ফেসবুকের আসলে কী হয়েছিল? ঠিক করতে কেন এত সময় লাগল?
সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত নয়টার দিকে বিশ্বজুড়ে সমস্যা দেখা দেয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রামে। অন্যান্য দেশের মতো এ দেশেও এই তিনটি অ্যাপ ব্যবহার করা যাচ্ছিল না।
অবশেষে ভোর সাড়ে চারটার দিকে সার্ভার সচল হওয়ার খবর নিশ্চিত করে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। পরে হোয়াটসঅ্যাপের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে টুইট করা হয়।
দীর্ঘ সময় ধরে ফেসবুকে এ রকম বিভ্রাট দেখা যায়নি। তবে তাদের পরিষেবা পুনরায় সচল হলেও এ সমস্যার উৎপত্তি এবং এটি ঠিক করতে এত সময় লাগার কারণ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
ফেসবুক ডাউন হলো কেন?
ফেসবুক মঙ্গলবার একটি বিবৃতিতে নিশ্চিত করে, কোম্পানির ডেটা সেন্টারগুলোর মধ্যে নেটওয়ার্ক ট্র্যাফিক সমন্বয়কারী 'ব্যাকবোন রাউটার'গুলোতে একটি কনফিগারেশন পরিবর্তনের কারণে ফেসবুকের সকল পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়।
তবে সম্প্রতি ইন্টারনেট বিভ্রাটের সম্মুখীন হওয়া 'ক্লাউডফ্লেয়ার' এ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছে।
ইন্টারনেট সচল রাখতে প্রধানত দুটি জিনিস প্রয়োজন- ডোমেইন নেম সিস্টেম (ডিএনএস) এবং বর্ডার গেটওয়ে প্রোটোকল (বিজিপি)।
যেহেতু অনেকগুলো সংযুক্ত নেটওয়ার্কের সমন্বয়ে ইন্টারনেট গঠিত, নেটওয়ার্কগুলো কোন পথে যাত্রা করবে তার জন্য বিজিপি প্রয়োজন। অন্যদিকে প্রতিটি ওয়েবসাইটের ঠিকানা নির্ধারণের সিস্টেম হচ্ছে ডিএনএস। প্রতিটি ওয়েবসাইটের আলাদা এই ঠিকানাকে আইপি অ্যাড্রেস বলা হয়। এক কথায়, আইপি অ্যাড্রেসে যাওয়ার কার্যকর উপায় খুঁজে বের করার রোডম্যাপ বিজিপি।
ক্লাউডফ্লেয়ার বলে, সোমবার ব্যবহারকারীরা ফেসবুকে প্রবেশের চেষ্টা করলে সেটি অ্যাক্সেসের পথ খুঁজে পাননি তারা। ফলে ফেসবুকসহ এর অধীনস্থ সব পরিষেবা অচল হয়ে পড়ে।
বন্ধ ছিল নিজস্ব ইন্টার্নাল সিস্টেমসও
জানা গেছে, গতকাল বিশ্বজুড়ে ব্যবহারকারীদের পাশাপাশি ফেসবুকের কর্মীরাও তাদের নিজস্ব ইন্টার্নাল কমিউনিকেশনস প্ল্যাটফর্ম অ্যাক্সেস করতে পারেননি।
পরিষেবা পুনরায় চালু করতে এত সময় লাগল কেন?
ফেসবুকের নিজস্ব ইন্টার্নাল সিস্টেমগুলো একই জায়গা থেকে পরিচালিত হয়। ফলে কর্মীদের পক্ষে সমস্যা নির্ণয় এবং এর সমাধান করা কঠিন ছিল।
গার্ডিয়ানের ইউকে প্রযুক্তি সম্পাদক অ্যালেক্স হার্ন টুইট করেন, 'ফেসবুক তাদের সকল কার্যক্রম ফেসবুকের মাধ্যমেই চালায়।' অর্থাৎ, যে উপায়ে এ সমস্যা সমাধান করা যেত, সেটিও কাজ করছিল না।
এদিকে, ফেসবুকের কর্মীরা তাদের নিজস্ব যোগাযোগের প্ল্যাটফর্ম, এমনকি কর্মস্থলেও প্রবেশ করতে পারছিলেন না। নিরাপত্তা পাস ব্যবস্থা বিভ্রাটের কারণে অফিসে প্রবেশ করতে পারছিলেন না তারা।
শেষ পর্যন্ত তারা কীভাবে এটি ঠিক করলেন?
আদতে কী ভুল হয়েছে এবং কীভাবে এটি ঠিক করা হয়েছে, সে সম্পর্কে ফেসবুক এখন পর্যন্ত কোনো বিস্তারিত তথ্য জানায়নি। তবে একাধিক রিপোর্টে দেখা গেছে, ক্যালিফোর্নিয়ায় যেখানে সমস্যাটির উৎপত্তি ঘটে, সেখানে সার্ভারগুলোকে ম্যানুয়ালি রিসেট করতে একটি প্রযুক্তিগত দল পাঠায় ফেসবুক।
ভবিষ্যতে এ ধরনের বিভ্রাট এড়ানো সম্ভব?
এ ধরনের সমস্যা মোটামুটি অস্বাভাবিক; তবে এটি সম্পূর্ণভাবে এড়ানো সম্ভব নয়।
২০২০ সালে ক্লাউডফ্লেয়ার বিভ্রাট এবং সাম্প্রতিক ফেসবুক বিভ্রাট-সহ এ জাতীয় সমস্যায় মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয় এসব ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীরা।
বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্যই শুধু ফেসবুকের ওপর নির্ভর করে না মানুষ। বরং অনলাইন বিক্রয় ওয়েবসাইটসহ অন্যান্য পরিষেবাকে ব্যবসার কাজেও ব্যবহার করা হয়। কিছু দেশে হোয়াটসঅ্যাপের মতো পরিষেবার মাধ্যমে যোগাযোগের জন্যেও প্রভাবশালী একটি মাধ্যম ফেসবুক।
ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য কি ঝুঁকিতে ছিল?
ফেসবুক সচল থাকলেই মূলত ব্যবহারকারীদের তথ্য ঝুঁকিতে থাকে। গতকালের ঘটনায় ব্যক্তিগত তথ্য ঝুঁকিতে পড়ার ঝুঁকি ছিল কম।
ফেসবুকের জন্য বর্তমান সময়টি কি অদ্ভুত নয়?
সম্প্রতি ফেসবুককে ঘিরে বেশ কিছু বিতর্ক তৈরি হয়েছে। গত সপ্তাহে শিশুদের জন্য ইনস্টাগ্রাম চালু করার পরিকল্পনা স্থগিত করে ফেসবুক। ফাঁস হওয়া একটি অভ্যন্তরীণ গবেষণা থেকে জানা যায়, ইনস্টাগ্রাম যে মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, সে সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত ছিল তারা।
আরও পড়ুন:
ফেসবুকের গোপন নথি ফাঁস: 'নিরাপত্তার চেয়ে মুনাফাকেই প্রাধান্য দেয় ফেসবুক'
এদিকে রোববার, ফেসবুকের সিভিক ইন্টেগ্রিটি প্রোডাক্টের সাবেক ম্যানেজার ফ্রান্সেস হগেন জানান, জননিরাপত্তার চেয়ে কোম্পানির বিস্তার ও মুনাফাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে ফেসবুক।
তিনি অভিযোগ করেন, 'বর্তমানে ফেসবুকের যে সংস্করণ চালু রয়েছে, সেটি আমাদের সমাজকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে এবং বিশ্বব্যাপী জাতিগত সহিংসতা তৈরি করছে।'
ঠিক করতে কী পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে?
ফেসবুকের ওপর নির্ভরশীল ব্যবসায়ীরা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য এখনো জানা যায়নি। তবে ব্লুমবার্গের মতে, রোববার ফ্রান্সেস হগেনের বক্তব্যের পরপরই গতকালের এ বিভ্রাটে ৪.৯ শতাংশ কমে গিয়েছে ফেসবুকের শেয়ার।
ফলে সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ কমেছে ৬০০ কোটি ডলার। ব্লুমবার্গ বিলিওনার ইন্ডেক্সের প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, বিল গেটসের নিচে নেমে গিয়েছেন তিনি। রয়েছেন পঞ্চম স্থানে।
-
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান