মিয়ানমার অভ্যুত্থান: ভোট জালিয়াতির কোনো প্রমাণ আছে সেনাবাহিনীর কাছে?
নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে মিয়ানমারে সংঘটিত সেনা অভ্যুত্থানের ফলে অপসারণ ঘটেছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ও তার নেতৃবৃন্দের।
সেনাবাহিনীর এই কর্মকাণ্ডকে ঘিরে তীব্র নিন্দার ঝড় উঠেছে দেশটির ভেতরে ও বাইরে। কিন্তু তারা ভোট জালিয়াতির যে দায় চাপিয়েছে, তার কি সত্যিই কোনো ভিত্তি রয়েছে?
সেনাবাহিনীর ভাষ্য
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভাষ্যমতে, দেশটিতে গত ৮ নভেম্বরে নির্বাচনে আট মিলিয়নেরও বেশি ভোট জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। সেই নির্বাচনে অং সান সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি(এনএলডি) সারা দেশে ৮০ শতাংশ আসন পেয়ে জয়লাভ করে।
ক্ষমতা দখলের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী জেনারেল মিন অং হ্লাইং বলেন, দেশব্যাপী ব্যাপক ভোট জালিয়াতি হয়েছে, যা দেশের নির্বাচন কমিশনের চোখে ধরা পড়েনি।
স্বতন্ত্র অনুসন্ধানকারীদের মতে, ভোট প্রক্রিয়ায় কিছু উল্লেখযোগ্য ভুলত্রুটি থাকলেও নির্বাচনে জালিয়াতি হবার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। একই কথা জানিয়ে দেশটির নির্বাচন কমিশনও বলেছে, সেনাবাহিনীর দাবির কোনো ভিত্তি নেই।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা কার্টার সেন্টারের প্রায় ৪০ জন পর্যবেক্ষক নির্বাচনের দিন মিয়ানমারের বিভিন্ন নির্বাচন কেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন। তারাও জানান, তাদের রিপোর্টে নির্বাচনের কোনো বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভুল ধরা পড়েনি।
জালিয়াতির যে দাবি সেনাবাহিনীর
কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীর দাবি, ভোটার তালিকায় অবশ্যই একজন ব্যক্তির নাম থাকবে, যেন তিনি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন। এই কাজগুলো স্থানীয় প্রশাসনিক লোকজন নির্বাচনের সময় করেছে।
২০২০ সালের গ্রীষ্মে একটি ড্রাফট প্রকাশ করা হয় এবং অক্টোবরে আরও একটি সংশোধনী প্রকাশ করা হয়, যার ফলে মাঝখানে একটি সময় গেছে ভুল সংশোধনের কাজে। একেবারে সর্বশেষ তালিকাটি পোলিং স্টেশনের বাইরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
সেনাবাহিনীর দাবি, তারা সারা দেশব্যাপী ভোটার তালিকায় অসংলগ্নতা এবং অযোগ্য ভোটারের তালিকা পেয়েছে। তাদের কাছে সারা দেশে প্রায় সাড়ে ১০ মিলিয়ন ভোট জালিয়াতির প্রমাণ রয়েছে বলে তারা জানায়।
সেনাবাহিনী আরও জানায়, তারা বিভিন্ন শহর থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে এবং জানতে পেরেছে, একই নাম কিংবা ভিন্ন নাম ব্যবহার করে বহু স্থানে একই রেজিস্ট্রেশন নম্বর বারবার ব্যবহার করা হয়েছে।
এমনকি তারা রেজিস্ট্রেশন নম্বরবিহীন আইডিও পেয়েছে।
সেনাবাহিনীর আরও দাবি, তারা এইসব তথ্য ঠিকমতো যাচাই করতে পারছে না; কারণ নির্বাচনের পরপরই ভোটার তালিকা জনসম্মুখ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং নির্বাচন কমিশন গোপনীয়তার নাম দিয়ে তা নিজেদের কাছে কুক্ষিগত করে রেখেছে।
পুনরায় ভোটদানে বাধা কোথায়?
সেনাবাহিনীর দাবি, একই ব্যক্তি হয়তো বিভিন্ন স্থানে আলাদাভাবে রেজিস্ট্রেশন করে একাধিকবার ভোট দিয়েছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বলছে, সেটি সম্ভব নয়। কারণ নির্বাচনের সময় সর্বত্র কড়া পাহারা ছিল।
তারা আরও জানায়, একজন ব্যক্তি ভোটদানের সঙ্গে সঙ্গেই তার আঙুলে যে কালির চিহ্ন দেওয়া হয়, তা অন্তত এক সপ্তাহ টিকে থাকে; তাই পুনরায় ভোট দিতে আসা সম্ভব নয়। যে কালি দিয়ে এই চিহ্ন দেওয়া হয়, তাতে রয়েছে সিলভার নাইট্রেট- যা সূর্যের আলোতে চামড়ার ওপর স্থায়ী একটি দাগ ফেলে এবং পানি, সাবান বা অন্য কোনো লিকুইড পরিষ্কারক ব্যবহার করলেও ওঠে না। এই কালি বিশ্বের অনেক দেশে নির্বাচনের সময় ব্যবহৃত হয়।
এছাড়াও মিয়ানমার করোনার দ্বিতীয় ধাপ বৃদ্ধির সময় থেকেই তাদের দেশে ভ্রমণে নানা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তাই একই ব্যক্তির পক্ষে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে ভোট দেওয়া অসম্ভব বলে নির্বাচন কমিশনের দাবি।
আইডি কার্ড সম্পর্কিত দাবি
সেনাবাহিনীর দাবি, ভোটার তালিকায় জাতীয় রেজিস্ট্রেশন কার্ড ছাড়াই পাঁচ মিলিয়ন নাম রয়েছে। বিষয়টি জনগণের ভোট দেওয়ার অধিকারের ব্যাপারে অস্বচ্ছতা তৈরি করেছে, যদিও এটি কীভাবে সংঘটিত হলো, তা নিয়ে পরিষ্কার করে কিছুই জানানো হয়নি।
নির্বাচন কমিশন জানায়, অফিসিয়াল আইডি ছাড়াই ভোটার লিস্টে নাম যাওয়া সম্ভব; যদি কেউ স্থানীয় প্রশাসনের কাছে নিজেকে সঠিকভাবে প্রমাণ করতে পারেন, যে তিনি ওই এলাকারই বাসিন্দা। এটি করতে হলে সেই প্রশাসনকে আবার একটি চিঠি দিয়ে কমিশন থেকে প্রমাণ করিয়ে নিতে হবে। তাই এভাবে ৪.৬ মিলিয়ন বাড়তি ভোটার তৈরি করা অসম্ভব।
বলে রাখা ভালো, মিয়ানমারে প্রত্যেকের কাছেই জাতীয় আইডি কার্ডও নেই। যেমন, রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির কাছে কোনো জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। নিরাপত্তা ইস্যু দেখিয়ে কিছু সংখ্যালঘু অঞ্চলে ভোটদান স্থগিত বা বাতিল করাও হয়েছিল।
ভুলত্রুটি রয়েছে, তবে গণহারে জালিয়াতি নয়
মিয়ানমারের ইতিহাসে ভোটার তালিকা নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হওয়া এটিই প্রথম নয়। ২০১৫ সালে যখন অং সান সু চি একটি বড় জয় পান, তখনো নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কিছু মানুষের নাম নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে ভোটার তালিকা থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছিল। এবারের নির্বাচনেও ভোটের একমাস আগে ইলেক্টোরাল রোলে নানা ভুল পাওয়া যায়।
তবে ভোটার রেজিস্ট্রেশনে ভুলের প্রমাণ পাওয়া গেলেও মিয়ানমারের মতো একটি দরিদ্র ও দুর্বল আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যাপক হারে ভোট জালিয়াতি করা সম্ভব নয়।
- সূত্র: বিবিসি