ফেসবুক কি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংকটে
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক মাধ্যম ব্যবসা- ফেসবুক ইনকর্পোরেশন। প্রায় ২৫০ কোটি ব্যবহারকারী ফেসবুক ইঙ্কের হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মতো সাইটে যুক্ত আছেন। কিন্তু, কোম্পানিটির ব্যবসায়িক ও তথ্যপ্রচারের নীতি নিয়ে বিগত কয়েক বছর জুড়েই বহু সমালোচনাও হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, বর্ণবাদী বিদ্বেষ থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় উস্কানিদাতাদের নিজস্ব মতাদর্শ প্রচারের সুযোগ করে দিচ্ছে ফেসবুক। এমনকি প্রতিবেশী মিয়ানমারের উগ্রবাদীদের রোহিঙ্গা গণহত্যার প্রেক্ষাপট তৈরিতেও ভূমিকা রেখেছিল প্ল্যাটফর্মটি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানিটি এ নিয়ে গণমাধ্যমের সমালোচনা, জনরোষ এবং মার্কিন কংগ্রেসের নিজস্ব তদন্তের মুখেও পড়েছে। অতীতে এসব সংকট একের পর এক মোকাবিলা করলেও, এবার একসঙ্গে তিনটি ঝড়ই আঘাত হানতে চলেছে। ফলে দীর্ঘ ১৭ বছরের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে তীব্র ও বহুমুখী সংকটে পড়তে যাচ্ছে সিলিকন ভ্যালির টেক-জায়ান্টটি।
গত শুক্রবার সিএনএনসহ যুক্তরাষ্ট্রের ১৭টি গণমাধ্যমের একটি জোট ফেসবুক নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করে; যাকে বলা হচ্ছে- দ্য ফেসবুক পেপার্স।
এতে কোম্পানির একান্ত অভ্যন্তরীণ পরিচালনার বিবরণসহ মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস) ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে উন্মুক্ত করা তথ্যাবলি রয়েছে। রয়েছে মার্কিন কংগ্রেসকে দেওয়া ফেসবুক হুইসেলব্লোয়ার ফ্রান্সেস হাউগেনের স্বাক্ষ্যের বিবরণসহ চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
কোম্পানিটির নীতি কীভাবে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতায় মদদদাতাদের সংগঠিত করে, তা তুলে ধরেন হাউগেন।
তিনি জানান, গত ৬ জানুয়ারি মার্কিন পার্লামেন্ট ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার নেপথ্যে ফেসবুকে প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একইসাথে, ভারতের মতো বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সামাজিক মাধ্যমটির কন্টেট মডারেশনে ব্যর্থতার দিকটি তুলে ধরেছেন হাউগেন। কীভাবে মানব পাচারকারী চক্রগুলোও এই সাইট ব্যবহার করে মানুষকে শোষণ করছে, সেটিও উঠেছে তার স্বাক্ষ্যে।
সিএনএন নিজেদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব ইস্যু তুলে ধরেছে। এর আগে হাউগেন ফেসবুকের হাজার হাজার গোপন নথি ফাঁস করে দিয়েছিলেন। সেগুলোর উপর ভিত্তি করে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল আরেক প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম- দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল। তারপর থেকেই চলা সমালোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে দ্য ফেসবুক পেপার্স।
ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের হাতে আসা নথিকে বলা হয়েছিল 'ফেসবুক ফাইলস'। এর ভিত্তিতে কিশোরীদের ওপর ইনস্টাগ্রামের মন্দ প্রভাব তুলে ধরা হয় একটি প্রতিবেদন। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটের একটি উপ-কমিটিতে শুনানিও হয়। কমিটির কাছে জবানবন্দি দেন ফ্রান্সেস হাউগেন।
এসময় তিনি আইনপ্রণেতাদের বলেন, "ফেসবুকের 'পণ্য' শিশুদের জন্য ক্ষতিকর, এটি সমাজে বিভেদের জাল বুনে আমাদের গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করছে।"
এরপর কমিটির সদস্যরা ফেসবুকের শীর্ষ নির্বাহী ও প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গকে স্বাক্ষ্য দিতে আসতে বলেন।
এখানেই শেষ নয়, ফেসবুকের সামনে যেন সংকটের অন্ত নেই।
গত শুক্রবার ফেসবুকের আরেক সাবেক কর্মী বেনামে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক কমিশনের কাছে একটি অভিযোগ করেন, যার সঙ্গে মিল রয়েছে হাউগেনের অভিযোগের।
ডেটা প্রাইভেসি বা ব্যবহারকারীর তথ্যের নিরাপত্তা ভঙ্গসহ উগ্র বা মিথ্যা প্রচারমূলক কন্টেট সম্পাদনায় ব্যর্থতার বহু অভিযোগ আগেও মোকাবিলা করেছে ফেসবুক। কিন্তু, এবার এত বেশি পরিমাণ নথি গণমাধ্যমের হাতে এসেছে, যা একে-একে প্রকাশিত হয়ে কোম্পানিটির সামগ্রিক ব্যবসায়ীক মডেলের প্রতিটি দিকে সমস্যাগুলো তুলে ধরছে।
ঘৃণামূলক ও মিথ্যে তথ্য প্রচারে বাধাদানে ব্যর্থতাসহ, আন্তর্জাতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে আগ্রাসী নীতি এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর-কিশোরীদের খারাপ প্রভাব থেকে রক্ষায় ব্যর্থতার দিক উঠে আসছে একের পর এক। এসব বিষয় ইঙ্গিত দেয় যে, ফেসবুক তাদের বিশালসংখ্যক ব্যবহারকারী ব্যবস্থাপনার সঠিক গুরুত্বও বোঝেনি।
সব মিলিয়ে কোম্পানিটির জন্য অস্বস্তিকর কিছু প্রশ্ন উঠছে; ফেসবুক ইঙ্ক কী তাদের সুবিশাল প্ল্যাটফর্মগুলো সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাস্তব দুনিয়ায় হিংসা বা সংঘাত ঠেকাতে সক্ষম? নাকি ফেসবুক এত বড় ও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে, যে এসব পরোয়া না করেই ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে?
প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইছে ফেসবুক:
ফেসবুক পেপার্স ফাঁস হওয়ার পর থেকেই ফ্রান্সেস হিউগেনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে ফেসবুক। কোম্পানিটির দাবি, তিনি আইনপ্রণেতাদের কাছে দেওয়া স্বাক্ষ্য ও গণমাধ্যমে পাঠানো নথিতে ফেসবুকের কর্মকাণ্ড ও চেষ্টাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন। সোজা কথায়, হিউগেন একজন মিথ্যেবাদী এমন কথাই বলা হচ্ছে।
সিএনএন'কে পাঠানো এক বিবৃতিতে ফেসবুকের একজন মুখপাত্র বলেন, 'তিনি যেসব গল্প ফেঁদে বসেছেন তার মূল প্রস্তাবই অসত্য। আমরা ব্যবসা করছি এবং মুনাফার উদ্দেশ্যেই করছি- সেটা ঠিক; তবে মানুষের নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলে বা জনকল্যাণকে অগ্রাহ্য করে হলেও ব্যবসা করছি- তা সত্য নয়। কারণ, এগুলো নিশ্চিত করাই আমাদের বাণিজ্যিক স্বার্থের সাথে জড়িত।'
গত সপ্তাহে করা এক টুইটে কোম্পানির যোগাযোগ বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট জন পিনেট্টে ফেসবুক পেপার্স'কে 'ফেসবুকের কোটি কোটি নথির ভেতর থেকে সযত্নে বাছাইকৃত কিছু নথির সংগ্রহ' বলে উল্লেখ করেন, যা ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে সঠিক উপসংহার তুলে ধরেনি বলেও দাবি তাঁর।
কিন্তু, এই প্রতিক্রিয়াই স্পষ্টভাবে আরেকটি বিষয় তুলে ধরছে। সত্যিকার অর্থেই, যদি ফেসবুকের সমস্ত নথি সম্পূর্ণ সত্যের ইঙ্গিতবহ হয়, তাহলে ফেসবুক কেন সেগুলো নিজেরাই প্রকাশ করছে না?
সম্ভবত তা অপ্রিয় সত্যকে আরও জোরালোভাবে প্রকাশ করবে, সেই আশঙ্কাই কাজ করছে। যেমন- মার্কিন সিনেটে দেওয়া স্বাক্ষ্যে ফেসবুকের বৈশ্বিক নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান এন্টিগন ডেভিস বলেন- 'নথিগুলোর ওপর ভিত্তি করে আরও গবেষণা প্রকাশের উপায় খোঁজা হচ্ছে।'
অর্থাৎ, কোম্পানিটি নথি সম্পূর্ণ প্রকাশ নয় বরং সেগুলোর ওপর নিজস্ব আঙ্গিকের গবেষণা প্রকাশেই আগ্রহী। তবে এবার যদি বহুমুখী চাপ বাড়তেই থাকে, তবে হয়তো কোম্পানিটির এ অবস্থানও বদলাবে।
- সূত্র: সিএনএন