‘অকাস’ চুক্তিতে ফ্রান্স কেন এত ক্ষুব্ধ?
ফ্রান্সের সাথে কয়েক বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি ভেঙে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার নতুন পরমাণু সাবমেরিন চুক্তিকে ফ্রান্স সরকার "বিশ্বাসঘাতকতা" হিসেবে উল্লেখ করেছে।
প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে মোকাবেলা করতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন আন্তর্জাতিক সমর্থন গড়ে তোলার জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন। আর সে সব পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম হলো, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় এই পারমাণু সাবমেরিন চুক্তি "অকাস"। এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আস্ট্রেলিয়াকে পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন সরবরাহ করে মূলত বেইজিংকে চাপে রাখার পরিকল্পনা করছে।
ফ্রান্সের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন, অকাস চুক্তি "ফ্রান্সের পিঠে ছুরিকাঘাত" এবং এটি এমন একটি পদক্ষেপ, যেখানে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।
ত্রিপক্ষীয় চুক্তির প্রতিক্রিয়ায়, এক ফরাসি কর্মকর্তা শুক্রবার সিএনএনকে জানিয়েছেন, ফ্রান্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রাষ্ট্রদূতকে "পরামর্শের জন্য" প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আধুনিক যুগে এসে ফরাসিরা প্রথমবারের মতো এই ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিলো।
অস্ট্রেলিয়ায় ফরাসি রাষ্ট্রদূতকেও তলব করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।
ত্রিপক্ষীয় চুক্তি নিয়ে ফ্রান্স এত ক্ষুব্ধ কেন?
অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ফ্রান্সের ডিজেলচালিত যে সাবমেরিন চুক্তি হয়েছিল, তা অকাস চুক্তির ফলে হারাতে বসেছে ফ্রান্স। আর এই চুক্তি হারানোয় দেশটির আর্থিক ক্ষতির মূল্য দাঁড়াবে প্রায় ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিশ্বব্যাপী অন্যতম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ ফ্রান্স। প্রতিরক্ষা খাতের অর্থনীতিতে অস্ত্র রপ্তানি থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আয় করে থাকে দেশটি। কিন্তু সম্প্রতি আস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চুক্তি বাতিলের প্রভাব ফ্রান্সের অস্ত্র রপ্তানি আয়কে বেশ প্রভাবিত করবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ফ্রান্স তার কৌশলগত প্রভাব হারাতে পারেও বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।
বৃহস্পতিবার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের সঙ্গে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন চুক্তি ঘোষণার পর, অস্ট্রেলিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রান্সের সঙ্গে তার পূর্ববর্তী চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে।
কয়েক বছর যাবত প্যারিসের সঙ্গে ক্যানবেরার এই চুক্তি চলমান ছিল।
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ-ইভেস লে ড্রিয়ান বলেছেন, অস্ট্রেলিয়ার নতুন সাবমেরিন চুক্তি নিয়ে তিনি "ক্ষুব্ধ এবং বিরক্ত"।
তিনি বলেন, " মিত্রদের মধ্যে এটি করা ঠিক হয়নি। এটি সত্যিই পিঠে ছুরিকাঘাত।"
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও কঠোর বক্তব্য ছুঁড়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে তিনি বলেন, "এই নৃশংস এবং একতরফা সিদ্ধান্ত, ট্রাম্প যা করেছেন তার সঙ্গে অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ।"
বুধবার ফ্রান্সের সশস্ত্র বাহিনী মন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লির সঙ্গে এক যৌথ বিবৃতিতে লে ড্রিয়ান বলেন, "ইউরোপীয় মিত্র ফ্রান্সের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার কাঠামোগত অংশীদারিত্বে আঘাত হেনেছে যুক্তরাষ্ট্র। এমন একটি সময়ে এ আঘাত তারা হেনেছে যখন ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমরা অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি। মূল্যবোধ বা আইনের শাসনের উপর ভিত্তি করে বহুপাক্ষিকতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, ফ্রান্স কেবল এমন সমন্বয়হীনতার প্রতি সচেতন এবং অনুশোচনা দেখাতে পারে"।
লে ড্রিয়ান বলেন, ফ্রান্সের সঙ্গে চুক্তি থেকে সরে আসার অস্ট্রেলিয়ার এই সিদ্ধান্ত "ফ্রান্স এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বিদ্যমান সহযোগিতার চেতনা পরিপন্থী"।
অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়া বলছে, ফ্রান্সের সঙ্গে পূর্ববর্তী চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে তাদের আইনত কোনো বাধা নেই।
ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের হুমকি মোকাবেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অন্যতম শক্তিশালী মিত্র দেশ ফ্রান্সকে বাদ দেওয়ার যে পদক্ষপ নিলো, তা বৈশ্বিক রাজনীতিতে অনেকেই প্রতারণা হিসেবে দেখছেন।
যৌথ বিবৃতিতে লে ড্রিয়ান ফ্রান্সকে "ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রায় দুই মিলিয়ন নাগরিক এবং সাত হাজারেরও বেশি সামরিক কর্মীর একমাত্র ইউরোপীয় প্রতিনিধি দেশ" হিসেবে উল্লেখ করেছেন; সেইসঙ্গে তিনি আরো বলেছেন, ফ্রান্স একটি "নির্ভরযোগ্য অংশীদার, যে তার সমস্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে, যেমনটা সব সময় করে এসেছে।"
অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপারগুলোকে যেভাবে দেখছে
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়া বলছে, ফ্রান্স-অস্ট্রেলিয়া ডিজেল সাবমেরিন চুক্তি যে বাতিল হতে পারে, সে সম্পর্কে ফ্রান্স একেবারেই কিছু জানতো না বিষয়টি এমন নয়। দু'পক্ষ থেকেই বলা হয়েছে, উচ্চপদস্থ ফরাসি কর্মকর্তারা অস্ট্রেলিয়া সরকারের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবগত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন শুক্রবার বলেন, "চুক্তি অবসানের ইঙ্গিত সরাসরি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়েছিল; সরাসরি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছেও পাঠানো হয়েছিল।"
মরিসন জানান, জুনের শেষের দিকে যখন তিনি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সাথে দেখা করেছিলেন, তখন তিনি ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কৌশলগত ব্যাপারগুলো নিয়ে স্পষ্টভাবেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিটার ডাটন বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, "জাতীয় নিরাপত্তার সর্বোত্তম স্বার্থের উপর ভিত্তি" করেই অস্ট্রেলিয়া ফ্রান্সের ডিজেল চালিত সাবমেরিন বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু শক্তি চালিত সাবমেরিনকে বেছে নিয়েছে।
ডাটন যুক্তি দেখিয়েছেন, "ফ্রান্সের সাবমেরিনের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের সাবমেরিন প্রযুক্তি যথেষ্ট উন্নত। এবং শেষ পর্যন্ত, আমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার সর্বোত্তম স্বার্থের উপর ভিত্তি করেই নিয়েছি"।
অন্যদিকে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এবং বিশ্বজুড়ে প্যারিসকে "একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার" হিসেবে জোর দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের মধ্যকার এই ফাটলকে হ্রাস করার চেষ্টা করেছেন।
তিনি বলেন, "আমি জোর দিয়ে বলতে চাই আমাদের আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অংশীদারদের স্বার্থকে আলাদা করে দেখে আঞ্চলিক বিভাজনের কোনো সুযোগ নেই"।
ব্লিনকেন বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র "ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ইউরোপীয় দেশগুলোকে স্বাগত জানায়"।
তিনি আরও বলেন, "বিশেষ করে ফ্রান্স এ অঞ্চলের অনেক ইস্যুতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, এবং আমরা ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমাদের ট্রান্স-আটলান্টিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগাতে চাই"।
- সূত্র- সিএনএন