‘ইসরায়েল ও নেতানিয়াহুর ফিলিস্তিন বিরোধী যুদ্ধ’
প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে আছেন। দুর্নীতির অভিযোগ এবং স্থিতিশীল ও নির্ভরযোগ্য জোট সরকার গঠনে বারবার ব্যর্থ হওয়ায় ইতোমধ্যেই নেতানিয়াহুর শাসনাবসানের আভাস মিলেছে।
তবে, বিশ্লেষকদের ধারণা ফিলিস্তিনের সাথে নতুন করে দ্বন্দ্বে জড়ানোর ফলে সুযোগসন্ধানী নেতানিয়াহুর জন্য ইসরায়েলের এযাবতকালের দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকার আরেকটি পথ উন্মোচিত হলো।
নেতানিয়াহু এবং তার রাজনৈতিক দল লিকুদ পার্টি জোট সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্রপতি রিউভেন রিভলিন বিরোধীদলীয় নেতা ইয়াইর লাপিদকে স্বাধীনভাবে সরকার গঠনের দায়িত্ব দিয়েছেন।
ইউনিভার্সিটি অব ডেনভারের মানবাধিকার প্রকল্পের পরিচালক মিশেলাইন ইশায়ের মতে, নির্বাচনের আগেই বিভিন্ন কারণে নেতানিয়াহু ইসরায়েলিদের জনসমর্থন হারিয়েছেন।
আল-জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইশায় বলেন, "নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে। জনগণ অমীমাংসিত নির্বাচন নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ২০২০ সালের মার্চে লিকুদের ৩৬টি আসন থাকলেও ২০২১ সালের মার্চে আসন সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩০টি। জনগণের মধ্যে বিস্তৃত এই মোহ মুক্তির পেছনে আছে আইনি মোকাদ্দমা এড়াতে নেতানিয়াহুর নিরলস প্রচেষ্টা, ডানপন্থী দলগুলোর মধ্যে ভাঙন এবং দীর্ঘমেয়াদী মহামারি।"
তবে, ফিলিস্তিনের সাথে সংঘর্ষের কারণে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে জনসাধারণের অসন্তোষ হ্রাস পেয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
"গাজার সাথে সংঘর্ষ বৃদ্ধির কারণে নাগরিকদের অনেকের মাঝেই নিঃসন্দেহে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। হামলা এবং যুদ্ধের মতো পরিস্থিতিতে রকেট ও অভ্যন্তরীণ হুমকির মুখে সাধারণ মানুষ বিদ্যমান সরকারের পেছনে জোটবদ্ধ হওয়ার দিকে ঝুঁকে। সেই হিসাবে, বর্তমান সংকট নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক নীলনকশাকেই শক্তিশালী করে তুলছে।"
#'পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী দখল'
ইশায় জানান, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতার স্পষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, নেতানিয়াহু রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ ছাড়াই এই দ্বন্দ্বে সমর্থন দিয়েছেন বলে তিনি মনে করেন না।
"জেরুজালেমে কট্টরপন্থী ইহুদি কাহানিস্টদের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উস্কানি, শেখ জারাহে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আরবদের সম্পত্তি দখল, রমজানে দামাস্কাস গেটে বাধা প্রদান এবং আল আকসায় পুলিশের পদক্ষেপ এই সবকিছুতে নেতানিয়াহু কেবল অনুমতি প্রদান করেননি, বরং বিষয়গুলো সযত্নে লালন করেছেন।"
"তবে, তিনি হামাসের পক্ষ থেকে কেমন প্রতিক্রিয়া কামনা বা, অন্তত অনুমান করেছিলেন তা স্পষ্ট নয়। উদ্দেশ্য যাই থাকুক, অন্তত সাময়িকভাবে এই যুদ্ধে হামাস এবং লিকুদ পার্টি উভয়পক্ষই উপকৃত হবে," বলেন ইশায়।
তবে, গত কয়েকদিনের সংঘাত যে নেতানিয়াহুর পক্ষে কাজ করেছে- তা কেবল জনসাধারণের নিছক অনুমান নয়।
প্রথমত, ইয়েশ আতিদের আশা অনুযায়ী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বড় ধরনের জোট গঠন আগের তুলনায় এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। নাফতালি বেনেটের দল ইয়ামিনা পার্টি লাপিদের সাথে কথা বন্ধ করেছে। পরিবর্তে, তারা এখন সরকার গঠনে নেতানিয়াহু এবং লিকুদের সাথে জোট বাধতে আগ্রহী। ব্যানেট বলেন, সংকটের সময় দেশের স্বার্থ বিবেচনায় তার দল এই অবস্থান নিয়েছে।
নেতানিয়াহু এবং ব্যানেটের হুট করে সমঝোতায় চলে আসা অনেকের জন্য অবাক করার মতো হলেও রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি সুচিন্তিত।
দিনশেষে, নেতানিয়াহু এবং ব্যানেট একই মতাদর্শের অনুসারী। দুজনেই একতরফাভাবে পশ্চিম তীর দখলের পক্ষে ছিলেন বলে মন্তব্য করেন ইশায়। তবে, পরিণতি প্রধানমন্ত্রীর জন্যই সুফল বয়ে আনবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
"নেতানিয়াহুর সাথে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে গিয়ে জাতীয় হুমকিকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যানেট লিকুদের সাথে জোটের সম্ভাবনা পুনরুজ্জীবিত করেছেন। একইসঙ্গে, নেতানিয়াহু-বিরোধী যেকোনো জোটকেই তা দুর্বল করে দিতে সক্ষম," বলেন ইশায়।
তবে, চলমান সংকট আলোচনায় কী ধরনের প্রভাব রাখবে তা বেনেট আগেই আন্দাজ করেছিলেন। তিনি জানতেন, মন্ত্রীত্বের পদ্গুলো ইতোমধ্যেই 'পরিবর্তিত জোটে'র জন্য বরাদ্দ হয়ে গেছে।
ইসরায়েলি সংসদ নেসেটে ন্যূনতম সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে জোট সরকারের ইসরায়েলে অবস্থানরত ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ভোটের প্রয়োজন ছিল। তবে, ইসরায়েলের ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার অস্থিরতায় এ ধরনের চিত্র কল্পনাতীত বিষয়ে পরিণত হয়। উভয় আরব দল এমন অবস্থানে পৌঁছায়, যেখান থেকে তারা ডানপন্থীদের নিয়ে গঠিত ইসরায়েলি সরকারকে সমর্থন করতে পারে না।
প্রাথমিক উদাহরণ হিসেবে মনসুর আব্বাসের কথা বলা যেতে পারে। ইউনাইটেড আরব লীগের (ইউএএল) এই নেতা লাপিদ এবং বেনেট সরকারকে সমর্থনে সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু, গাজায় সশস্ত্র সংঘাতের পর ইউএএল জোটের আলোচনা থেকে সরে দাঁড়িয়েছে।
ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত অঞ্চলে বেনেটের সেনা মোতায়েনের আহ্বানের পর ইউনাইটেড আরব লীগের পক্ষে তাদের নীতি অনুসরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে বলে উল্লেখ করেন ইশায়।
"বেনেট স্পষ্টত পরামর্শ দেন যে, আরবদের সাথে যৌথভাবে পরিচালিত সরকারের পক্ষে গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সামরিক শক্তির ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ফিলিস্তিনি অস্থিরতা প্রতিহত করতে পুলিশ মোতায়েনের নির্দেশ প্রদান সম্ভব নয়। এখানে থেকে বোঝা যায় যে, শান্তিকালীন সময় ছাড়া আরব ইসরায়েলিদের পক্ষে সরকারের অংশ হওয়া অসম্ভব," বলেন তিনি।
পরিণতি কোন দিকে যাবে সেটা নেতানিয়াহুর পছন্দ হোক বা না হোক, লক্ষ্য অর্জন করতে চাইলে তাকে বিষয়টি মেনে নিতে হবে।
তবে, জোট গঠনের প্রক্রিয়া সহজ হয়ে আসার বিষয়টিকে বাদ দিলেও, সপ্তাহব্যাপী চলতে থাকা সংঘাতের কারণে নেতানিয়াহুর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকার সম্ভাবনা নিশ্চিতভাবেই বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক।
সূত্র: আল জাজিরা
অনুবাদক: তামারা ইয়াসমীন তমা