বিস্মৃত মুখ, অপেক্ষায় থাকা পরিবার: হারিয়ে যাওয়া প্রবাসী শ্রমিকদের অজানা গল্প
প্রায় দুই দশক আগে সৌদি আরবে পাড়ি জমান মিজানুর রহমান। চেয়েছিলেন নিজের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে, পরিবার ও ভাইবোনদের জন্য কিছু করতে। তবে বিদেশে থাকার সময় বন্ধ হয়ে যায় পরিবারের সাথে সমস্ত যোগাযোগ। একজন অবৈধ অভিবাসীর জীবন যে কতটা কঠিন হতে পারে, সেটার সাক্ষী হয়েছেন তিনি।
গত বছর দেশে ফিরে তিনি বুঝতেই পারছিলেন না কোথায় যাবেন। মানসিকভাবে ছিলেন বিপর্যস্ত। অনেক কিছুই মনে করতে পারছিলেন না, বাক্য শেষ করার জন্য যুতসই শব্দ খুঁজতে গিয়ে বার বার থেমে যাচ্ছিলেন।
শুরুতে সৌদি আরবে চাকরি খুঁজতে গিয়েই সমস্যায় পড়েন তিনি। বাধ্য হয়ে কিছুদিন আত্মগোপনে থাকতে হয়। সেই সময় পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেন। পরে কোনো রকমে যে কাজগুলো পেয়েছিলেন, তা দিয়ে টিকে থাকাই কঠিন ছিল। তার ওপর সেখানে ঘটে যাওয়া একটি দুর্ঘটনা তার জীবনে নতুন দুর্ভোগ নিয়ে আসে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও পাননি তিনি।
প্রায় ২২ বছর পর, পুলিশ ও ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের যৌথ প্রচেষ্টায় মিজানুর রহমানকে উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামের চকরিয়া উপজেলার বদরখালিতে নিজের গ্রামে চিকিৎসাধীন। শারীরিক ও মানসিক অবস্থার কারণে তিনি এখনও স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছেন না।
মিজানুরের ছোট ভাই রেজাউল ভূট্টো বলেন, 'ভাই যখন বিদেশে গেলেন, আমি তখন ছোট। এরপর তার কোনো খোঁজ পাইনি। এত বছর পর তাকে দেখে তিনি আমাকে চিনতেও পারেননি। এখনো মাঝে মাঝে ভুলে যান যে আমি তার ভাই।'
বর্তমানে মিজানুরের বয়স ৪০-এর কোঠায়। তিনি অবিবাহিত, কোনো সঞ্চয় নেই এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল।
কতজন বাংলাদেশি প্রবাসী বিদেশে হারিয়ে গেছেন বা নিখোঁজ রয়েছেন, এখনও তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কারণ এসব ঘটনা প্রায়ই নথিভুক্ত হয় না, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক অভিবাসনের ক্ষেত্রে। বিদেশে আটক, বহিষ্কার এবং শোষণ প্রবাসীদের জন্য গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট-এর এক সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে যে, অনেক বাংলাদেশি অভিবাসী কাজ হারানো, নিয়োগকর্তার খারাপ আচরণ অথবা অস্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশের কারণে অকালভাবে দেশে ফিরে আসছেন।
গত বছর পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরেছেন আবদুল জব্বার। ৩৫ বছর তার পরিবারের সাথে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না। বরিশালের বাকেরগঞ্জের দুধল গ্রামে জন্ম নেয়া আবদুল জব্বার একসময় তিনি চালকলের (রাইসমিল) মালিক ছিলেন।
ইরান যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৮৮ সালে রাইসমিলটি বিক্রি করে সব টাকা দালালের হাতে তুলে দেন। দালাল তাকে ভারত ও পাকিস্তান হয়ে ইরানে পাঠানোর চেষ্টা করেন, তবে পাকিস্তানে আটকা পড়ে যান আবদুল জব্বার। সঠিক কাগজপত্র না থাকায় তাকে কারাবন্দি করা হয়।
আবদুল জব্বার প্রথম বছরে তার পরিবারকে কিছু চিঠি পাঠাতে সক্ষম হলেও পরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেন। তার শেষ চিঠিটি উর্দুতে লেখা ছিল বিধায় কেউ তার অর্থ বুঝতে পারেনি।
গত বছর তার পরিবার ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামে যোগাযোগ করে এবং তাদের কাছে যা কিছু তথ্য ছিল তা দিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনার অনুরোধ জানায়।
এত বছর পর আবার দেশের মাটিতে পা রাখেন তিনি, তবে হাতে ছিল পাকিস্তানি পাসপোর্ট। নিজের মাতৃভাষা বাংলাও ঠিকভাবে বলতে পারছিলেন না তিনি।
আবদুল জব্বারের ছোট ছেলে কামাল হোসেন বলেন, 'আমি যখন জন্মগ্রহণ করি, তখন আমার বাবা ইরান চলে গিয়েছিলেন। আমি কখনো তার মুখ দেখিনি বা তার কণ্ঠ শুনিনি। যখন আমি ছোট ছিলাম, আকাশে একটি বিমান উড়তে দেখলেই আমি মন থেকে দোয়া করতাম যেন আমার বাবা সেই বিমানে থাকেন এবং বাড়ি ফিরে আসেন'।
আবদুল জব্বারের আরও দুই সন্তান রয়েছে। যখন তিনি ইরান যাওয়ার জন্য দেশ ছাড়েন, তখন তার বড় ছেলে আওয়াল আকন ছিল মাত্র তিন বছর এবং মেয়ে নুপূর ছিল দুই বছর বয়সি।
তার স্ত্রী আর বিয়ে করেননি কখনও। পাঁচ বছর আগে মরণব্যাধি অসুখ ক্যান্সার বাসা বাঁধে তার শরীরে।
'এটা আমাদের সবার জন্য এক তিক্ত অধ্যায়। তবে আমি কৃতজ্ঞ যে, এখন আমরা একত্রিত,' বলেন কামাল।
বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম শ্রমশক্তি রপ্তানিকারক দেশ। সরকারি হিসেবে ১০ মিলিয়নেরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি বিশ্বের নানা প্রান্তে কাজ করছেন।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, 'আসল পরিসংখ্যান সম্ভবত ১০ মিলিয়নেরও বেশি, কিন্তু যারা অনানুষ্ঠানিক পথে দেশ ছেড়ে যান, তাদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহের উপায় নেই। এই কারণে পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন'।
'এছাড়াও, বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম রেমিট্যান্স প্রাপ্ত দেশ। এই খাতটি সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছে, তবে এর উন্নয়নে কাজ করা ব্যক্তিদের কল্যাণ প্রায়ই অগোচরেই থেকে যায় এবং অবহেলিত হয়,' যোগ করেন তিনি।
শরিফুল আরও জানান, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ মধ্য ভূমধ্যসাগরীয় পথ দিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমাতে যাওয়া অনথিভুক্ত অভিবাসীদের মধ্যে অন্যতম শীর্ষ দেশে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, 'উন্নত জীবনের সন্ধানে অনেকেই এই পথ বেছে নেয়, তবে এতে ঝুঁকি থাকে অনেক'।
প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশি দেশে ফিরে আসছেন। ২০০৮ সাল থেকে প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশিকে বিভিন্ন কারণে—বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
শরিফুল অভিবাসীদের ফিরে আসার সময় তাদের সম্মুখীন হওয়া বিপত্তি মোকাবিলায় বিমানবন্দরে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, 'এসব ব্যক্তিরা প্রায়ই বিভিন্ন মানসিক এবং শারীরিক অবস্থায় ফিরে আসেন — কেউ শোষণ, অত্যাচার বা নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন, আবার কেউ গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। এমনও রয়েছেন যেখানে ব্যক্তি তাদের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন এবং পরিবারের সদস্য বা ঠিকানা মনে করতে পারছেন না। তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন। আমাদের বিমানবন্দরে এসব ক্ষেত্রে সঠিকভাবে এবং সংবেদনশীলভাবে মোকাবিলা করার জন্য নির্দিষ্ট বিভাগ এবং অবকাঠামো থাকা উচিত'।
শরিফুল জানান, এরকম এক অভিবাসী আবুল কাসেম, সৌদি আরব থেকে ২৫ বছর পর একটি ট্রাভেল পাস নিয়ে ফিরে এসেছিলেন, কিন্তু অসুস্থতা ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার কারণে তিনি তার পরিবার বা ঠিকানা খুঁজে পাননি। পরে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাকে ব্র্যাকের কাছে পাঠান।
পরিবারের ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে আবুল কাসেম চট্টগ্রামের হালিশহর, হাটহাজারি এবং নয়াবাজারসহ কয়েকটি ঠিকানা উল্লেখ করেছিলেন। ব্র্যাকের কর্মীরা এসব এলাকায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন এবং বিভিন্ন স্থানে পোস্টার লাগান। এই সময়ে আবুল কাসেম ব্র্যাক মাইগ্র্যান্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারে আশ্রয় নেন।
পোস্টারগুলো অবশেষে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ২৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুস সাবুরের নজরে আসে। তিনি আবুল কাসেমকে চিনতে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নিশ্চিত হওয়ার পর ব্র্যাক গত বছর ঢাকায় আবুল কাসেমকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়।
শরিফুল বলেন, 'এ ধরনের প্রচেষ্টা সুশৃঙ্খলভাবে হওয়া উচিত, যেখানে সরকারের এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত কার্যক্রম নিশ্চিত করবে, যাতে এসব ব্যক্তিকে সম্মান ও সহায়তার সঙ্গে পুনরায় সামাজিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়'।