানিস্তানের ইতিহাসে পানশির উপত্যকার এমন নাটকীয় আবির্ভাব এই প্রথম নয়। ১৯৮০'র দশকে সোভিয়েত বাহিনী এবং ১৯৯০'র দশকে তালেবান বাহিনীর বিরুদ্ধেও পানশির উপত্যকা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো।
দলটির নাম, ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট অফ আফগানিস্তান (এনআরএফ)। সম্প্রতি তারা পুরো বিশ্বকে তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা ও শক্তির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে আরও একবার।
এনআরএফ-এর বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান আলি নাজারি বিবিসিকে বলেন, "রেড আর্মি তাদের সমস্ত শক্তি দিয়েও আমাদেরকে পরাজিত করতে পারেনি, এবং ২৫ বছর আগে তালেবানরাও নয়। তারা এই উপত্যকা দখলের চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু পরিণামে তাদেরকে চরম পরাজয় মেনে নিতে হয়"।
উপত্যকাটি ৯,৮০০ ফুট (৩,০০০ মিটার) উঁচু পর্বত দ্বারা বেষ্টিত, যা এখানে বসবাসকারী যোদ্ধাদের জন্য প্রাকৃতিকভাবেই সুরক্ষা ঢাল হিসেবে কাজ করছে। দুর্গম এই জায়গায় আসা-যাওয়ার একমাত্র সরু এবং পাথুরে পথটি পানশির নদীর মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে।
মূল উপত্যকার একদম শেষ প্রান্তের পথটি ৪,৪৩০ মিটার উঁচু অঞ্জুমান পাসের দিকে চলে গেছে এবং এর আরও পূর্ব দিকে গেলে পাওয়া যায় হিন্দুকুশ পর্বত। এশিয়ার শ্রেষ্ঠতম বীর যোদ্ধা, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এবং তৈমুর লং এই পথ ধরে যাতায়াত করেছিলেন।
ইউনিভার্সিটি অব লিডসের আন্তর্জাতিক ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এলিজাবেথ লিক বলেন, "ঐতিহাসিকভাবে পানশির উপত্যকা প্রাকৃতিক খনির জন্য পরিচিত ছিলো; এখান থেকে মূল্যবান রত্নও পাওয়া যেতো।"
এখন এখানে একটি জলবিদ্যুৎ বাঁধ এবং বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় রাস্তাঘাট ও একটি রেডিও টাওয়ার নির্মিত হয়েছে এখানে। টাওয়ারটি রাজধানী কাবুলের সঙ্গে সংকেত আদান-প্রদান করতে পারে। এছাড়া বাগরামে সাবেক মার্কিন ঘাঁটিটিও পানশির প্রবেশপথ থেকে অল্প দূরত্বেই অবস্থিত।
উপত্যকার 'সাহসী' মানুষেরা
কমপক্ষে দেড় থেকে দুই লাখ মানুষ এখানে বসবাস করে। তাদের অধিকাংশই তাজিক জাতিগোষ্ঠীভুক্ত এবং তারা আফগানিস্তানে প্রধান ভাষাগুলোর একটি দারি ভাষায় কথা বলে।
আফগানিস্তানের ৩৮ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর এক-চতুর্থাংশ হলো তাজিক জাতিগোষ্ঠী। তবে পার্শ্ববর্তী দেশ তাজিকিস্তানের প্রতি তাদের কোনো আকর্ষণ নেই; বরং তাদের নিজস্ব স্থানীয় পরিচয় রয়েছে।
সদ্য সাবেক আফগান কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান জনাব শরীফি এই উপত্যকার মানুষদের অত্যন্ত সাহসী উল্লেখ করে বলেন, "সম্ভবত তারাই আফগানিস্তানের সবচেয়ে সাহসী মানুষ"।
তিনি বলেন, স্থানীয়রা তালেবানদের সঙ্গে আপোষহীন এবং "তাদের মাঝে একটি যুদ্ধবাজ মনোভাব কাজ করে; তবে সেটি ইতিবাচকভাবে"।
২০০১ সালে তালেবানদের পরাজয়ের পর উপত্যকাটিকে জেলা থেকে প্রদেশে উন্নীত করা হয়। তখন থেকে এটি আফগানিস্তানের ক্ষুদ্রতম একটি প্রদেশ হিসেবে পরিচিত।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. আন্টোনিও গিউস্তোজি বলেন, "উপত্যকাটিকে প্রদেশ বানানোর সিদ্ধান্ত ছিল বিতর্কিত"।
একবিংশ শতকের একদম শুরুতে তালেবানদের পরাজয়ে পানশির যোদ্ধাদের বড় ভূমিকা ছিলো। তারা কাবুল দখলে সহায়তা করেছিলো। বিনিময়ে পানশির নেতাদের সরকার ও সামরিক বাহিনীতে দেওয়া হয়েছিলো বিশিষ্ট পদ। এছাড়া উপত্যকাটি স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা পায়। এবং এটি আফগানিস্তানের একমাত্র প্রদেশ, যেখানে শুধুমাত্র স্থানীয় অধিবাসীই এই প্রদেশের গর্ভনর হতে পারে।
গিউস্তোজি বলেন, "সাধারণত, স্থানীয়দের চেয়ে সরকারের প্রতি গভর্নরদের বেশি অনুগত হতে হয়। তবে, পানশির বিষয়টি ভিন্ন"।
উপত্যকাটির কৌশলগত গুরুত্ব
বিশেষজ্ঞদের মতে, হয়তো এই উপত্যকাটির মতো আরও ১০০টি উপত্যকা রয়েছে আফগানিস্তানে। তবে, কাবুলের উত্তরাঞ্চল দিয়ে পানশির উপত্যকায় যাতায়াতের যে পথটি রয়েছে, সেটি এই ভূখণ্ডের কৌশলগত গুরুত্বকে কয়েকগুণ বাড়িয়েছে দিয়েছে।
রাজধানী কাবুল থেকে যে মহাসড়কটি উত্তরের দিকে যায়, সেটির সমতল পথের শেষে, পাহাড়ের উঁচু রাস্তায় কিছুদূর চললেই পাওয়া যাবে উপত্যকার প্রবেশদ্বার। আবার সমভূমি ছেড়ে পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে উঁচুতে উঠতেই একদিকে পাওয়া যাবে সালং পাস, যে রাস্তা দিয়ে উত্তরের শহর কুন্দুজ এবং মাজার-ই-শরীফে যানবাহন চলাচল করে।
মূলত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের সঙ্গে পানশির প্রদশের সরাসরি সংযোগই এই অঞ্চলের গুরুত্বকে বাড়িয়ে তুলেছে।
শারীফি মনে করেন, একক কোনো কারণে নয়, বরং অনেকগুলো কারণের সমন্বয়ে পানশির প্রদেশ এতটা গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, "এটি শুধু উপত্যকায় কয়েক ডজন দূরবর্তী যুদ্ধাবস্থানের কারণে নয়, এটি শুধু পাহাড়ি ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে নয়, এটি কেবলমাত্র পানশির মানুষদের সাহস ও অহংকার বোধের কারণে নয়; বরং এই সবগুলো কারণ মিলিয়েই এই অঞ্চলটি অন্যগুলোর থেকে ভিন্ন এবং গুরুত্বপূর্ণ"।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই উপত্যকায় অস্ত্রের বড় ধরণের মজুদ রয়েছে। যদিও গত ২০ বছরে এ অঞ্চলের যোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণের কথা ছিলো, তারপরেও বিশ্লেষকদের ধারণা, এখনও এখানে অস্ত্রের মজুদ আছে।
সরকারের যেসব কর্মকর্তাদের পানশির যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে, মূলত তাদের মাধ্যমেই এখানে অস্ত্রের মজুদ গড়ে উঠেছে।
উপত্যকায় বর্তমানে তালেবান-বিরোধী বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৩২ বছর বয়সী আহমদ মাসউদ। তার বাবা ১৯৮০ এবং ৯০'র দশকে সোভিয়েত এবং তালেবানদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
মাসউদ বলেছেন, তার যোদ্ধারা আফগান সেনাবাহিনী এবং বিশেষ বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে সামরিক সহায়তা পায়।
সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টের একটি মতামতে তিনি লিখেছেন, "বাবার সময় থেকেই আমরা ধৈর্য সহকারে গোলাবারুদ এবং অস্ত্র সংগ্রহ করে যাচ্ছিলাম। কারণ আমরা জানতাম, এমন একটি দিন আসতে পারে।"
মাসউদের বাবা 'পানশির সিংহ' হিসেবেই বেশি পরিচিত। তিনি মুজাহিদিন গোষ্ঠীর কমান্ডার হয়ে একাধারে সোভিয়েত এবং তালেবানদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন।
আহমদ শাহ মাসউদ ছিলেন আফগান সেনাবাহিনীর একজন জেনারেলের ছেলে। তার জন্ম পানশির উপত্যকাতে। এখনো তার ছবি পানশির প্রদেশ এবং কাবুল শহরের দোকানে, বিলবোর্ডে এবং আরও অনেক জায়গাতেই দেখা যায়।
পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান (পিডিপিএ) ১৯৭৮ সালে ক্ষমতা জয়ের পর, মূলত আহমদ শাহ মাসউদের অবদানেই পানশির উপত্যকায় কমিউনিস্ট বিরোধী প্রতিরোধ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিলো। আর এর ঠিক এক বছরের মাথায়ই ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত অভিযান চালায়।
আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধে তিনি ছিলেন সবচেয়ে পরিচিত মুখ। সোভিয়েতের বিরুদ্ধে তিনি পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোয় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তার সম্মোহনী ক্ষমতার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নও তার সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলো, যা সে সময় যুদ্ধে তার ভূমিকাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
ড. গিউস্তোজি বলেন, "সেই সময়ের প্রেক্ষিতে, মাসউদ ছিলেন অন্যান্য বিদ্রোহী নেতাদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি ছিলেন শিক্ষিত, ফরাসি ভাষা বলতে পারতেন, সরল এবং মনোমুগ্ধকরভাবে কথা বলতেন"।
২০০১ সালে ৯/১১ হামলার ঠিক দুই দিন আগে, আল-কায়েদা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাকে হত্যা করে। মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাই তাকে জাতীয় বীর ঘোষণা করেন।
তবে যাহোক, অনেকেই তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মনে করে। ২০০৫ সালের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তান যুদ্ধের সময় তার নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ক্ষমতার অনেক অপব্যবহারের সঙ্গে জড়িত ছিল।
অপরাজেয় এক উপত্যকা!
৮০'র দশকের শেষের দিকে সোভিয়েত বাহিনী পানশির আকাশ এবং স্থলসীমায় একাধিকবার হামলা চালিয়েও পানশির যোদ্ধাদের পরাজিত করতে পারেনি। এর মূল কারণ হলো, সোভিয়েত বাহিনীর পাহাড়ী দুর্গম পরিবেশে যুদ্ধ জয়ের অভিজ্ঞতা ছিলো না। আর এই পাহাড়ী বন্ধুর অঞ্চলই হলো পানশির যোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।
খুব সহজেই পাহাড়ে লুকিয়ে পানশির যোদ্ধারা সোভিয়েত বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালাতো, যা সোভিয়েত সেনাদের খুব দ্রুতই বিভ্রান্ত ও হতাশ করে তুলেছিলো।
এছাড়া দুর্গম পথে যুদ্ধের ট্যাংক এবং বড় ধরণের প্রতিরক্ষা অস্ত্রগুলো নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলো না বলে, খুব তাড়াতাড়িই সোভিয়েত বাহিনী পরাজিত হয়।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, সোভিয়েত সেনারা একদম শুরুতে পানশির উপত্যকায় নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারলেও তা টিকে থাকেনি খুব বেশি দিন।
উত্তরাধিকারী
যখন বাবার মৃত্যু হয়, তখন আহমদ মাসউদের বয়স মাত্র ১২ বছর। তিনি লন্ডনে পড়াশোনা করেছেন এবং স্যান্ডহার্স্টের রয়েল মিলিটারি একাডেমিতে এক বছরের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
ড. গিউস্তোজি বলেন, "তিনি তার বাবার মতোই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তবে, তিনি একজন সামরিক নেতা হিসেবে কেমন হবেন তা বলা যাচ্ছে না। জাতীয় পর্যায়ে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেওয়ার সম্ভাব্য চুক্তি আলোচনায় হয়তো তাকে আরও দক্ষ হতে হবে"।
তিনি আরও বলেন, "যেহেতু তিনি নতুন ব্যক্তিত্ব, তাই এখানে পুরোনো নেতাদের মতো তার হারানোর কিছু নেই। সুতরাং তিনি যেকোনো আলোচনায় বেশি দাবি রাখতে পারেন।"
পরবর্তী সময়ে এই উপত্যকায় কী হতে চলেছে তা বলা সত্যিই কঠিন বলেও মন্তব্য করেন ড. গিউস্তোজি।
তিনি তার নিজস্ব ঐতিহ্য এবং বাবার ইতিহাস ও মর্যাদার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, এখন সময়টা ভিন্ন। তালেবান গোষ্ঠী দেশের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে ফেলেছে এবং উপত্যকায় সবকিছুর সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। মূলত এ ঘটনা এতদিনের ভারসাম্য অবস্থাকে ভেঙে দিতে চলেছে।
এমনকি আহমদ মাসউদ সবকিছু স্বাভাবিক রাখতে নিজেই সমর্থন চেয়েছেন।
মাসউদ তার ওয়াশিংটন পোস্টের মতামতে লিখেছিলেন, "যদি তালেবানরা উপত্যকায় আক্রমণ চালায়, তবে তারা একটি শক্ত প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে; যদিও আমরা জানি আমাদের সামরিক শক্তি তাদের বিপরীতে যথেষ্ট নয়। তবে, তারা দ্রুতই পরাজয়ের মুখোমুখি হবে, যদি আমাদের পশ্চিমের বন্ধুরা সমর্থন দিতে দেরি না করে।"
- সূত্র- বিবিসি