সুয়েজ অচলাবস্থায় সরবরাহ জটে পড়তে পারে মহামারিতে দুর্বল বিশ্ব অর্থনীতি
বিশ্ববাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ধমনী মিশরের সুয়েজ খাল। ভূমধ্য ও লোহিত সাগরকে সংযুক্তকারী সুয়েজের মাধ্যমেই গতিশীল থাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে বাণিজ্য। তবে এমভি এভার গিভেন নামক সুবিশাল কন্টেইনারবাহী জাহাজ মরুঝড়ের কারণে দিক হারিয়ে সুয়েজের কিনারায় আটকে গেছে। জাহাজটির আড়াআড়িভাবে অবস্থানের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে সুয়েজ চ্যানেল। উভয়প্রান্তে আটকা পড়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য।
সুয়েজ থেকে ৬ হাজার মাইল দূরে হলেও যুক্তরাষ্ট্রের মিডওয়েস্টে একটি বহুজাতিক কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী তীক্ষ্ম নজর রাখছেন এই সঙ্কটের ফলে সৃষ্ট পণ্যজটের দিকে। তার সংস্থা শিল্পকাজে ব্যবহারের উপযোগী আঠা উৎপাদন করে। সঙ্কটের দিকে নজর রাখার পাশাপাশি তিনি এর কারণে নিজের ২৮০ কোটি ডলার মূল্যের কোম্পানির উপর আসা নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা নিয়েও ব্যস্ত সময় পার করছেন।
"আমাদের পণ্য উৎপাদনের জন্য অতি-জরুরি হলো বিশেষ কিছু রাসায়নিক। মহামারির মধ্যে এসব রাসায়নিকের সরবরাহ চক্র এমনিতেই চাপের মুখে পড়েছিল। সুয়েজ জটে সেই চাপের মাত্রা আরো বাড়লো," বলছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা ভিত্তিক এইচ.বি. ফুলার কো. নামক সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট ও মুখ্য নির্বাহী জিম ওয়েনস। তিনি ওয়ালস্ট্রিটের পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের গত সপ্তাহেই একথা জানান। ওই সময়েই আটকে পড়া জাহাজটি মুক্ত করার প্রথম চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন উদ্ধারকর্মীরা।
ওয়েনস বলেন, "এই মুহূর্তের পরিস্থিতি হয়তো সবকিছু নেতিবাচকভাবে রূপান্তরিত করবে না। তবে এটি এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা তেমন ঝুঁকি সৃষ্টি করতেও পারে, তাই আমরা সতর্ক নজর রাখছি।"
এ মনোভাব বাণিজ্যিক দুনিয়ার অন্য সকলেরও। যেকারণে, সুয়েজের বালুময় পাড়ে আটকে পড়া এভার গিভেন'কে মুক্ত করার চেষ্টা- নতুন মাত্রা লাভ করেছে উদ্ধারযন্ত্র আর মানব প্রকৌশল সক্ষমতাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে। সঙ্গে আছে গ্রহ-উপগ্রহ চক্রের সাহায্য প্রত্যাশা, অর্থাৎ আগামী সোমবার উচ্চ জোয়ারের সাহায্য নিয়ে দানবিক জাহাজটি মুক্ত করার চেষ্টা চালাবেন স্যালভেজ প্রকৌশলীরা। জোয়ারের সাহায্য ছাড়া সিডনি হারবার ব্রিজের চাইতে চারগুণ বেশি ভারি জাহাজটিকে মুক্ত করা সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন তারা।
এই পাকচক্রে অচল হয়ে পড়েছে দৈনিক ১০ বিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক পণ্য পরিবহন। প্রতিদিন এ পরিমাণ শিল্প উপাদান ও ভোক্তা পণ্য স্বাভাবিক অবস্থায় সুয়েজ খাল পাড়ি দিত। এশিয়ার রপ্তানিকারক এবং ইউরোপের আমদানিকারকরা ছিলেন নৌবাণিজ্য পথটির প্রধান ব্যবহারকারী। তাদের সবার মধ্যেই এখন কাজ করছে সরবরাহ চক্রটি আরো বেশিদিন বিচ্ছিন্ন থাকার ভয়। পণ্য পৌঁছানোর দেরিতে সরবরাহ চক্রে যোগ হচ্ছে খরচ বৃদ্ধির মাধ্যমে মুনাফা হ্রাসের আশঙ্কা। বার্ষিক ১৮ লাখ কোটি ডলার মূল্যের বাণিজ্যিক পণ্য সমুদ্রপথে পাড়ি দেয়- সুয়েজ তার একটি ছোট অংশের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করলেও, চ্যানেলটি বন্ধ থাকায় প্রতিটি দিন আর্থিক ক্ষতির মাত্রা নতুন উচ্চতা লাভ করছে।
সিঙ্গাপুর ভিত্তিক আইএইচএস গ্লোবাল ইনসাইট- এর নৌবাণিজ্য শাখার প্রেসিডেন্ট রাহুল কাপুর বলেন, "মহামারির অভিঘাত থেকে সদ্য উত্তরণের পথে থাকা দুর্বল সরবরাহ চক্রের উপর এটি মারাত্নক আঘাত হেনেছে। অচলাবস্থা আরো কয়েক সপ্তাহ ধরে থাকলে তা নিশ্চিতভাবেই বিপর্যয়ে রুপ নেবে।"
জার্মানির কিল ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার্ল্ড ইকোনমির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ভিনসেন্ট স্ট্যামার বলেন, "এপর্যন্ত হওয়া দেরিতে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে, কিন্তু এখনও তার মাত্রা নির্ধারণের সময় আসেনি।" একথার মাধ্যমে লোকসানের পরিধি আরো বাড়বে বলেই ইঙ্গিত দেন তিনি।
অবশ্য, জাহাজ কোম্পানিগুলোর হাতে এখনও বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। ইতোমধ্যেই, কিছু তেলবাহী ট্যাঙ্কার ও কন্টেইনারবাহী জাহাজ লোহিত-ভূমধ্যসাগরের মধ্যে বন্ধ থাকা সংক্ষিপ্ত পথটি এড়িয়ে আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তের উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ঘুরে যাচ্ছে। তাতে যেমন এশিয়া থেকে ইউরোপ যাত্রায় এক সপ্তাহের বেশি সময় বাড়ছে, তেমনিভাবে লাখ লাখ ডলারের বাড়তি জ্বালানি খরচ করতে হচ্ছে জাহাজগুলোকে। তবে সুয়েজ পাড়ি দিতে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করার চাইতে এই পন্থাকেই বেঁছে নিয়েছে অনেক শিপিং কোম্পানি।
পরিস্থিতিদৃষ্টে তাদের সিদ্ধান্ত সঠিক বলেই মনে হয়। কারণ গত শনিবার নাগাদ সুয়েজের প্রবেশমুখে অপেক্ষা করছিল ৩২০টির বেশি নৌযান।
তবে বিপুল কাঁচামাল সরবরাহ প্রাপ্তির উপর নির্ভরশীল শিল্প সংস্থাগুলো কিন্তু বসে নেই, তাদের জন্য বাড়তি এক সপ্তাহ দেরি উৎপাদন কাজে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই এর মধ্যেই সুইডেনের বিখ্যাত ফার্নিচার নির্মাতা- আইকিয়া থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ের অবকাঠামো যন্ত্রপাতি উৎপাদক- ক্যাটারপিলার ইঙ্কের মতো সংস্থাগুলো বিকল্প উৎস থেকে কাঁচামাল সংগ্রহের সুবিধা-অসুবিধা বাছবিচার করে দেখছে।
স্বল্পমেয়াদে সরবরাহ চক্রে রদবদল আসলে পরিবহন খরচ অনেকগুণ বাড়বে, সঙ্কুচিত হবে বাণিজ্য চক্রের স্বাভাবিক ছন্দ।
বিশ্ব অর্থনীতি এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতিও লক্ষ্য করছে, বিলম্বিত চক্রের কারণে উৎপাদন খরচ বাড়লে সেকারণে কমবে ভোক্তাদের সামর্থ্য। মহামারির অভিঘাত থেকে বিশ্ব অর্থনীতির উত্তরণে যা কোনোভাবেই সহায়ক হবে না।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ