ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট-কন্যা দুতার্তে-কার্পিওর ব্যাপারে যা জানা প্রয়োজন
ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের রাজনীতি থেকে আকস্মিক অবসরের ঘোষণা ঝড় তুলেছে বিশ্বব্যাপী। দুতার্তে জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে আগামী বছর নিজের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবেন না তিনি।
অবশ্য এর আগে দুতার্তে জানিয়েছিলেন, ২০২২ সালের নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য তিনি লড়বেন, এবং তাদের পরিবার থেকে কেবল তাকেই দেখা যাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে। কিন্তু তিনি হুট করে সরে দাঁড়ানোয় সুগম হয়েছে তার কন্যা সারা দুতার্তে-কার্পিওর ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ।
ফলে দুতার্তের আচমকা অবসর একই সঙ্গে নতুন করে পাদপ্রদীপের আলোর নিচে নিয়ে এসেছে তার কন্যা দুতার্তে-কার্পিওকে। এতদিন যারা চিনতেন না তাকে, তাদের মনে প্রশ্ন : কে এই দুতার্তে-কার্পিও? কেনই বা তার বাবার ব্যাপারে অসংখ্য বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও তাকে মনে করা হচ্ছে ফিলিপাইনের হবু প্রেসিডেন্ট?
চলুন জেনে নেয়া যাক দুতার্তে-কার্পিওর ব্যাপারে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
সারা দুতার্তে-কার্পিও কে?
বাবার মতোই, ৪৩ বছর বয়সী দুতার্তে-কার্পিও প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন আইনজীবী হওয়ার। কিন্তু ২০০৭ সালে সেই পেশাকে বিদায় জানিয়ে রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি, নির্বাচিত হন তার বাবারই ভাইস মেয়র হিসেবে।
২০১০ সালে তিনি বাবার পর দাভাও শহরের মেয়র হন। আর এর মাধ্যমে গড়েন নতুন ইতিহাস। ১.৬ মিলিয়ন জনগণের আবাসস্থল দাভাও শহরের তিনিই প্রথম নারী মেয়র।
ফিলিপাইনের জনগণকে বলা হয় শক্তের ভক্ত নরমের যম। বর্তমান প্রেসিডেন্ট দুতার্তেরও ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে একজন 'স্ট্রংম্যান' হিসেবে। আর সেই স্ট্রংম্যানের যোগ্য কন্যাই বলা যায় দুতার্তে-কার্পিওকে। একবার এক কোর্ট অফিশিয়ালকে ঘুসি মেরে বসেছিলেন; বিশাল মোটরসাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়ান; আর তার সন্তানদের ডাকনামও বেশ দশাসই : শার্কি, স্টিংরে এবং স্টোনফিশ!
বিভিন্ন প্রেসিডেনশিয়াল ইভেন্ট ও প্রেসিডেন্টের বিদেশ সফরগুলোতেও নিয়মিত মুখ দুতার্তে-কার্পিও। বাবার বিয়ে ভেঙে যাওয়ায়, ফার্স্ট লেডির দায়ভার বর্তেছে তার উপরে।
কী বলছেন তিনি?
মাত্র গত মাসেই দুতার্তে-কার্পিও বলেছিলেন তিনি এখনো সর্বোচ্চ পর্যায়ের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য প্রস্তুত নন। কেননা বাবার সঙ্গে তার চুক্তি হয়েছে, তাদের পরিবারের থেকে যেকোনো একজনই কেবল সামনের বছরের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন।
এই বিবৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই গতকাল শনিবার (২ অক্টোবর) তৃতীয়বারের মতো দাভাও শহরের মেয়র পদের জন্য নাম জমা দিয়েছেন তিনি। কিন্তু ওই একই দিনে তার বাবা রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন, এবং বলেছেন তার কন্যা দাঁড়াবেন ২০২২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। এছাড়া প্রেসিডেন্ট দুতার্তে আরো জানিয়েছেন, তার বিশ্বস্ত সহচর, সিনেটর ক্রিস্টোফার 'বং' গো দাঁড়াবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচনে।
তাই এখন জনমনে জিজ্ঞাসা, এই গোটা নাটকীয় প্রেক্ষাপটে দুতার্তে-কার্পিওর নিজের বক্তব্য কী। কিন্তু তার মুখপাত্র সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এ ব্যাপারে তার কিছু বলার নেই, এবং তিনি কেবল সেটুকুই জানেন, যেটুকু জানানো হয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যমে।
এর আগেও এ বছরের শুরুতে দুতার্তে-কার্পিও জানিয়েছিলেন, নিজের রাজনৈতিক সাম্রাজ্যকে প্রেসিডেন্সি অবধি বিস্তার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। তিনি নাকি একটি চার্ট তৈরি করেছেন 'কেন' ও 'কেন নয়' এর তালিকা দিয়ে, এবং সেই চার্টে 'কেন নয়' জয়যুক্ত হওয়াতেই তার এমন সিদ্ধান্ত। অবশ্য ঠিক কী কী কারণে প্রাধান্য পেল 'কেন নয়', তা এমনকি নিজের বাবার কাছেও খোলাসা করেননি তিনি।
সামনে কী হবে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রেসিডেনশিয়াল প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে একেবারে শেষ মুহূর্তেও পরিবর্তন আসা সম্ভব। তাছাড়া প্রার্থী হিসেবে নিজেদের নাম জমাদান এবং তৎপরবর্তী নাম-পরিবর্তন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার এখনো এক মাসের বেশি বাকি। এই সময়ের মধ্যে যেকোনো কিছুই হতে পারে, যার ফলে উলটে যেতে পারে পাশার দান।
বিশ্লেষকরা আরো ধারণা করছেন, দুতার্তে ও তার কন্যা হয়তো ২০১৫ সালের মতো একই কৌশল অবলম্বন করছেন। সেবারও বারবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের অনাগ্রহের কথা জানিয়ে, একদম একাদশ ঘণ্টায় নিজের নাম দাখিল করেন দুতার্তে। ফলে যোগ্য বাবার যোগ্য কন্যা দুতার্তে-কার্পিও যদি একই পদাঙ্ক অনুসরণ করেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
তার প্রতিদ্বন্দ্বী কে?
যদিও দুতার্তে-কার্পিও অতীতে কখনো জাতীয় অফিসে বসেননি, তারপরও এখন অবধি তিনিই সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রার্থী। চলতি বছর হওয়া জনমত জরিপগুলো এই দাবির স্বপক্ষেই কথা বলছে।
তবে সাম্প্রতিক অতীতে দেখা গেছে দুতার্তে-কার্পিওর জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়তে। সেপ্টেম্বর মাসে ২,৪০০ জনের উপর করা একটি জরিপে দেখা গেছে, তার পক্ষে সমর্থন ২৮ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে।
সম্ভাব্য প্রেসিডেন্টদের তালিকায় এক ধাপ উন্নতি ঘটেছে বক্সিং ক্যারিয়ারে ইতি টেনে প্রেসিডেন্সির স্বপ্নে বুঁদ হওয়া ম্যানি প্যাকিয়াওর। ইতঃপূর্বে তার পক্ষে সমর্থনের হার ৮ শতাংশ হলেও, এখন তিনি ১২ শতাংশ সমর্থন নিয়ে রয়েছেন চতুর্থ অবস্থানে।
আরেকজন সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন প্রয়াত স্বৈরশাসক ফারদিনান্দ মার্কোসের সমনামী পুত্র, যিনি জনমত জরিপে রয়েছেন দুতার্তে-কার্পিওর ঠিক পেছনে। তবে মজার ব্যাপার হলো, অনেক বিশ্লেষকের মতে মার্কোস দুতার্তে-কার্পিওর সঙ্গে একত্রে নির্বাচন করতে পারেন, প্রেসিডেন্ট অথবা তার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
আরো দুজন এখন পর্যন্ত তাদের প্রার্থিতার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। তাদের একজন ম্যানিলার মেয়র ফ্রান্সিসকো 'ইসকো মোরেনো' ডোমাগোসো। আরেকজন হলেন সাবেক পুলিশ চিফ, সিনেটর প্যানফিলো ল্যাকসন।
তিনি কি বাবার প্রক্সি হবেন?
বিশ্লেষকদের মতে, দুতার্তের উত্তরসূরি এমন কারো হওয়া গুরুত্বপূর্ণ, যিনি তার ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত। কেননা ২০১৬ সাল থেকে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে হাজার হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যার 'মানবতাবিরোধী অপরাধ'-এ দুতার্তের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। এমন পরিস্থিতিতে দুতার্তেকে বাঁচানোর জন্য তার নিজের কন্যার চেয়ে বেশি বিশ্বাসভাজন আর কে-ই বা হতে পারে!
বিশেষজ্ঞরাও এক কথায় সায় দিচ্ছেন, দুতার্তেকে রক্ষার কাজটি দুতার্তে-কার্পিওর চেয়ে ভালোভাবে করার ক্ষমতা আর কারোই নেই।
অবশ্য দুতার্তের কিন্তু 'ব্যক্তিগত স্বাধীনতা' প্রদর্শনের অতীত ইতিহাস রয়েছে। বছর তিনেক আগে লোয়ার হাউজ স্পিকার পদের জন্য তিনি প্রেসিডেন্টের মদদপুষ্ট একটি দলের বিরুদ্ধে নিজের রাজনৈতিক জোট গঠন করেছিলেন।
তাছাড়া দুতার্তের শাসনামলের মূল 'টকিং পয়েন্ট' মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হলেও, এ ব্যাপারে দুতার্তে-কার্পিওকে কখনোই খুব বেশি সরব হতে দেখা যায়নি। অর্থাৎ বাবার মতো তিনিও যে সকল বিষয়ে একই মতাদর্শের অনুসারী, তা মোটেই না।
তাছাড়া তিনি বাবার মতো চীনের ঘনিষ্ঠও নন। দুতার্তের বেইজিং-প্রীতির কারণে খানিকটা চিড় ধরেছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফিলিপাইনের সুসম্পর্কে। অথচ ২০২০ সালেই স্টেট ডিপার্টমেন্টের স্পন্সর করা লিডারশিপ ট্রেইনিংয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঘুরে এসেছেন দুতার্তে-কার্পিও।
চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, 'চীন বনাম যুক্তরাষ্ট্রের ইস্যুটা আমাদের নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে প্রত্যক্ষ করাই শ্রেয়। এই দুইয়ের বাইরেও অন্যদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে হবে, যেন তাদের মধ্যে কোনো একজন আমাদেরকে পিঠ দেখালেও আমাদের পাশে নয়জন বন্ধু থাকে। আবার যদি তাদের দুজনই আমাদের কথা ভুলে যায়, তবুও যেন আমাদের অন্য আটজন বন্ধু থাকে।'
(রয়টার্স অবলম্বনে)