কলম্বো বন্দরে জাহাজজটে সরবরাহ শৃঙ্খলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা
শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে জটের কারণে দেরি হচ্ছে জাহাজে পণ্য লোড-আনলোডে, সংকটের আগুনে ঘি ঢালছে বন্দরে পণ্যবাহী যান (ট্রাক,লরি) পরিষেবার ব্যাঘাত। কলম্বো বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হওয়ায়- সরবরাহ চক্রের এই ছন্দপতনের ঢেউ বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে আছড়ে পড়ার হুমকি সৃষ্টি করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম থেকে রপ্তানি পণ্য কলম্বোয় পৌঁছাতে এবং সেখানে মাদার ভেসেলে লোড করতে সাধারণত আট দিন সময় লাগে। তবে তীব্র কন্টেইনার জট সৃষ্টি হওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ এই ট্রান্সশিপমেন্ট হাবে কাজটি সম্পূর্ণ করতে- বর্তমানে আরও তিন দিন অতিরিক্ত সময় লাগছে।
পণ্য চালানে এই অতিরিক্ত সময় লাগায়, বিদেশি ক্রেতাদের কাছে সময়মতো পণ্য সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা। জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা বা শিপিং লাইনগুলিও উদ্বিগ্ন। কলম্বো বন্দরে জাহাজগুলিকে বাড়তি সময় অলসভাবে অপেক্ষা করতে হচ্ছে, এতে আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করছে তারা।
করোনা মহামারি দীর্ঘায়িত হওয়ায় এরমধ্যেই জাহাজ ভাড়া চার থেকে পাঁচগুণ বেড়েছে। সরবরাহ শৃঙ্খল এখনও মহামারির অভিঘাতগুলি পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, কলম্বো বন্দরের জট এই সংকটকে আরো ঘনীভূত করবে।
মেডিটেরনিয়ান শিপিং কোম্পানির(এমএসসি) হেড অব অপারেশন অ্যান্ড লজিস্টিকস- আজমির হোসেন চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শ্রীলঙ্কার বন্দরটিতে গত এক মাস ধরে চলছে এই সংকট।
তিনি উল্লেখ করেন, শুরুতে এক দিন সময় বেশি লাগতো। এখন সেটি দাঁড়িয়েছে তিন দিনে। বাড়তি মজুরির দাবিতে সেখানে অনেক লরি শ্রমিকই কাজে যোগ দিচ্ছে না। দ্বীপদেশটিতে চরম জ্বালানি সংকটও বন্দরে প্রাইম মুভার্স যানের স্বল্পতা তৈরি করেছে।
"আগে প্রায় চার শতাধিক প্রাইম মুভার/ লরি দিয়ে ওই বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করা হতো। এখন এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুটিতে। প্রাইম মুভার সংকট থাকায় ফিডার ভেসেল থেকে নামিয়ে আমদানি-রপ্তানি পণ্যবোঝাই কন্টেইনার মাদার ভেসেলে ওঠাতে অতিরিক্ত সময় লাগছে।"
গভীরতা কম থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরে ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের চেয়ে বড় কন্টেইনার জাহাজ ভিড়তে পারে না। ফলে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর যেমন- শ্রীলঙ্কার কলম্বো, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং ও তানজুম-পেলিপাস বন্দরের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা তাই ঐতিহাসিক।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে দিয়ে আমদনিকৃত পণ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ পরিবহন হয় সিঙ্গাপুর বন্দর ব্যবহার করে। এছাড়া, কলম্বো বন্দর দিয়ে ৩০ শতাংশ এবং ১০ শতাংশ হয়ে থাকে পোর্ট কেলাং এবং অন্যান্য বন্দর ব্যবহার করে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের ৪০ শতাংশ হয় চট্টগ্রাম-কলম্বো রুট ব্যবহার করে, আরো ৪০ শতাংশ সিঙ্গাপুরের মাধ্যমে এবং বাকী ২০ শতাংশ কেলাং, তানজুম-পেলিপাস এবং অন্যান্য বন্দরগুলির মাধ্যমে পরিচালিত হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
কলম্বো বন্দর ব্যবহার করে অন্য ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের চেয়ে ৩-৪ দিন আগে ইউরোপে পণ্য পৌঁছানো যায়। তাই বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের ইউরোপে রপ্তানি পণ্য পরিবহনে কলম্বো বন্দরের প্রতি আগ্রহ বেশি বলেও জানান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ।
খাতটিতে জড়িতরা টিবিএসকে বলেছেন, মহামারিজনিত কারণে জাহাজ এবং কন্টেইনার ঘাটতির কারণে ইউরোপ এবং আমেরিকার রুটে জাহাজ ভাড়া পাঁচ গুণের মতো বেড়েছে। মহামারির আগে আমেরিকাগামী কন্টেইনার ভাড়া ছিল ৩ হাজার ডলার, মহামারির প্রাদুর্ভাব সর্বোচ্চ থাকাকালে যা ৫০০ শতাংশ বেড়ে ১৮ হাজার ডলারে উন্নীত হয়। ইউরোপগামী কন্টেইনার ভাড়া আড়াই হাজার থেকে ৪০০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ১২ হাজার ডলারে। এখনো প্রায় একই অবস্থা বিরাজ করছে।
এছাড়া শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে জটের কারণে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের প্রায় ২৫ হাজার কনটেইনার সমুদ্রপথে আটকে রয়েছে।
কর্ণফুলী গ্রুপের সহযোগী এইচআর লাইনস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক আনিস উদ দৌলা জানান, তাদের ছয়টি কন্টেইনার জাহাজের মধ্যে চারটি চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটে চলাচল করে। অন্য দুটি জাহাজ কেলাং এবং সিঙ্গাপুর রুটে চলাচল করে।
"কলম্বো বন্দরে জটের কারণে সময় মতো পণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। আগে বন্দরে পৌঁছানোর পর দ্রুত মাদার ভেসেলে কন্টেইনার বোঝাই করা যেত। এখন তাতে তিন দিন সময় বেশি লাগছে। জটের কারণে মাদার ভেসেল মিস করার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। জাহাজ একদিন বসে থাকার কারণে প্রায় ২০ হাজার ডলার ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে জাহাজ মালিকদের।"
বিজিএমইএ'র প্রথম সহ- সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, কলম্বো বন্দরে জটের কারণে তৈরি পোষাক শিল্প নতুন করে সংকটে পড়ছে। এই জট বাড়লে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে নির্ধারিত সময়ে পণ্য পাঠানো দুরূহ হয়ে পড়বে।
চীনে মহামারির প্রাদুর্ভাব রোধে সাম্প্রতিক লকডাউনের কারণে সমুদ্রপথে সরবরাহ শৃঙ্খলে বিপর্যয় ঘটেছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ নজরুল বলেন, দীর্ঘদিন লকডাউনের এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অবশ্যই বিরুপ প্রভাব পড়বে।
সমাধানের কোনো উপায় কি আছে?
টিএডি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশিকুর রহমান (তুহিন) বলেন, "ইইউ-ভিত্তিক বন্দরে সরাসরি নৌযান চালু করা গেলে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে পণ্যজট এবং অন্যান্য সমস্যার কারণে সৃষ্ট অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির একটি টেকসই সমাধান হতে পারে। এ ধরনের সরাসরি শিপিং পরিষেবাগুলি জাহাজ ভাড়া বর্তমান পর্যায়ের অর্ধেকে নামিয়ে আনতেও সাহায্য করবে।"
রপ্তানি-আমদানি বাণিজ্যকে মসৃণ করতে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বড় আকারের সরাসরি চলাচলকারী জাহাজের প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তবে তিনি আরো বলেছেন যে, দেশের বন্দরগুলির বর্তমান গভীরতা বড় জাহাজের প্রবেশ উপযোগী নয়, তাই বে-টার্মিনাল চালু না হওয়া পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের অপেক্ষা করতে হবে।
সম্প্রতি, ইতালীয় মালবাহী ফরোয়ার্ডার কোম্পানি রিফ লাইন এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ক্যালিপসো কম্পাজিয়া ডি নেভিগ্যাজিউনে চট্টগ্রাম থেকে ইউরোপে দুটি জাহাজ: সোঙ্গা চিতা এবং কেপ ফ্লোরেস নিয়ে একটি সরাসরি জাহাজ পরিষেবা চালু করেছে।
ব্যবসায়ী নেতারা টিবিএসকে বলেছেন, এই উদ্যোগের পর বেশ কয়েকটি স্থানীয় সংস্থা এরমধ্যেই ইউরোপীয় বন্দরগুলির সাথে সরাসরি অপারেশনের জন্য চার্টার জাহাজ চালু করতে আন্তর্জাতিক শিপিং সংস্থাগুলির সাথে আলোচনা শুরু করেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি লজিস্টিক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে জানিয়েছেন, তার কোম্পানি চট্টগ্রাম এবং জার্মানির হামবুর্গ বন্দরের মধ্যে একটি সরাসরি জাহাজ পরিষেবা চালু করতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ-ইউরোপ সরাসরি জাহাজ চলাচল:
ইতালীয় কোম্পানিটির কেপ ফ্লোরেস জাহাজ খালি কন্টেইনার নিয়ে গত ২৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছালেও ইউরোপে ফেরার পথে কোনো রপ্তানি পণ্য বহন করেনি।
অন্যদিকে, চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইতালির রাভেনা বন্দরের মধ্যে যাত্রা শুরু করে সোঙ্গা চিতা। সোঙ্গা চিতার বহনকারী রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৯৮ শতাংশ ছিল তৈরি পোশাক এবং বাকী ২ শতাংশ হস্তশিল্প, চামড়া এবং পাটজাত পণ্য।
এই উদ্যোগে পরিবহনের সময় কমেছে ২৪ দিন এবং জাহাজ ভাড়া কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
কোনো জাহাজে চট্টগ্রাম থেকে ইউরোপীয় কোনো বন্দরে সরাসরি পণ্য বহনের এটাই ছিল প্রথম ঘটনা, যাতে সময় সময় লেগেছে মাত্র ১৬ দিন। সাধারণত, এসব পণ্য ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের মাধ্যমে চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ৪০ দিন।
বাংলাদেশ-ইতালি সরাসরি রুটটির উদ্বোধনকালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, "পোশাক রপ্তানির গুরুত্ব বিবেচনা করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতালি-বাংলাদেশ রুটে চলাচলকারী জাহাজগুলোকে বার্থিং এবং কী-গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রদানে অগ্রাধিকার দেবে।"
এসময় তিনি আরও বলেন, "সরাসরি শিপিং রুট আমাদের অর্থনীতিতে একটি যুগান্তকারী অধ্যায় শুরু করেছে। যদি অন্য শিপিং লাইনগুলি এ ধরনের সরাসরি রুট চালু করতে চায়, বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদেরও সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা দেবে।"