মূল্যস্ফীতি কেবল বাড়বেই, আশঙ্কা বিশ্বের শীর্ষ কোম্পানিগুলোর নির্বাহীদের
মূল্যস্ফীতির অস্বাভাবিক চাপ সাময়িক কি না, তা নিয়ে গোলকধাঁধায় পড়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররা। তবে বিশ্বব্যাপী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কর্মকর্তাদের স্পষ্ট বার্তা: পণ্যের দাম আগামী দিনেও বাড়তেই থাকবে।
মহামারিজনিত লকডাউন থেকে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পর চাহিদা বাড়লেও, দেখা দিয়েছে জ্বালানি, কার্গো জাহাজ, কন্টেইনার, সেমিকন্ডাক্টর ও অবকাঠামো নির্মাণ উপকরণের সংকট। ফলে খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যস্ত সময় পার করছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
বিশ্বের বৃহৎ কিছু ব্র্যান্ড এখন বাড়তি খরচের বোঝা ভোক্তাদের কাঁধে চাপাচ্ছে। তবে তারা মূল্যস্ফীতির সীমা বেঁধে দেওয়া নীতিনির্ধারকদের সতর্ক করে বলেছে, পরিস্থিতি আরও বাজে রূপ নিতে পারে। অর্থাৎ তাদের লক্ষ্যমাত্রার চাইতেও অনেকগুণ বাড়বে পণ্যের দাম।
এ ব্যাপারে ইউনিলিভারের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা গ্রিয়াম পিটকেথলি বলেন, 'আমরা চলতি বছরের চেয়ে আগামী বছর মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়ার আশঙ্কা করছি।'
অথচ ডাভ সাবান, ওয়াশিং পাউডার থেকে শুরু করে বেন অ্যান্ড জেরি আইসক্রিমের মতো ইউনিলিভারের হাজারো পণ্য প্রতিদিন ২৫০ কোটি মানুষ ব্যবহার করছে বলে জানিয়েছে কোম্পানিটি। অর্থাৎ এ বিপুল পরিমাণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর চাপ আরও অসহনীয় হবে। ফলে কমতে পারে ভোগ চাহিদাও।
এর আগে চলতি সপ্তাহের শুরুতে বিশ্বের বৃহত্তম প্রক্রিয়াজাত খাদ্য প্রস্তুতকারক নেসলে তাদের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দেয়। ২০২১ সালে দাম বাড়ানোর পর, আগামী বছরেও আরেকদফা বাড়ানো হবে, যার নেপথ্যে রয়েছে কাঁচামালের দামের ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতি।
অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরদের অস্পষ্ট কথাবার্তার তুলনায় নিশ্চিত সম্ভাবনার ইঙ্গিতই দিচ্ছেন কোম্পানি বোর্ডরুমের শীর্ষ ব্যক্তিরা। এর প্রধান কারণ, মূল্যস্ফীতির অন্যতম চালিকাশক্তি অধিক তারল্য, অর্থনীতিকে সমর্থন দিতে মহামারির সংকটের মুহূর্তে বিপুল প্রণোদনা ও বাজেট সহায়তা ঘোষণা করা হয়। যা এবার সরকারি কর্তৃপক্ষকেই বন্ধ করা বা অব্যাহত রাখার মতো জটিল সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
গেল সপ্তাহে ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শীর্ষ কর্মকর্তারা এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকের আগে খসরা প্রজ্ঞাপনে বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর প্রতি পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানায় আইএমএফ। তবে বৈঠকের পর দেওয়া বার্তায় সেই কঠোর সুর আর শোনা যায়নি।
বৈঠক শেষে দেওয়া বার্তায় আইএমএফ-এর পরিচালক কমিটি বৈশ্বিক নীতিনির্ধারকদের প্রতি মূল্য ওঠানামার গতিপ্রকৃতির ওপর ঘনিষ্ঠভাবে নজর দেওয়ার আহবান জানান। একইসঙ্গে, মূল্যস্ফীতির এই চাপ অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় এলে দূর হবে কি না সেদিকেও লক্ষ্য রাখার অনুরোধ করেছে। অর্থাৎ বৈঠক শেষে আইএমএফ প্রণোদনা প্রত্যাহারের মতো কঠোর পরামর্শ দেওয়ার চেয়ে সংযত অবস্থান নিল।
বৈঠকের পর ফরাসী অর্থমন্ত্রী ব্রুনো লে মায়ার বলেন, 'এই মূল্যস্ফীতি সাময়িক কি না সেটাই আসল প্রশ্ন। কিন্তু কেউই এর সঠিক উত্তর জানে না।'
কাঠামোগত ঘাটতি:
যুক্তরাজ্যে বর্তমান মূল্যস্ফীতি হার ৩.১ শতাংশ, যা আরও বাড়ার আভাস দেওয়া হয়েছে। এই মূল্যস্ফীতি সাময়িক বলে মন্তব্য করেছেন ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর আন্ড্রু বেইলি। তবে মহামারি-পরবর্তী সময়ে বিশ্বের প্রধান প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবার আগে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডই সুদ হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার সিদ্ধান্ত নেবে বলে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ ধারণা করছেন।
কিন্তু বাণিজ্যের একাধিক খাতে জড়িত কোম্পানিগুলোর নির্বাহীদের মতে মূল্য বৃদ্ধির পেছনের কিছু সমস্যা কাঠামোগত ও স্থায়ীভাবে তার প্রভাব থাকবে। র্যান্ডস্ট্যাডের মতো বৈশ্বিক নিয়োগদাতা সংস্থার নির্বাহীরা এমন কথাই বলেছেন।
আজ বৃহস্পতিবার র্যান্ডস্ট্যাড জানায়, বয়স্ক কর্মীদের পদত্যাগ বৃদ্ধি ও সে তুলনায় কম সংখ্যক দক্ষ তরুণ কর্মীর চাকরির বাজারে প্রবেশের কারণে আগামী কয়েক বছর জুড়ে তারা কর্মী সংকট থাকার ধারণা করছে।
র্যান্ডস্ট্যাডের বিদায়ী প্রধান নির্বাহী জ্যাক ভ্যান ডেন ব্রোয়েক বলেন, "আমরা মনে করি, এ সংকট হবে কাঠামোগত, যেমন- স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও রসদ খাতে যথেষ্ট দক্ষ কর্মীর চাকরির সুযোগ রয়েছে। কর্মী সংকটে ব্যাহত হবে এসব খাতের পরিষেবা।"
মূল্যস্ফীতিতে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায়, কর্মীরাও বেতন বৃদ্ধির দাবি তুলেছে।
ইউরোপের চালিকাশক্তি জার্মানি এমনই এক চাপের মুখে, দেশটির সবচেয়ে বড় শ্রমিক ইউনিয়নগুলো ৯ লাখ নির্মাণ শ্রমিকের বেতন বৃদ্ধির দাবি তুলছে।
দক্ষ কর্মীর সংকটে ভুগছে সুইস প্রকৌশল কোম্পানি এবিবি। বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ কমে আসার চাপে রয়েছে সংস্থাটি। একইসঙ্গে, তারা যুক্তরাষ্ট্রে কর্মী সংকটের কথাও জানিয়েছে। এই সংকট তাদের রোবট ও অন্যান্য পণ্য উৎপাদন ব্যাহত করছে।
সেমিকন্ডাক্টর চিপ দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠায় ইতোমধ্যেই পৃথিবীজুড়ে মোটরযান উৎপাদন কমেছে।
বৃহস্পতিবার সুইস ট্রাক প্রস্তুতকারক এবি ভলভো জানায়, তাদের ট্রাকের শক্তিশালী চাহিদা থাকার পরও, চিপসের মতো যন্ত্রাংশ স্বল্পতা ও জাহাজে পরিবহনের সমস্যার কারণে মূল্য বেড়ে যাচ্ছে, উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।
কাঁচামালের মূল্য বেড়ে যাওয়ার একইরকম সমস্যার কথা জানিয়েছে সুইস এলিভেটর প্রস্তুতকারক শিন্ডলার। উচ্চ হারে মূল্যস্ফীতি ও সরবরাহ চক্রে সংকোচন দুটি সমস্যাই দীর্ঘদিন থাকার কথা জানিয়েছে কোম্পানিটি।
- সূত্র: রয়টার্স